নিজস্ব প্রতিনিধি : ট্রাকের ফিটনেস, বৈধ কাগজপত্র, চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স কোনটাই নেই? কোন সমস্যা না। গাড়িতে এন পি (ঘ.চ) পরিবহন (ন্যাশনাল পরিবহন সার্ভিস) অথবা এন টি (ঘ.ঞ) ট্রান্সপোর্ট (নূর ট্রান্সপোর্ট) এর স্টিকার থাকলে দেশের কোন প্রান্তে কোন ধরনের সমস্যা হবেনা। ট্রাফিক, হাইওয়ে, থানা পুলিশ কেউই স্পর্শ করবেনা গাড়িতে। সাতক্ষীরার ট্রাক মালিক ও চালকদের মধ্যে এমন কানা-ঘোষা দীর্ঘদিনের।
ট্রাক মালিক ও চালকদের এমন তথ্যে অনুসন্ধানে গেলে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। দেশের ৬৪ জেলার ১৯০ টি থানা, ট্রাফিক, হাইওয়ে পুলিশকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছে এন পি মটরস্ (ন্যাশনাল পরিবহন সার্ভিস) এবং এন টি ট্রান্সপোর্ট (নূর ট্রান্সপোর্ট) কর্তৃপক্ষ।
এদের মূল কাজ হলো সারা দেশের ট্রাফিক ও থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে অবৈধ ট্রাক সড়কে চলাচল করানো। এ জন্য ট্রাকের সামনে বা বডিতে লাগানো থাকে এন পি পরিবহন অথবা এন টি ট্রান্সপোর্টের বিশেষ এক ধরনের স্টিকার যেটাকে এর ব্যবহারকারীরা ‘ব্যানার’ও বলে। এই প্রতিটি ব্যানারের জন্য ট্রাক মালিকদের দিতে হয় মাসে ২ হাজার টাকা। আর এই দুই হাজার টাকা দামের স্টিকার গাড়ির সামনে লাগানো থাকলে পুরো একমাস অবৈধ গাড়ি সড়ক দাপিয়ে বেড়ালেও কেউ তাদের গাড়ি স্পর্শ করবেনা। যদি কখনো কেউ গাড়ি আটকও করে তবে সেই গাড়ি ছাড়িয়ে আনার কাজও এই দুই কোম্পানীর।
এই দুই কোম্পানী স্টিকার বিক্রির সময় গাড়ির বৈধ কাগজপত্র এবং ওভারলোড না নেওয়ার শর্ত দিলেও আদতে তাদের স্টিকার ব্যবহারকারী বেশিরভাগ ট্রাকের বৈধ কাগজপত্র থাকে না।
সাতক্ষীরা বাস টার্মিনালের পাশে রউফ সাহেবের মার্কেটে এন পি পরিবহনের অফিস আর এন টি ট্রান্সপোর্টের অফিস শহরের বাঙ্গালের মোড়ের বিশ^াস মার্কেটে। বিষয়টি সর্ম্পকে জানার জন্য সরেজমিনে এন পি পরিবহনের অফিসে গেলে এর ম্যানেজার জানান, ট্রাকে তাদের ব্যানার থাকলে দেশের ৬৪ জেলার ১’শ ৯০ টি পয়েন্টে কোথাও পুলিশ ট্রাক ধরবেনা। কারণ দেশের প্রায় ১’শ ৯০ টি পয়েন্টে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্য, ট্রাফিক পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশের অফিসার ইনচার্জদের প্রতি মাসে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে মাসওয়ারা পাঠায় এন পি মটরস।
তিনি আরো জানান, সাধারণত চালকরা রাতে ছাড়া ট্রাক নিয়ে রাস্তায় বের হতে চান না কারণ পুলিশ দেশের বিভিন্ন পয়েন্টে গাড়ি থামিয়ে ঝামেলা করে। তবে এন পি মটরস এর ব্যানার থাকলে রাতে এবং দিনে ২৪ ঘন্টা ট্রাক চালানো যাবে, পুলিশ ছুয়েও দেখবেনা।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, প্রায় দেড় হাজারের বেশি ট্রাক প্রতি মাসে ২ হাজার টাকা ফি দিয়ে আমাদের ন্যাশনাল পরিবহনের ব্যানারে চলছে। একটি ব্যানার নিয়ে যাতে এক মাসের বেশি কোন ট্রাক চলতে না পারে সেজন্য প্রতিমাসে ব্যানারের ধরণ বদলে ফেলা হয়।
