ডেস্ক রিপোর্ট: বিনা কারণে দলবদ্ধ হয়ে রাতে কিংবা দিনে লোহার হাতুড়ি দিয়ে হামলা করে রক্তাক্ত করার কারণে বাহিনীর নাম হয়েছিল ‘হাতুড়ি বাহিনী’। এই বাহিনীর হাতে হাতুড়ি ছাড়াও থাকে লোহার পাইপ শাবল রডও। প্রকাশ্যে দুই একবার বেআইনি অস্ত্রও দেখা গেছে বাহিনীর হাতে। এসব কারণে হাতুড়ি বাহিনীকে অনেকে ডাকেন ‘দমকল বাহিনী’ হিসাবে। কেউ বলেন ‘হেলমেট বাহিনী’ কেউ বলেন ‘হনুমান টুপি বাহিনী’।
সেই হাতুড়ি বাহিনী প্রধান কলারোয়া উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান কাজী আসাদুজ্জামান শাহজাদা এখন পুলিশের খাঁচায় আটক। তিনি কেবল ভাইস চেয়ারম্যানই নন, কলারোয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদকও। একই সাথে কাজী শাহজাদা উপজেলা যুবলীগের সভাপতি। কলারোয়া আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তিনি বেশ প্রভাবশালী। আওয়ামী লীগের স্থানীয় দলীয় বিরোধের জেরে তিনি সময় ও সুবিধামতো পক্ষ পরিবর্তন করেও নিজেকে হাতুড়ি বাহিনী থেকে সরাতে পারেন নি। মাসখানেক আগ পর্যন্তও ছিলেন কলারোয়া উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের সভাপতি ফিরোজ আহমেদ স্বপনের পক্ষে।কিন্তু তাকে কেনো উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারন সম্পাদক করা হয়নি এই কৈফিয়ত তলব করে শাহজাদা তার বাহিনী নিয়ে ফিরোজ আহমেদ স্বপনের ওপর তার বাড়িতে যেয়ে চড়াও হন। তার নেতাকেই তিনি লাঞ্ছিত করেন। এরও কিছুদিন আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন বর্তমানে কলারোয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারন সম্পাদক আমিনুল ইসলাম লাল্টুর পক্ষে। সেবার পক্ষ পরিবর্তন করেন স্বপনের পক্ষে। এভাবে বারবার তিনি স্বপন-লাল্টুর পরস্পর বিরোধী পক্ষ নিয়ে নিজেকে রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এভাবেই ওই দুই নেতার কাছ থেকে সময় বিশেষে আসকারা পেয়ে কাজী শাহজাদা হয়ে ওঠেন কলারোয়ার হোমরা চোমরা। এরই মধ্যে তার বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে জমা হয়েছে এন্তার অভিযোগ। তিনটি মামলার ফেরারি আসামিও তিনি।মঙ্গলবার রাতে কাজী শাহজাদাকে তার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তার বাড়ি থেকে উদ্ধার হয়েছে লাইসেন্সবিহীন ১৪ টি মোটর সাইকেল। নন জুডিসিয়াল স্ট্যাম্প , বিভিন্ন ব্যাংকের চেক।
সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় মোটর সাইকেল পাচার হয়ে থাকে । ভারত থেকে কম টাকায় কেনা অথবা চুরি করে আনা মোটর সাইকেল কলারোয়া সীমান্ত পার করতে পারলেই তার রমরমা মূল্য পাওয়া যায়। এ ধরনের মোটর সাইকেল পাচার পার্টিকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘টানা পার্টি’। শাহজাদা এই টানা পার্টির নেপথ্য শীর্ষ ক্যাডার। তার টানা পার্টি ভারতীয় মোটর সাইকেল পাচারের সাথে জড়িত। শাহজাদার রয়েছে রমরমা সুদের কারবার । গ্রামে পৌরসভায় বহুজনের কাছে টাকা ধার দিয়েছেন চড়া সুদে।ঋণের টাকা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শাহজাদা রানী ব্রিক্স নামের একটি ইটের ভাটা জোর করে লিখে নিয়েছেন মালিক সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে। পাওনা টাকার বিনিময়ে তিনি আটকে রেখেছেন গ্রাহকদের স্বাক্ষরিত অনেক চেক। টাকা না দিলে আটকে রাখতেন তাদের মোটর সাইকেলসহ অন্যান্য সম্পদ। গায় হাত তুলে মারপিট করে মজা করতেন।
