আমি খুব আশাবাদী মানুষ। আমি জানি আমার এই আশাবাদ নিয়ে আশপাশের অনেকেই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা তামাশা করেন- আমি কিছু মনে করি না। আমার পিএইচডি সুপারভাইজারের কাছে শোনা একটি গল্প মনে পড়ে। তিনি আমাকে একজন আশাবাদী ছেলের গল্প শুনিয়েছিলেন। গল্পটি অনেকবার অনেক জায়গায় শুনিয়েছি, আরো একবার শুনতে পাঠকরা নিশ্চয়ই আপত্তি করবেন না। গল্পটি এ রকম : একটা বাচ্চা ছেলে খুবই আশাবাদী, কোনো কিছুই তাকে নিরুৎসাহিত করতে পারে না। সে সব সময় লাফাচ্ছে, ঝাপাচ্ছে, হাসছে, খেলছে। তার মা-বাবা এই বাচ্চা ছেলেটার ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো চিন্তায় পড়ে গেলেন। তারা ভাবলেন ছেলেটা যখন বড় হবে, কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হবে তখন সে নিশ্চয়ই একটা ধাক্কা খাবে। তাই তারা ভাবলেন ছেলেটাকে রূঢ় বাস্তবের মুখোমুখি করতে হবে। মা-বাবা অনেক ভেবেচিন্তে রাস্তা থেকে বেশ খানিকটা ঘোড়ার গোবর এনে বাচ্চা ছেলেটার ঘরে ফেলে রাখলেন। ভাবলেন ছেলেটা যখন স্কুল থেকে বাসায় এসে তার ঘরে এই গোবর দেখবে সে নিশ্চয়ই খুবই ঘাবড়ে যাবে। ঘর থেকে ঘোড়ার গোবর পরিষ্কার করতে গিয়ে তার এক ধরনের শিক্ষা হবে, হাসিখুশি আনন্দ একটুখানি হলেও কমবে। বাবা-মা তাদের ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলেন। ছেলে স্কুল থেকে বাসায় এসে নিজের ঘরে ঢুকেছে এবং একটু পরেই মা-বাবা তাদের ছেলের একটা বিশাল আনন্দ ধ্বনি শুনতে পেলেন। ছেলে আনন্দে লাফাতে লাফাতে বলতে লাগল, ‘ঘরের ভেতরেই যেহেতু ঘোড়ার গোবর তার মানে আশপাশে নিশ্চয়ই কোথাও ঘোড়াটা আছে! কী মজা!’
আমার অবস্থা অনেকটা এই ছেলের মতো, সব সময়েই সব জায়গায় আমি আশার আনন্দ খুঁজে পাই। আমার ধারণা শুধু আমি নই আমার মতো যারা ১৯৭১-এর সেই ভয়াবহ সময় পার করে এসেছে তাদের সবাই এই দেশ নিয়ে আশাবাদী। আমরা মানবতার সবচেয়ে নৃশংস রূপটি দেখেছি একই সঙ্গে এই দেশের মানুষের সাহস, শক্তি এবং আত্মত্যাগের রূপটি দেখে এসেছি। আমরা কীভাবে এই দেশ নিয়ে আশাবাদী না হয়ে পারব?
আমি স্বীকার করছি খবরের কাগজ দেখলে যে কেউ এক ধরনের হতাশা অনুভব করবেন। কিছুদিন আগেও সেখানে ছিল ধর্ষণ, গণধর্ষণ আর শিশু ধর্ষণের খবর। মনে হচ্ছিল মাদ্রাসা শিক্ষকরা বুঝি একজনের সঙ্গে আরেকজন এই ব্যাপারে প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। এখন হচ্ছে ডেঙ্গুর খবর। সারাজীবন দেখে এসেছি বেঁচে থাকতে হলে মানুষের রোগ-শোক হয়, কিছুদিন ভুগে আবার ভালো হয়ে যায়। এখন কথা নেই বার্তা নেই দুধের শিশুটি থেকে বড় মানুষ ডেঙ্গুতে হঠাৎ করে মারা যাচ্ছে- কী ভয়ঙ্কর একটা পরিবেশ। ঈদের আগে আর পরে গাড়ি এক্সিডেন্টের খবর, এত অল্প সময়ে সড়ক দুর্ঘটনায় এত মানুষ মারা যেতে পারে নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ঈদের সময়টিতে হঠাৎ দেখি চামড়া কেলেঙ্কারির খবর, রাতারাতি বিচিত্র সিন্ডিকেট গড়ে উঠে চামড়া ব্যবসায়ীদের পথে বসিয়ে দিচ্ছে। তার আগে ছিল বন্যার খবর। মাঝখানে দুধ নিয়ে বিশাল হৈচৈ গবেষকরা দুধের মাঝে এন্টিবায়োটিক পেয়েছেন, মুখ ফুটে সেই কথাটি বলা মাত্র মনে হলো সরকারি কর্মকর্তারা গবেষকদের টুঁটি চেপে ধরবেন, একটা সমস্যাকে অস্বীকার করলেই কি সমস্যাটা চলে যায়? এমনিতে সারা বছরই রোহিঙ্গাদের নিয়ে খবর থাকে, ইয়াবার বড় বড় চালান নিয়ে খবর থাকে, ক্রস ফায়ারে বিনা বিচারে মানুষ মেরে ফেলার খবর থাকে, বাংলাদেশ বিমানে করে যাত্রী আনা-নেয়ার খবরের বদল সোনা আনা-নেয়ার খবর অনেক বেশি থাকে। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার ছিল ছেলেধরা সন্দেহে একেবারে নিরীহ নারী-পুরুষকে নির্মমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলা। হঠাৎ করে মনে হতে থাকে আমরা বুঝি সভ্য মানুষ নই, আমরা বুঝি মধ্যযুগের বর্বর মানুষ।