ব্যানার পরিবর্তন হলে পুলিশ কিভাবে জানতে পারবে? এমন প্রশ্নের জবাবে ম্যানেজার বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন করে ব্যানার বদলে ফেলার কথা এবং নতুন ব্যানারের ধরন বলে দেওয়া হয়।
এন পি মটরস এর ব্যানার ব্যবহারের সুবিধা বর্ণনা করে তিনি আরো বলেন, এন পি মটরস এর ব্যানার থাকার পরও যদি দেশের কোন স্থানে পুলিশ মামলা দেয় তাহলে মামলার জরিমানার টাকা পরিশোধ করবে এন পি মটরস।
এন পি মটরস পরিচালনা করেন সাতক্ষীরা শহরে স্বর্ণ চোরাকারবারী হিসেবে পরিচিত জামান এন্টারপ্রাইজের স্বত্ত্বাধীকারী সামছুর জামান, নারকেলতলা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কাদের কাদু, সিয়াম টায়ার হাউজের মালিক কবিরুল ইসলাম কবীর, শ্রমিক নেতা খায়রুল ইসলাম, তরিকুল ইসলাম ও আলমগীর হোসেন।
প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন যাবৎ তারা এই অবৈধ ব্যবসা চালিয়ে মাসে লক্ষ-লক্ষ টাকা আয় করছেন।
এন টি ট্রান্সপোর্টের ব্যানারের মালিক শ্রমিক নেতা আমিনুর ইসলাম ও মিন্টু। সরেজমিনে শহরের বাঙ্গালের মোড়ে তাদের অফিসে গেলে কথা হয় মিন্টুর সাথে।
তিনি জানান, দেশের বিভিন্ন জেলার ১’শ ৭৮টি স্থানের পুলিশকে তারা মাসওয়ারা পাঠান। এজন্য নূর ট্রান্সপোর্টের ব্যানারের স্টিকার ট্রাকের সামনে থাকলে দেশের ১’শ ৭৮ টি স্থানে পুলিশ কোন ঝামেলা করবেনা। তাদের ব্যানারে প্রায় আড়াই’শ ট্রাক রাস্তায় চলাচল করে বলে তিনি তথ্য দেন।
মিন্টু আরও জানান, তাদের ব্যানারের আগের নাম ছিল আলিফ মটরস। বর্তমানে নাম পরিবর্তন করে চলছে এন টি ট্রান্সপোর্টের নামে। এন পি মটরস এর মত তারাও ২ হাজার টাকার বিনিময়ে অবৈধ ট্রাক অবাধে চলাচলের সুবিধা দিয়ে থাকে এবং মোবাইল ব্যাংকিং সুবিধার মাধ্যমে পুলিশের কাছে মাসোয়ারা পাঠায়।
তবে এন টি ট্রান্সপোর্টের মিন্টু আরও একটি ভিন্ন তথ্য দিলেন। কোন ট্রাক মালিক যদি তাদের ব্যানার নিয়ে মাসে ২ হাজার টাকা পরিশোধ না করে। তাহলে দেশের কোথাও সেই ট্রাক চলাচল করতে পারবেনা। কারণ যে সকল ট্রাফিক ও থানা পুলিশ তাদের কাছ থেকে মাসোয়ারা নেয় তাদেরকে ফোন করে টাকা পরিশোধ না করা ট্রাকের নাম্বার জানিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ১’শ ৭৮ টি স্থানের কোথাও না কোথাও ওই ট্রাক আটক করে পুলিশ। পরবর্তীতে পুলিশ ওই ট্রাক ড্রাইভারকে এন টি ট্রান্সপের্টের মালিকদের সাথে ঝামেলা মিটিয়ে গাড়ি ছাড়ার কথা বলেন।
তিনি আরো জানান, আমাদের এই ব্যবসা পরিচালনা করেন ইটাগাছা ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শাহাঙ্গীর হোসেন শাহীন। এছাড়া এমন আরো অনেকে এর সাথে জড়িত যাদের নাম প্রশাসনিক সমস্যার কারণে প্রকাশ করা যাবে না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, সাতক্ষীরার অনেক ট্রাকের বডিতে এন পি মটরস ও এন টি ট্রান্সপোর্টের স্টিকার লাগানো। স্টিকার লাগানো কয়েকটি ট্রাকের চালকদের সাথে কথা হলে তারা বলেন, ওভারলোড, ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন বিহীন ট্রাক হলেও বডিতে ব্যানার থাকলে দেশের প্রায় অধিকাংশ স্থানে পুলিশ কোন রকম ঝামেলা করে না।