কাজী শাহজাদা সাতক্ষীরার কলারোয়ার শীর্ষ চাঁদাবাজ। সহিংসতা ও মারপিট করে চাঁদাবাজি করে আসছেন তিনি। অভদ্রোচিত ব্যবহার ও অসভ্য আচরনের কারণে তার কাছে ঘেঁষতে চায়না কেউ। উপজেলায় কর্মরত সরকারি কর্মকর্তাদেরও নানাভাবে গালিগালাজ করে থাকেন তিনি। তারা তার তদবির ও চাঁদাবাজির ভয়ে অনেকটাই তটস্থ।
কলারোয়ার বিভিন্ন স্থানে জমি দখল করেছেন শাহজাদা। কখনও নিজের জন্য , কখনও অন্যের পক্ষে । রনজিত কুন্ডু নামের এক ব্যক্তির এক বিঘা জমি জবর দখল করে সেখানে টানিয়েছেন ‘শাহজাদা প্লাস্টিক ফ্যাক্টরি’ সাইনবোর্ড। কাজী শাহজাদা কলারোয়া পৌরসভার শোর গাদার বিলে জমি দখল করে ‘শাহজাদা অয়েল মিলস’ সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন। কলারোয়ার কাজিরহাটে কাউরিয়া গ্রামের একজন হাজির কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাকে জমি দখল করে দেবেন বলে। চন্দনপুর বাজারের ভুট্টোর কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়েছেন তাকেও জমি দখল করে দেবেন এই ওয়াদায়। বিদেশে চাকুরি দিয়ে পাঠানোর কথা বলে দুই লাখ টাকা নিয়েছেন এক যুবকের কাছ থেকে। এসব অভিযোগ জমা হয়েছে পুলিশের কাছে। আরও অনেক অভিযোগ সম্পর্কে ভুক্তভোগীরা মুখ খুলছেন না। তবে পুলিশের কাছে গোপনে জমা দিচ্ছেন তারা। তারা নিজেদের নাম পরিচয় গোপন রাখছেন।
হেলমেট বাহিনী প্রধান শাহজাদা মারপিটে বেশ ওস্তাদ। আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যে শাহাজাদা তার বাহিনী নিয়ে এক বছর আগে শেলী নামের এক যুবককে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে ও কুপিয়ে জখম করেন। বিনা কারণে তার মারধর থেকে রক্ষা পাননি পৌর কমিশনার জামিল হোসেন। তার মোটর সাইকেল ভাংচুর করে দেন শাহজাদা। তিনি তার বাহিনী নিয়ে মারপিট করেছেন কলারোয়ার রজনু চৌধুরীকে। স্থানীয় সাংবাদিক পলাশ চৌধুরীকেও লাঞ্ছিত করতে ছাড়েনি তিনি।
শাহজাদার হাতুড়ি বাহিনীতে রয়েছে জনা কুড়ি সদস্য। এই বাহিনী নিয়ে রাতদিন চষে বেড়ানোই তার কাজ। বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন মুরারিকাঠির সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি মোস্তাক আহমেদ। উপজেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সম্পাদক মেহেদী হাসান নাইস, গোয়েন্দা পুলিশ সেজে চাঁদাবাজির মামলার আসামি গ্রেফতার হওয়া ছাত্রলীগের সাবেক সেক্রেটারি শাকিল খান জজ, ছাত্রলীগের হাফিজুর রহমান, যুবলীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহাজাদার বডিগার্ড খ্যাত জিয়াউর রহমান, যুবলীগ নেতা সাবেক ইউপি মেম্বর সাইফুল ইসলাম, শামীম খান, যুবলীগ নেতা মামুন, যুবলীগ নেতা নয়ন, দিয়াড়া ইউপি যুবলীগের বাপ্পি খান, মাসুম, মেহেদী, রুবেল, রুবেল খান, কানা বাদল, জনি ও ঝিকরার ব্রেন লাল্টু। এই বাহিনীর সদস্য নাইস সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তুষারের চার আঙুল ধারালো অস্ত্র দিয়ে কেটে নিয়েছিল। শাকিল খান জজের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা পুলিশ সেজে চাঁদাবাজির মামলা রয়েছে। হাফিজুর রহমান কাজী শাহাজাদাকে ননজুডিশিয়াল খালি স্ট্যাম্প জোগাড় করে দেয়। মেম্বর সাইফুল ইসলাম ভ্যান, ট্রলি, নছিমন, করিমন সহ বিভিন্ন যানবাহন থেকে চাঁদা আদায় করে দমকল বাহিনী প্রধান কাজী শাহাজাদার হাতে তুলে দেয়। অপরদিকে ব্রেন লাল্টু বিভিন্ন ধরনের কুবুদ্ধি দিয়ে এই বাহিনীকে সহায়তা দিয়ে আসছে। এছাড়াও রয়েছে তার পক্ষে তদবিরবাজ কয়েকজন সদস্য।