কাজেই খবরের কাগজ পড়ে কারো যদি মন খারাপ হয়, কেউ যদি হতাশা অনুভব করেন আমরা তো তাকে দোষ দিতে পারি না। আমি তার মাঝেও নিজের আশাবাদকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করি। দাঁতে দাঁত চেপে খবরগুলো পড়ি তারপর নিজেকে বোঝাই পৃথিবীর সব জাতি কোনো না কোনো সময় এই প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে গিয়েছে। আমরাও যাচ্ছি, এক সময় আমরা শক্ত অর্থনীতির ভিত্তির ওপর দাঁড়াব। এখনই আমাদের ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরা সমান তালে লেখাপড়া করছে, সেই লেখাপড়ার মান আরো ভালো হবে। দেশের ছেলেমেয়েরা আধুনিক মানুষ হিসেবেও বড় হবে। সরকার ঠিকভাবে চলবে, আইনের শাসন দৃঢ় হবে, দুর্নীতি কমে আসবে, বায়ু দূষণ বন্ধ হবে, খাবারে ভেজাল থাকবে না। নদীগুলো মুক্ত হবে, সবুজ দেশটি আরো সবুজ হয়ে উঠবে। আমি এসব নিয়ে আশা করতে একটুও ভয় পাই না। আশাবাদী হয়ে বেঁচে থাকার একটা অনেক বড় সুবিধা আছে, ভয়ঙ্কর দুঃসময়টিও সাহস নিয়ে পার করে দেয়া যায়! আমি জানি, কারণ আমি পার করেছি!
মানুষ খুবই বিচিত্র একটি প্রাণী। একজন মানুষ হয়তো নিজের জীবন নিয়েই হিমশিম খাচ্ছে তারপরও সে পুরো দেশ নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। শুধু দেশ নয়, পৃথিবী নিয়ে চিন্তাভাবনা করে। কেউ কেউ বিশ্ব ব্রহ্মা- নিয়ে মাথা ঘামায়। যে কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বললে দেখা যাবে তার দেশ নিয়ে কিছু একটা পরিকল্পনা আছে। দেশটাকে কীভাবে ঠিক করা যাবে সেটা নিয়ে তার নিজের চিন্তাভাবনা আছে। আমিও চিন্তা করি। তবে আমার ধারণা অন্যরা যে রকম অল্পতে কাতর হয়ে যান আমি তত সহজে কাতর হই না। আশাবাদী হওয়ার কারণে যেটুকু পেয়েছি তাতেই মহা খুশি হয়ে যাই, যেটুকু পাইনি তার জন্য ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করি। ভবিষ্যতে পেয়ে যাব সেটা আশা করে বসে থাকি।
আমি কি পেয়েছি? যাদের জন্মই হয়েছে বাংলাদেশে তারা বুঝবে না কিংবা অনুভব করবে না কিন্তু আমাদের প্রজন্ম জানে যে আমরা বাংলাদেশটি পেয়েছি। যদি না পেতাম তাহলে আমাদের কি অবস্থা হতো আমি কল্পনাও করতে পারি না। যদিও বামপন্থি অধ্যাপকরা ক্রমাগত আমাদের যুক্তি প্রমাণ দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছেন এই দেশের উন্নয়নের পুরো ব্যাপারটিই একটা ভাঁওতাবাজি কিন্তু আমি তো দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানের ইমরান খান একটা ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমানে সমান হয়ে একটা মর্যাদার আসনে বসে নানা দেশের প্রধানমন্ত্রী-প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে কথা বলছেন। আমি আমার ইউনিভার্সিটিতে পঁচিশ বছর অধ্যাপনা করে অবসরে গিয়েছি, পুরো সময়টুকু কীভাবে কম খরচে একটা ডিপার্টমেন্ট চালানো যায় তার কলাকৌশল আবিষ্কার করে দিন কাটিয়েছি। পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বছরে মাত্র কয়েক কোটি টাকা পেয়েছে, সেটা দিয়ে কোনোমতে একটা বিল্ডিং তোলা হয়েছে, কয়েকটা ক্লাসরুম বানানো হয়েছে। অথচ এখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে হাজার কোটি টাকার কাজ শুরু হতে যাচ্ছে। বামপন্থি অধ্যাপকরা নিশ্চয়ই আমাকে বোঝাতে পারবেন এই হাজার কোটি টাকার মাঝে রয়েছে বিশাল শুভঙ্করের ফাঁক- কিন্তু যতক্ষণ বোঝাতে না পারছেন ততক্ষণ এই বিশাল অঙ্কের টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে আনন্দ পেতে চাই। আমি অল্পতেই খুশি হই বেশি হলে আমি কি পাগলামো করে ফেলব কে জানে!