তারা আরো বলেন, সব বৈধ কাগজপত্র থাকা শর্তেও যদি আমরা ট্রাকে স্টিকার না লাগায় তবে পুলিশকে দিয়ে এই ট্রান্সপোর্ট ব্যবসায়ীরা বিভিন্নভাবে আমাদেরকে হয়রাণি করে। তাই একরম বাধ্য হয়েই আমরা তাদের স্টিকার ব্যবহার করি।
বর্তমান সরকার যখন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করছেন সে সময় সড়ক পরিবহন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ফিটনেস ও রেজিস্ট্রেশন বিহীন গাড়ি সড়কে নামিয়ে কালো টাকা আয়ের নেশায় মেতেছেন কতিপয় অসাধু ব্যাক্তিরা।
আর এ সুযোগ নিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলেও ট্রাক মালিকরা অপরিপক্ক চালকদের কাছে ট্রাক তুলে দিচ্ছেন ব্যবসার উদ্দেশ্যে। অনেকে আবার এই এন পি মটরস এবং এন টি ট্রান্সপোর্টের সুবিধা নিয়ে অবৈধ মালামাল এমনকি মাদকদ্রব্য পাচার করছেন বলেও গুঞ্জন আছে।
আরো গুঞ্জন আছে এই অবৈধ ব্যবসাকে বৈধতা দিতে সাতক্ষীরা পৌরসভা থেকে ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি চালানোর নামে ট্রেড লাইসেন্স সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠান দুটির কর্তৃপক্ষ।
এসব বিষয়ে জানার জন্য এন পি পরিবহনের পরিচালক সামছুর জামানের কাছে ফোন করলে তিনি বলেন, এন পি পরিবহন নয় এটি এন পি ট্রান্সপোর্ট। এন পি ট্রান্সপোর্ট মালিকদের একটি সংগঠন। এ সংগঠনের মাধমে সারা দেশে আমরা পণ্য পরিবহন করে থাকি।
আপনাদের এই সংগঠন রেজিষ্ট্রেশনভুক্ত কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা মালিকরা মিলে একটি সংগঠন চালায় এর আবার রেজিষ্ট্রেশন থাকবে কেন?
স্টিকারের বিনিময়ে টাকা গ্রহণের বিষয়ে জানতে চাইলে সামছুর জামান মোবাইল ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে মোবাইল বন্ধ করে রাখেন।
এরপর এন পি পরিবহনের পরিচালক শ্রমিক নেতা আব্দুল কাদের কাদু, কবিরুল ইসলাম, এবং খায়রুল ইসলামের ব্যবহারিত মোবাইল নাম্বারে একাধিক বার ফোন দিয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাদের মোবাইল সংযোগ বন্ধ পাওয়া যায়।
এন পি পরিবহনের ব্যপারে এর আরেক পরিচালক তরিকুল ইসলাম ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেন। তিনি একবার বলেন এন পি পরিবহনের কোন সুবিধা নেই আবার বলেন আগে সুবিধা ছিলো।
আগে এনপি পরিবহনের স্টিকার ব্যবহারে কি ধরণের সুবিধা ছিলো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এন পি পরিবহনের স্টিকার দেখলে রাস্তায় পুলিশ সিগন্যাল দেয় না। আমাদের গাড়ি দাড় করায় না।
এ বিষয় এন টি ট্রান্সপোর্ট এর পরিচালক মো. আমিনুর রহমান বলেন, আমরা স্টিকারের বিনিময়ে কোন টাকা নেই না। বরং আমাদের ট্রান্সপোর্টের প্রচারের স্বার্থে আমরা স্টিকার বিভিন্ন গাড়িতে লাগিয়ে থাকি।
শ্রমিক নেতা শাহাঙ্গীর হোসেন শাহীন বলেন, এন টি ট্রান্সপোর্ট নামে আমার কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নেই। তবে কেউ আমার নাম ব্যবহার করে এই নামে ব্যবসা চালাচ্ছে কিনা আমি জানি না।
সাতক্ষীরার পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে সাতক্ষীরায় যদি কেউ কোন সংগঠন বা প্রতিষ্ঠানের নামে এমন বেআইনি কাজ করে থাকে তবে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।