অর্থনীিতি ডেস্ক: আয়কর ফাঁকি দিতে জাল টিআইএনে (করদাতা শনাক্তকরণ নম্বর) বিলাসবহুল গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। এ রকম অন্তত ১২৬টি গাড়ির খোঁজ পেয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল।
গাড়িগুলোর মধ্যে রয়েছে বিএমডব্লিউ, ভলভো, মার্সিডিজ বেঞ্জ, আউডি, লেক্সাস, জাগুয়ার, হ্যামার, প্রাডো ও হ্যারিয়ার। এসব গাড়ির প্রকৃত মালিকদের খুঁজে বের করার কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
জানা যায়, বর্তমানে প্রায় ৩৭ লাখ গাড়ি বিআরটিএ নিবন্ধিত আছে। কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল সম্প্রতি বিআরটিএ থেকে ১ হাজার ৮২১টি বিলাসবহুল গাড়ির তথ্য সংগ্রহ করে।
এর মধ্যে ৮৯১টি গাড়ির টিআইএন যাচাই করে দেখা গেছে, এর মধ্যে ১২৬টি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে জাল টিআইএন ব্যবহার করে। এসব গাড়ির মালিকরা আয়কর বিভাগে নিবন্ধিত করদাতা নন। অনিবন্ধিত ও জাল টিআইএনধারী গাড়ির মালিকদের আয়কর নথি না থাকায় বিপুল অঙ্কের রাজস্ব ফাঁকি হচ্ছে।
আয়কর অধ্যাদেশে জাল টিআইএন ব্যবহারের জন্য ব্যবহারকারীর ওপর আর্থিক জরিমানাসহ কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। ১২৪এ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি অন্যের টিআইএন অথবা জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা আয়কর আইন অনুযায়ী যেসব ক্ষেত্রে টিআইএন ব্যবহার বাধ্যতামূলক, সেসব ক্ষেত্রে জাল টিআইএন ব্যবহার করলে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে।
অন্যদিকে সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান সেবা দেয়ার সময় টিআইএন ভেরিফিকেশন না করলেও ওই প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা আরোপের বিধান রয়েছে। আয়কর অধ্যাদেশের ১২৪এএ ধারা অনুযায়ী সেবা প্রদানকালে টিআইএন সনদ যাচাই না করলে সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে আয়কর বিভাগ।
১৬৫এ ধারা অনুযায়ী, ইচ্ছাকৃতভাবে যদি কোনো ব্যক্তি জাল টিআইএন ব্যবহার করেন বা অন্যের টিআইএন ব্যবহার করেন, সেক্ষেত্রে ব্যবহারকারীকে সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
এনবিআর সূত্র জানায়, জাল টিআইএনে দামি গাড়ি রেজিস্ট্রেশনে একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। গাড়ি আমদানিকারক থেকে শুরু করে বিআরটিএ’র কর্মকর্তা-দালালদের তৈরি করা এ চক্রের মাধ্যমে নিবন্ধন প্রক্রিয়া চলে। ঘুষ লেনদেনের মাধ্যমে এসব গাড়ির রেজিস্ট্রেশন করা হয়।
নিয়ম অনুযায়ী, গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের জন্য বিআরটিএ’র নির্ধারিত ফরমে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ আবেদন করতে হয়। আবেদন ও সংযুক্ত দলিলগুলো যাচাই-বাছাই করে সঠিক পেলে গ্রাহককে রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দিতে বিআরটিএ থেকে অ্যাসেসমেন্ট স্লিপ দেয়া হয়। ফি জমা হওয়ার পর পরিদর্শনের জন্য গাড়ি বিআরটিএ কার্যালয়ে হাজির করতে হয়।
গাড়ি পরিদর্শনের পর মালিকানা ও গাড়ি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য বিআরটিএ ইনফরমেশন সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর সহকারী পরিচালক (প্রকৌশল) রেজিস্ট্রেশনের অনুমোদন দেন।
রেজিস্ট্রেশনের নম্বর উল্লেখ করে প্রাপ্তি স্বীকারপত্র, ফিটনেস সার্টিফিকেট ও ট্যাক্স টোকেন প্রিন্ট করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরসহ গ্রাহককে দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই টিআইএন সার্টিফিকেট ও অগ্রিম/অনুমিত আয়কর প্রদানের প্রমাণপত্রও লাগে।
এ বিষয়ে রিকন্ডিশন্ড গাড়ি আমদানিকারকদের সংগঠন বারভিডার সভাপতি আবদুল হক যুগান্তরকে বলেন, সব ধরনের গাড়ি রেজিস্ট্রেশনের আগে টিআইএন যাচাই করা উচিত।
জাল টিআইএনে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বন্ধ করতে হলে এনবিআর ও বিআরটিএ’র মধ্যে কো-অর্ডিনেশন বাড়াতে হবে। রাজস্বের স্বার্থে যত দ্রুত সম্ভব এটি করা উচিত। এক্ষেত্রে বারভিডা সব ধরনের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত আছে।
এর আগে কেন্দ্রীয় কর জরিপ অঞ্চল থেকে কোম্পানি বা ব্যক্তিগত নামে রেজিস্ট্রেশন করা ১ হাজার ৮২১টি গাড়ির তথ্য কর অঞ্চলগুলোকে পাঠানো হয়। এসব গাড়ির মালিকের আয়ের উৎস, গাড়ি কেনার অর্থের উৎস, আয়কর ফাইলে গাড়ির তথ্য দেখানো আছে কিনা, করদাতার আর কী কী সম্পদ আছে, ওই সম্পদের সঙ্গে কর ফাইলে দেয়া তথ্য ঠিক আছে কিনা, তা যাচাই করতে বলা হয়।
কর জরিপ অঞ্চল থেকে পাঠানো চিঠিতে সুনির্দিষ্টভাবে গাড়ির ব্র্যান্ডের নাম, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, যার নামে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে তার টিআইএন নম্বর উল্লেখ করা হয়েছে। কর অঞ্চলভিত্তিক পৃথক তালিকা করে ওইসব ব্যক্তির কর ফাইল পুনঃযাচাই করতে এবং কোম্পানির নামে শর্ত মেনে গাড়ি কেনা হয়েছে কিনা তা যাচাই করতে বলা হয়েছে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা মনে করেন, দামি গাড়ি ব্যবহারকারীদের কর ফাইলে দেয়া তথ্য অনেক সময় তাদের আয় ও জীবনযাত্রার মানের সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ হয় না। এ ধরনের গাড়ি ব্যবহারকারীদের যে আয় থাকার কথা, কর ফাঁকি দিতে তা ফাইলে দেখানো হয় না।
আবার অনেকে কর ফাঁকি দিতে নিজে গাড়ি না কিনে কোম্পানির নামে গাড়ি কিনে থাকেন। সেখানেও ঘাপলা রয়েছে। ছোটখাটো অনেক প্রতিষ্ঠানের নামে বিলাসবহুল গাড়ির রেজিস্ট্রেশন রয়েছে। সঠিকভাবে কর নথি যাচাই করা হলে করদাতার প্রকৃত আয়, ব্যয় ও সম্পদের অনেক অজানা তথ্য বেরিয়ে আসবে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে আয়ের উৎস গোপন রাখতে বিত্তশালীরা নিজেদের কোম্পানির নামে গাড়ি কিনে ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহার করেন। সেগুলোও যাচাই-বাছাই করা হবে। এতে রাজস্ব আদায় বাড়বে।