যাই হোক দেশের উন্নয়নের ব্যাপারটা আমার পাওয়ার মূল বিষয় নয়। আমার মূল পাওয়া হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীর বিচার। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও দীর্ঘদিন একটা গ্লানি নিয়ে বেঁচেছিলাম। বিশেষ করে যখন যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশের মন্ত্রী হয়ে গাড়িতে পতাকা লাগিয়ে ঘুরে বেড়াত সেই জ্বালা সহ্য করা খুব সহজ ছিল না। যখন ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জানতে চাইত যারা এই দেশটাকে চায়নি তারা কেমন করে এই দেশের মন্ত্রী হয় আমি তাদের এই অতি সহজে-সরল প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতাম না। আমাকে এখন আর সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় না, উল্টো সুযোগ পেলে (কিংবা না পেলেও) তাদের মনে করিয়ে দিই চল্লিশ বছর পরে হলেও আমরা যুদ্ধাপরাধীর বিচার করেছি। দেশ নিয়ে আমার কি আরো কিছু চাওয়ার আছে? আমি যখন এটা নিয়ে চিন্তা করি তখন আমার মনে হয় আমি দেশ থেকে আর মাত্র দুটি জিনিস চাই, তারপর আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না। আমি যে দুটি বিষয় চাই তার একটি হচ্ছে রাজনৈতিক দল সংক্রান্ত। আমি চাই এই দেশে যেন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল না থাকে। আরো সহজ করে বলা যায় সংসদে সরকারি দল যে রকম হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক দল ঠিক সে রকম বিরোধী দলও হবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি রাজনৈতিক দল। রাজনৈতিক কলাকৌশল নিয়ে দুই দলের মাঝে দ্বন্দ্ব থাকবে কিন্তু দেশের মূল আদর্শ নিয়ে কোনো দ্বন্দ্ব থাকবে না। আরো সোজাসুজি বলা যায় জামায়াতে ইসলামীকে সঙ্গী করে আর কোনো দল কোনোদিন রাজনীতি করবে না, নির্বাচন করবে না।
আমার অন্য চাওয়াটি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। ১৫ আগস্ট বিডিনিউজ২৪-এ সৈয়দ বদরুল আহসানে একটি লেখা বের হয়েছে (All those men… on 15 August 1975 and after) এই দেশের সবার সেই লেখাটিতে একটিবার হলেও চোখ বুলানো উচিত তাহলে আমাদের এক ধরনের বোধোদয় হবে। এখন সবাই উঠতে বসতে বঙ্গবন্ধুর নাম জপ করছে কিন্তু ১৯৭৫ সালে কারা কি করেছিল? কেন করেছিল?
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার বিষয়টি অবিশ্বাস্য রকম হৃদয়বিদারক, আমার মাঝে মাঝেই মনে হয় বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের বুক থেকে মুছে ফেলার চেষ্টাটুকু কোনো অংশে কম হৃদয়বিদারক নয়। এই দেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম বড় হয়েছে যাদের কাছে বঙ্গবন্ধুর নামটি পর্যন্ত উচ্চারণ করা হয়নি অথচ বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধু সমার্থক। কেউ যদি মাত্র একটি লাইন ব্যবহার করে বাংলাদেশের ইতিহাস বলতে চায় সেখানেও বঙ্গবন্ধুর নামটি উচ্চারণ করতে হবে। অথচ সেই বঙ্গবন্ধুর নামটি মুছে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল। কী ভয়ঙ্কর!
কাজেই দেশ নিয়ে আমার দ্বিতীয় চাওয়াটি হচ্ছে এই দেশের সব রাজনৈতিক দল বঙ্গবন্ধুকে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিয়ে রাজনীতি করবে। আরো সহজ করে বলা যায় বঙ্গবন্ধু সব সময় থাকবেন এই দেশের সব ধরনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তিনি কোনো দলের মানুষ হবেন না, তিনি হবেন এই দেশের সবার হৃদয়ের মানুষ। আমার এই দুটি চাওয়া মোটেও বেশি চাওয়া নয়- দুটি খুবই ‘একটুখানি’ মাত্র চাওয়া। আমি এটা আইন করিয়ে করাতে চাই না, জোর করে করাতে চাই না। আমি চাই এটা এই দেশের মানুষের হৃদয় থেকে আসুক, দেশের জন্য ভালোবাসা থেকে আসুক। আসবে। নিশ্চয়ই আসবে। আমি আশাবাদী মানুষ।
মুহম্মদ জাফর ইকবাল: অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।