স্বাস্থ্য ডেস্ক: করোনাভাইরাসে মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। কারণ মৃত ব্যক্তি হাঁচি-কাশি দেন না। তবে যিনি বা যারা মরদেহ গোসল করাবেন, তাদের যথেষ্ট সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কারণ মৃতদেহের লালা থেকে গোসল করানো ব্যক্তির দেহে ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও রোগতত্ত্ববিদরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ঝুঁকি এড়াতে করোনায় মৃত ব্যক্তির মরদেহ সৎকারে নির্দিষ্ট একটি গাইডলাইন প্রতিপালনের কথা বলেছে। সে অনুযায়ী করোনায় মৃতদের দাফনের জন্য নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম অনুসরণ করার কথা বলেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর।ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলেছে, করোনায় আক্রান্ত মৃত ব্যক্তির দেহ থেকে সংক্রমণ ছড়ানোর আশঙ্কা নেই বললেই চলে। শুধু মৃত ব্যক্তির ফুসফুস কিছুটা ঝুঁকি তৈরি করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, করোনায় মৃত ব্যক্তির জানাজা ও অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় স্বজনরাও অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে তারা মরদেহ স্পর্শ করতে পারবেন না। আর সামাজিক দূরত্বের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। সংস্থাটি বলেছে, করোনাভাইরাস ছড়ায় মূলত ড্রপলেটের মাধ্যমে, কাছাকাছি এলে এবং মুখের মাধ্যমে। করোনাভাইরাস বায়ুবাহিত জীবাণু নয়। ফলে মরদেহের জীবাণু বাতাসের মাধ্যমে ছড়ানোর সুযোগ নেই। একজন খ্যাতনামা সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, করোনায় আক্রান্ত কারও মৃত্যু হলে মৃতদেহ রোগ ছড়ায় কি ছড়ায় না, সেটা একবাক্যে বলার বিষয় নয়। যেহেতু মৃতদেহ জীবিত মানুষের মতো হাঁচি-কাশি দেয় না, সে কারণে মৃতদেহ থেকে জীবাণু বেরিয়ে আসা সম্ভব না। অতএব, এদিক দিয়ে দেখলে মৃতদেহ জীবাণু ছড়ায় না। কিন্তু মৃতদেহের লালা বা অন্য কোনো ধরনের নিঃসরণ থেকে জীবাণু ছড়াতে পারে। তবে এটা সবার ক্ষেত্রে নয়, যিনি বা যারা মৃতদেহের গোসল করাবেন কিংবা সৎকারের প্রয়োজনে লাশের কাছাকাছি যাবেন, তাদের ক্ষেত্রে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি আছে। এ কারণে মৃতদেহের গোসলের সময় অবশ্যই সাবান পানি ব্যবহার করতে হবে। গোসলের সময় সাবান পানি ব্যবহার করলে নিঃসরণ থেকে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থাকে না। অতএব, কেউ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গেলে আতঙ্কিত হয়ে দাফনে বাধা দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই। কারণ দাফন হয়ে যাওয়ার পর মৃতদেহ থেকে কোনো জীবাণু ছড়ানোর কোনো সুযোগই নেই। অতএব, কবরের পাশ দিয়ে চলাচলেও কোনো সমস্যা নেই।
তিনি বলেন, মৃতদেহ থেকে সংক্রমণের ঝুঁকির চেয়ে জীবিত ব্যক্তির মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর ঝুঁকি নিয়েই সবার বেশি চিন্তাভাবনা করা দরকার এবং সতর্ক থাকা দরকার। তাহলে আর সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে।
আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, করোনায় মৃত ব্যক্তির সৎকারের জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা একটা গাইডলাইন অনুসরণের কথা বলেছে। সে অনুযায়ীই আইইডিসিআরও মৃতদেহ দাফন করার জন্য কিছু পরামর্শ দিয়েছে। করোনায় মৃতদের সৎকার নিয়ে এর আগে প্রকাশিত আইইডিসিআরের নির্দেশনায় বলা হয়, করোনায় আক্রান্ত হয়ে বা সন্দেহভাজন কেউ মারা গেলে মৃতদেহ সরানো, সৎকার বা দাফন শুরুর আগে অবশ্যই কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। সরকারের চার সদস্যের একটি দল সম্পূর্ণ সুরক্ষা পোশাক পরে মৃতদেহ সৎকার বা দাফনের জন্য প্রস্তুত করবে। মৃত্যুর স্থানেই মৃতদেহ প্লাস্টিকের কাভার দিয়ে মুড়িয়ে রাখতে হবে। দলের নেতা মৃত ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের নির্দিষ্ট কোনো অনুরোধ থাকলে তা জেনে নেবেন। কোথায় কবর দেওয়া হবে, সেটিও ঠিক করে রাখতে হবে।
ভাইরাস ছড়িয়ে পড়া রোধে মরদেহ গোসল করানো যাবে না উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়, পরিবারের অনুরোধ থাকলে মরদেহ গোসলের পরিবর্তে তায়াম্মুম বা পানি ছাড়া অজু করানো যাবে। আর পরিবারের পক্ষ থেকে কাফনের কাপড়ের জন্য অনুরোধ থাকলে সেলাইবিহীন সাদা সুতি কাপড় কাফনের কাপড় হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কাফনের কাপড় প্লাস্টিকের ব্যাগে রেখে তার ওপর মরদেহ রাখতে হবে এবং দ্রুত ব্যাগের জিপার বন্ধ করতে হবে। ব্যাগে কাফনের কাপড় দেওয়ার সময় যারা মরদেহ উঁচু করে ধরবেন, তাদের অবশ্যই সুরক্ষা পোশাক পরে থাকতে হবে। সৎকারের জন্য মৃতদেহের সব ছিদ্রপথ (নাক, কান, পায়ুপথ ইত্যাদি) তুলা দিয়ে ভালো করে বন্ধ করে দিতে হবে, যাতে কোনো তরল গড়িয়ে না পড়ে। এরপর দ্রুততম সময়ের মধ্যে মৃতদেহ সমাধিস্থলে নিয়ে যেতে হবে।
পরিবহনে ব্যবহূত গাড়ি সম্পর্কে নির্দেশনায় বলা হয়, পরিবহনে ব্যবহূত গাড়িতে দুটি অংশ থাকতে হবে, যাতে চালক ও পরিবহন কামরার মধ্যে প্রতিরক্ষামূলক কাচ বা প্লাস্টিকের আবরণ থাকে। পরিবহনের পর ব্যবহূত বাহনটি জীবাণুমুক্ত করে নিতে হবে। এ সময় জীবাণুমুক্ত করার কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিকে অবশ্যই প্রতিরক্ষামূলক পোশাক পরতে হবে। দাফনের সময় মৃতদেহ বহনকারী ব্যাগটি কখনোই খোলা যাবে না।
দাফনের পর কবর বা সমাধিস্থল ১০ থেকে ১৫ সেন্টিমিটার গভীর মাটির স্তর দিয়ে ঢাকার পাশাপাশি দাফন করা স্থানের আশপাশ উপযুক্ত জীবাণুনাশক দিয়ে পরিস্কারও করার কথাও বলা হয়েছে এই নির্দেশনায়। এ ছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তি যে স্থানে মারা গেছেন, সেই স্থানটিও যত দ্রুত সম্ভব জীবাণুমুক্ত করা এবং মৃতদেহ দাফনের পর সেই স্থান ভালোভাবে ঘিরে রাখতে বলা হয়েছে।নির্দেশনায় আরও বলা হয়, করোনায় সন্দেহভাজন কারও মৃত্যু হলেও সমান সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আইইডিসিআরে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এসে মৃত ব্যক্তির মুখের লালার নমুনা নিয়ে নিশ্চিত করবেন যে মৃত ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত ছিলেন কিনা।
করোনা আক্রান্ত মৃতদেহ কখনোই ময়নাতদন্ত করা যাবে না উল্লেখ করে নির্দেশনায় বলা হয়, মৃতদেহ পোড়ালেও দেহাবশেষ বা ছাই থেকে করোনাভাইরাস ছড়ায় না।