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে হেলাতলা ইউপি মেম্বর নাসিমা খাতুন কাজী শাহজাদার ক্ষমতা দেখিয়ে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগের নাম করে প্রতারনামূলকভাবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বিভিন্নজনের কাছ থেকে। একইভাবে যুগিখালি ইউপির সদস্য তফুরা খাতুন তদবিরবাজি চালিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে এই দুই ইউপি সদস্য কাজী শাহাজাদার সাথে খাতির জমিয়ে নানা ধরনের সহিংসতা, ভূমি ও জমি দখল এবং স্থানীয় বিরোধ মীমাংসার নামে শালিস বিচার বসিয়ে আধিপত্য বিস্তার করে আসছেন। শাহজাদার বাহিনীর সব সদস্যের বিরুদ্ধে রয়েছে চাঁদাবাজি ও সহিংসতার মামলা। তাদের মধ্যে নয়নের বিরুদ্ধে ইয়াবা ব্যবসার অভিযোগ, বাপি খানের নামে চাঁদাবাজি, মোস্তাকের নামে চাঁদাবাজির অভিযোগ। শাকিল খান জজ গোয়েন্দা পুলিশ সেজে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে ধরা পড়ে পুলিশের হাতে। এসব চাঁদাবাজ ও সহিংসতা সৃষ্টিকারীদের নিয়েই পথচলা কাজী আসাদুজ্জামান শাহজাদার। তিনি কারও তোয়াক্কা করেন না। কেউ তার বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ করলেই তাকে মারধরের শিকার হতে হয়।
কাজী শাহজাদা এখন পুলিশ হাজতে। তার সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তবে হাতুড়ি বাহিনীর সদস্য হিসাবে কথিত উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বর্তমান যুবলীগ নেতা মোস্তাক আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন কাজী শাহজাদা আমাদের রাজনৈতিক নেতা। তবে আমি কোনো ধরনের সহিংসতা বা চাঁদাবাজির সাথে জড়িত নই। আমার বিরুদ্ধে কোনো মামলাও নেই। এমনকি যারা হাতুড়ি বাহিনী ও দমকল বাহিনীর সদস্য হিসাবে আমাদের নাম প্রচার করতে চায় প্রকৃতপক্ষে তারাই ওইসব বাহিনীর সদস্য। তিনি বলেন শাহজাদার রাজনৈতিক সঙ্গীদের অনেকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতেই পারে। জানতে চাইলে কলারোয়া উপজেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সাধারন সম্পাদক মেহেদী হাসান নাইস বলেন দমকল বাহিনী ও হাতুড়ি বাহিনীর কথা কানে শুনেছি মাত্র। এ সম্পর্কে আমার কিছু জানাও নেই। এর সাথে আমার কোন সংযোগও নেই। তিনি বলেন আমি ছাত্রলীগ করি। সাবেক ছাত্রলীগ নেতা তুষারের হাত কেটে নেওয়ায় আমি বহিষ্কৃত হইনি, তবে আমার কমিটি বিলুপ্ত হয়েছে। আমার সাথে যুবলীগের কোন সংযোগই নেই।
কলারোয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মুনীর উল গীয়াস বুধবার বলেন প্রাথমিকভাবে কাজী শাহজাদার বিরুদ্ধে ৩ টি মামলার হদিস পাওয়া গেছে। এছাড়া তার বাড়ি থেকে বিপুল পরিমান স্বাক্ষরিত চেক, ননজুডিশিয়াল স্ট্যাম্প এবং কাগজপত্র বিহীন ১৪টি মোটরসাইকেল জব্দ করা হয়েছে। ওসি আরও জানান এসব ছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে অনেক ধরনের অভিযোগ। এসব অভিযোগ নিয়ে তদন্ত চলছে।
লাল রংয়ের প্রাইভেট কার হাঁকিয়ে বেড়ানো শাহজাদার বিরুদ্ধে নালিশের শেষ নেই জানালেন এলাকার বাসিন্দারা। তারা বললেন চাঁদাবাজিই তার নেশা মারপিট আর চাঁদাবাজিই তার পেশা বললেন ভুক্তভোগীরা।
১৬.০১.২০