শিক্ষা সংবাদ: বহুল আলোচিত নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব অবশেষে চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাদে মোট এক হাজার ৭৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের প্রস্তুত করা এ নথি শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির কাছে পেশ করা হয়েছে। মন্ত্রীর অনুমোদন মিললে এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হবে।
২০১৯-২০২০ অর্থবছরে এমপিওভুক্তির জন্য বরাদ্দ রয়েছে ৮৬৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৭৬৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলে তাতে ব্যয় হবে ৭৯৬ কোটি ৪৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা। বাকি ৬৮ কোটি ৫৭ লাখ টাকা মন্ত্রণালয়ের হাতে উদ্বৃত্ত থাকবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সারাদেশের মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার জন্য পৃথকভাবে কাজ করছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ। আগামী দু-একদিনের মধ্যে এ তালিকাও চূড়ান্ত হবে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনকালে এমপিওভুক্তির তালিকায় আরও কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যুক্ত হতে পারে। সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান আরও বাড়বে। যে ১ হাজার ৭৬৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রস্তাব করা
হয়েছে তার মধ্যে এমপিওভুক্তির সব শর্ত পূরণ করে বাছাইয়ে টিকেছে এক হাজার ৬৪৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বুয়েটের তৈরি করা বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। এমপিওভুক্তির নীতিমালা-২০১৮-এর ১৪ ধারা অনুযায়ী, এসব প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় সব শর্ত পূরণ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বাছাই করার পর দেখা যায়, সারাদেশের ৮৯টি উপজেলার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। সমতার স্বার্থে এসব উপজেলায় এমপিওভুক্তির নীতিমালার ২২ নম্বর ধারা প্রয়োগ করেছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ। এ ধারায় বলা হয়েছে, ‘শিক্ষায় অনগ্রসর, ভৌগোলিকভাবে অসুবিধাজনক, পাহাড়ি, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল, নারী শিক্ষা, সামাজিকভাবে অনগ্রসর গোষ্ঠী, প্রতিবন্ধী, বিশেষায়িত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিল করা যেতে পারে।’
নীতিমালার এ ধারা প্রয়োগ করে ৮৯টি উপজেলার মধ্যে এমপিওভুক্তির শর্ত পূরণে সর্বোচ্চ নম্বরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানকে যোগ্য হিসেবে বাছাই করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মানদণ্ড হিসেবে শিক্ষার্থীর সংখ্যা নূ্যনতম ১০০ জন এবং কমপক্ষে দুই বছরের স্বীকৃতি থাকার বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। বাদপড়া প্রতিটি উপজেলা/থানা থেকে একটি প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা হয়েছে। এই মানদণ্ডে ৬০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। বিশেষ বিবেচনায় বাছাই করা হয়েছে কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী উপজেলার ছিটমহলের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘মইদাম কলেজ’- যেটির ছাত্র সংখ্যা ৮৫ জন। ২২ ধারা প্রয়োগ করে মোট ৬১টি প্রতিষ্ঠানকে তালিকায় স্থান দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দেশের দুর্গম ও পার্বত্য এলাকা, পাহাড়ি, হাওর-বাঁওড়, চরাঞ্চল এবং উপকূলীয় এলাকায় নীতিমালার ১৪ ধারা অনুসারে এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি, এমন ৫৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ৫০০ জন বা তার বেশি এবং কমপক্ষে দুই বছরের স্বীকৃতি থাকার শর্ত পূরণ করতে হয়েছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বাদপড়া ৮৯টি উপজেলায় ২২ ধারা প্রয়োগ করে ৬১টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার পরও ২৯টি উপজেলা ও থানা বাদ থেকে যায়- যেগুলোর মধ্যে উপজেলা ১২টি ও থানা ১৭টি। এই ১২ উপজেলার সাতটি থেকে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান বাছাই করা হয়েছে। যোগ্য না হওয়ায় অপর পাঁচটি উপজেলার কোনো প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। অপরদিকে, দেশের ২৩টি উপজেলা/থানা এলাকা থেকে এমপিওভুক্তির জন্য এ বছর কোনো আবেদনই পাওয়া যায়নি।
নতুন বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সর্বশেষ এমপিওভুক্ত করা হয়েছিল আট বছর আগে ২০১০ সালের ১৬ জুন। সেদিন সারাদেশের এক হাজার ৬০৯টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি) এমপিওভুক্তি করা হয়। প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী তখন সরকারি বেতনের আওতায় এসেছিল। বর্তমানে সারাদেশের প্রায় সাড়ে আট হাজার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে।
কোন ধরনের কতটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান : অনুসন্ধানে জানা গেছে, সারাদেশে এমপিওভুক্তির জন্য চূড়ান্ত করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে ৫৫১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১০০২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ৬৭টি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ৯৪টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ এবং ৫৩টি ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) পর্যায়ের। এমপিওভুক্তির জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে মোট আবেদন জমা পড়েছিল ছয় হাজার ১৪১টি। যাচাই-বাছাই শেষে সব শর্ত পূরণ করে অথবা বিশেষ বিবেচনায় যোগ্য হয়েছে এক হাজার ৭৬৭টি। এমপিওভুক্তির জন্য অযোগ্য বিবেচিত হয়েছে চার হাজার ৪৯২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।
প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রস্তুত করা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নথিতে এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করার ব্যয়ও তুলে ধরা হয়েছে। ৫৫১টি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে এক বছরে ব্যয় হবে ১৯১ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। একইভাবে ১০০২টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের জন্য ৪৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, ৬৭টি স্কুল অ্যান্ড কলেজের জন্য ৪২ কোটি ৫৫ লাখ টাকা, ৯৪টি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজের জন্য ৮৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা এবং ৫৩টি ডিগ্রি (অনার্স-মাস্টার্স) পর্যায়ের কলেজের এমপিওভুক্তিতে ২৩ কোটি ৩৪ লাখ টাকা ব্যয় হবে। মোট ব্যয় হবে ৭৯৬ কোটি ৮৬ লাখ ৪৩ হাজার টাকা।
মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য : এ বিষয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন বলেন, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন এমপিও দেওয়া সময়ের ব্যাপার মাত্র। যে কোনো সময় তা ঘোষণা করা হবে। নীতিমালা অনুযায়ী, যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানই এমপিও পাবে। মন্ত্রণালয় থেকে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এখন প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেলেই প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
অবশ্য কতগুলো প্রতিষ্ঠানকে এমপিও দেওয়া হবে সে বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।
শিক্ষক সংগঠনের বক্তব্য : তবে ‘এত কম প্রতিষ্ঠান’ এমপিও দেওয়ার খবরে খুশি নন নন-এমপিও শিক্ষকরা। ‘নন-এমপিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশনের’ সভাপতি অধ্যক্ষ গোলাম মাহমুদুন্নবী ডলার বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, ১ হাজার ৭৬৭টি প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হলে তা হবে অমানবিক। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা গত আট বছর খেয়ে না খেয়ে, বিনা বেতনে অথবা স্বল্প বেতনে জ্ঞানের আলো বিলিয়ে যাচ্ছেন। তাদের চাওয়া, আবেদন করা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকেই এমপিওভুক্ত করা হোক।
তিনি বলেন, একযোগে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করা না হলে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলা হবে।সূত্র: সমকাল