দেশের খবর: অবশেষে দুদকের জালে ধরা পড়েছে বাংলাদেশ বিমানের ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পুরো নিয়োগ কমিটি।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) জানিয়েছে, দুই দফা বিমানের ক্যাডেট পাইলট নিয়োগে সীমাহীন দুর্নীতির পেছনে সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ একা জড়িত ছিলেন না।
তার সঙ্গে এই ভয়াবহ দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন বর্তমান এমডি ক্যাপ্টেন ফারহাত জামিলসহ পুরো নিয়োগ কমিটি। দু-একজন সরাসরি নিয়োগ বাণিজ্যে অংশ না নিলেও মোসাদ্দিক-জামিলের মর্জিমতো কাজ করেছেন।
দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে মিলেছে এর প্রমাণ। অভিযোগের বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও এর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।
এ অবস্থায় সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ, বর্তমান এমডি ক্যাপ্টেন ফারহাত হোসেন জামিলসহ বিমানের বর্তমান ও সাবেক ৭ পরিচালককে জিজ্ঞাসাবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে দুদক।
এছাড়া জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় রাখা হয়েছে পাসপোর্ট কেলেঙ্কারির হোতা ও বিমানের চিফ অব ট্রেনিং ক্যাপ্টেন ফজল মাহমুদ ও সাবেক জেনারেল ম্যানেজার (প্রশাসন) বুশরা ইসলামকে। ৭ পরিচালকের বাকিরা হলেন- পরিচালক স্টোর অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট (সাবেক পরিচালক প্রশাসন ও কাস্টমার সার্ভিস) মোমিনুল ইসলাম, সাবেক পরিচালক (প্রশাসন) পার্থ কুমার পণ্ডিত, পরিচালক ইঞ্জিনিয়ারিং সাজ্জাদুর রহিম, পরিচালক (প্ল্যানিং) এয়ার কমোডর মাহবুব জামান খান, পরিচালক (ফাইন্যান্স)
বিনিত সুদ ও সাবেক পরিচালক মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস আশরাফুল আলম।
প্রথম দফায় আগামী ২৭ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে পার্থ কুমার পণ্ডিতকে। দ্বিতীয় দফায় ২৮ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদের তালিকায় আছেন সাজ্জাদুর রহিম, মোমিনুল ইসলাম ও বুশরা ইসলাম।
২৯ জুলাই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বর্তমান এমডি ও পরিচালক ফ্লাইট অপারেশন ক্যাপ্টেন ফারহাত হোসেন জামিল, মাহবুব জামিল খান, আশরাফুল আলম ও বিনিত সুদকে। শেষদিন জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে সাবেক এমডি ও নিয়োগ বাণিজ্যের মূল হোতা ক্যাপ্টেন মোসাদ্দিক আহমেদকে। ইতিমধ্যে দুদকের পক্ষ থেকে সবাইকে চিঠি দেয়া হয়েছে।
দুদকের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্টরা সাবেক এমডি মোসাদ্দিক আহমেদ ও ডিএফও ফারহাত জামিলের ক্ষমতার অপব্যবহার করে পাইলট নিয়োগসহ বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাপক ঘুষ-বাণিজ্য করেছেন।
এ অবস্থায় তাদের জ্ঞাত ও আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বক্তব্য গ্রহণ প্রয়োজন।
দুদক মনে করে, নিয়োগ কমিটির সব সদস্যের সিদ্ধান্ত ছাড়া নিয়োগ বা এ জাতীয় বড় ধরনের কাজ করা অসম্ভব। দুদকের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে পাইলট নিয়োগ বাণিজ্যের সঙ্গে বিমান পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য ও বাংলাদেশ পাইলট অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) ২-৩ জন প্রভাবশালী শীর্ষ নেতার হস্তক্ষেপ রয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে নিয়োগ কমিটির সদস্যের কাছ থেকে এদের নাম ও নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা জানতে চাওয়া হবে। এরপর অনুসন্ধান শেষে প্রয়োজন হলে তাদেরও চিঠি দিয়ে জিজ্ঞাসাবাদের আওতায় আনা হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, জিজ্ঞাসাবাদ শেষে প্রয়োজন হলে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে জেলহাজতেও পাঠানো হতে পারে।
দুদক ইতিমধ্যে পাইলট নিয়োগের বিধিমালা, ২০১৮ সালে পাইলট নিয়োগের অনুমোদন সংক্রান্ত রেকর্ড, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার ফলাফল, সাইকোমেট্রিক টেস্টের ফলাফল, প্রার্থীদের আবেদন বাছাই কমিটির নামসহ নিয়োগের জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচিতদের তালিকা যাচাই-বাছাই করে দেখেছে। পাইলট নিয়োগ ছাড়াও বিমানের বিভিন্ন খাতে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানে দুদক থেকে চারটি টিম একযোগে কাজ করছে।
বাকি তিন টিমের একটির নেতৃত্বে রয়েছেন সিনিয়র উপপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন। অন্য দুটি টিমে আছেন সহকারী পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন ও আতাউর রহমান। এ চার টিমের কাজ সমন্বয় করছেন পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেন।
১৫ দিনের অনুসন্ধানে দুদকের টেবিলে বিমানের দুর্নীতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য চলে এসেছে। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতি সংক্রান্ত দুটি তদন্ত প্রতিবেদন। এছাড়া দুদকের গোয়েন্দা বিভাগের মাধ্যমেও বেশ কিছু তথ্য চলে এসেছে। এর মধ্যে অনেকের অস্বাভাবিক সম্পদের তথ্যও রয়েছে। বিমানের সদ্য সাবেক এমডি ছাড়াও কয়েকজন পরিচালক, জিএম, অন্য পদস্থ কর্মকর্তা এমনকি বিমানের সিবিএ নেতাদের সম্পদের তথ্য এখন দুদকের কাছে। চলছে সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই।
অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার পর বাকিদের দুদকে তলব করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। যদিও এরই মধ্যে একাধিক কর্মকর্তাকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক।
তবে তাদের দেয়া তথ্য যাচাই করে ফের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। দুদক মনে করছে সংস্থাটির বর্তমান এমডি পাইলট হওয়ায় বর্তমানে কতিপয় অসাদু পাইলট বিমানে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে।
তারা কোনো ধরনের আইন-কানুনের তোয়াক্কা করছে না। পুরো বিমান চলছে কয়েকজন পাইলটের অবৈধ অঙ্গুলি হেলনের মাধ্যমে। সম্প্রতি বেশকিছু অ্যাকশনের কারণে মার্কেটিং বিভাগে কিছুটা শৃঙ্খলা এলেও ফ্লাইট অপারেশন বিভাগজুড়ে চলছে ত্রাসের রাজত্ব। এখানে কেউ কাউকে মানছে না।
ইচ্ছা হলেই কতিপয় সিনিয়র পাইলট ফ্লাইট পরিচালনা না করার হুমকি দিচ্ছে। কিছুদিন আগে ডিএফও নিয়োগ বাতিলের দাবিতে একযোগে ৩ সিনিয়র পাইলট লন্ডন ফ্লাইট না করার জন্য নিজেদের রহস্যজনক ‘সিক’ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ক্যাপ্টেন শোয়েব চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনফিট অবস্থায় ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনার অভিযোগে তদন্ত শুরু হয়েছে। দুদকের মতে, বর্তমানে বিমানের এই বিভাগটি চরম ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
বিমানের দুর্নীতি দমনের বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটি সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না দুর্নীতির কারণে।
কারা এর পেছনে রয়েছে তাদের সবাইকে আমরা তদন্তের আওতায় আনতে চাই। বিচারের কাঠগড়া পর্যন্ত পৌঁছে দিতে চাই। সে লক্ষ্যেই আমাদের সব টিম কাজ করছে।
দুর্নীতি অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে সম্প্রতি অব্যাহতি দেয়া এমডি ও সিইও মোসাদ্দিক আহমেদসহ ১০ জনের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ২ মে দুদক থেকে পুলিশের বিশেষ শাখার এসপির (ইমিগ্রেশন) কাছে চিঠি পাঠানো হয়।
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব জনেন্দ্র নাথ সরকার বিমানে পাইলট নিয়োগে দুর্নীতির তদন্ত করেন। সেই প্রতিবেদন তিনি মন্ত্রণালয়ে জমা দেন।
এরপর তা মন্ত্রণালয়ে পর্যালোচনা করে বিমানের এমডি ও সিইও মোসাদ্দিক আহমেদকে অব্যাহতি দেয়া হয়। এছাড়া দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তাদের আবেদনের ভিত্তিতে দুটি তদন্ত প্রতিবেদনই দুদককে সরবরাহ করে মন্ত্রণালয়।
জানা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত দুদকের দুটি বিশেষ টিম প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বিমানের মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস বিভাগ, গ্রাউন্ড সার্ভিস বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ ও কার্গো শাখার অনিয়ম-দুর্নীতির অনুসন্ধান করছে। পর্যায়ক্রমে অন্য শাখার দুর্নীতির তথ্যও সংগ্রহ করবে এ টিম।
বিমানে পাইলট নিয়োগে দুর্নীতির বিষয়ে যুগ্মসচিবের তদন্ত প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, বিমানে পাইলট নিয়োগের আগে পরিচালনা পর্ষদের কাছ থেকে শূন্যপদের অনুমোদন নেয়া হয়নি।
শিক্ষাগত যোগ্যতা ও বয়স নির্ধারণে বিমানের প্রচলিত নিয়মনীতি মানা হয়নি। বরং তারা নিজেদের ইচ্ছামতো ব্যাখ্যা দিয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি সংশোধন করে এমডির ভাতিজাসহ কমপক্ষে ৩০-৩২ প্রার্থীর শিক্ষাগত যোগ্যতা শিথিল করে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়।
এতে আরও বলা হয়, প্রার্থীদের প্রাথমিক বাছাইয়ের কাজটিও বিধি মোতাবেক হয়নি। বরং এক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যক্তি ও পক্ষকে বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদনে সুপারিশ অংশে আরও বলা হয়, অপারেশন ম্যানুয়াল পার্টে এ অনুযায়ী নিয়োগের পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়নি।
লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মানবণ্টন ম্যানুয়াল অনুযায়ী না করে মৌখিক পরীক্ষায় শতকরা ৫০ নম্বর রেখে বিশেষ প্রার্থীদের সুবিধা দেয়া হয়। সুপারিশে ক্যাডেট পাইলট নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম সৃষ্টির জন্য নিয়োগের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিরুদ্ধে পরিচালনা পর্ষদ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে মর্মেও মতামত দেয়া হয়।
সূত্র জানায়, ওই প্রতিবেদনের সুপারিশ ও সার্বিক বিষয়াদি বিবেচনায় নিয়ে পাইলট নিয়োগ কমিটির সবাইকে অনুসন্ধানের আওতায় আনা হচ্ছে। এছাড়া নিয়োগ কমিটির সদস্য সচিব, চিফ অব ট্রেনিং, চিফ অব টেকনিক্যাল, ম্যানেজার এমপ্লয়মেন্ট, ম্যানেজার পার্সোনাল, আবেদন বাছাই কমিটির সদস্য, সাইকোমেট্রিক টেস্ট ও মৌখিক পরীক্ষা যারা নিয়েছেন তাদের বক্তব্য নেবে দুদক।