চলচ্চিত্র মাধ্যমে সত্যজিৎ চিত্রনাট্য রচনা, চরিত্রায়ন, সঙ্গীত স্বরলিপি রচনা, চিত্র গ্রহণ, শিল্প নির্দেশনা, সম্পাদনা, শিল্পী-কুশলীদের নামের তালিকা ও প্রচারণাপত্র নকশা করাসহ নানা কাজ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাণের বাইরে তিনি ছিলেন একাধারে গীতিকার, সংগীত পরিচালক কল্পকাহিনী লেখক, প্রকাশক, চিত্রকর, গ্রাফিক নকশাবিদ ও চলচ্চিত্র সমালোচক।
১৯৩৬ সালে মাত্র চৌদ্দ বছর দশমাস বয়সে তার তোলা ছবি বিদেশি পত্রিকা বয়েজ ওন পেপার-এ প্রথম পুরস্কার পায়। সে বছরই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন সত্যজিৎ। ১৯৪০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শান্তি নিকেতনের কলা ভবনে ভর্তি হন সত্যজিৎ। বলা যায় এখানেই প্রখ্যাত চিত্রকর নন্দলাল বসুর হাতে শিল্পী সত্যজিৎ-এর জন্ম ঘটে।
সত্যজিতের কর্মজীবন একজন বাণিজ্যিক চিত্রকর হিসেবে শুরু হলেও প্রথমে কলকাতায় ফরাসি চলচ্চিত্র নির্মাতা জঁ রনোয়ারের সাথে সাক্ষাৎ ও পরে লন্ডন শহরে সফররত অবস্থায় ইতালীয় নব্য বাস্তবতাবাদী ছবি লাদ্রি দি বিচিক্লেত্তে দেখার পর তিনি চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হন।
চলচ্চিত্র নির্মাণ করবেন- এমন সিদ্ধান্ত তিনি যখন নিয়েছেন তখন তার কাছে প্রিয় গল্প ছিল বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী। অল্প কিছু টাকা যোগাড় করে ১৯৫২ সালে ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের নামে ছবি নির্মাণে নামেন তিনি। তবে টাকার অভাবে সেটা কিছুদিন পরই বন্ধ হয়ে যায়। পরে পশ্চিমবঙ্গ সরকার তাকে আর্থিক অনুদানের ব্যবস্থা করলে পথের পাঁচালীর কাজ শেষ হয়। প্রথম ছবিতেই নিজের জাত চেনালেন সত্যজিৎ। একেবারে বাজিমাৎ যাকে তেমনটি করেছেন তিনি।
তারপর পরবর্তীতে সুনাম কুড়ানো সব ছবি নির্মাণ করেন তিনি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- অপরাজিত, পরশপাথর, জলসাঘর, অপুর সংসার, দেবী, তিনকন্যা, কাঞ্চনজঙ্ঘা, অভিযান, মহানগর, চারুলতা, গুপী গাইন বাঘা বাইন, হীরক রাজার দেশে, অরণ্যের দিনরাত্রি, অশনি সংকেত, সোনার কেল্লা, ঘরে-বাইরে, গণশত্রু, শাখা-প্রশাখা, আগন্তুক।
পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার এই তিনটি চলচ্চিত্রকে একত্রে অপু ত্রয়ী বলা হয়, এবং এই চলচ্চিত্র-ত্রয়ী তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ কাজ বা ম্যাগনাম ওপাস হিসেবে বহুল স্বীকৃত।
সমালোচকেরা প্রায়ই সত্যজিৎকে চলচ্চিত্র ও অন্যান্য মাধ্যমের বিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের সাথে তুলনা করেছেন। তাকে কখনো আন্তন চেখভ, জঁ রনোয়ার, ভিত্তোরিও দে সিকা, হাওয়ার্ড হক্স অথবা কখনো ভোল্ফগাং, আমাদেউস মোৎসার্ট কিংবা শেক্সপিয়ারের সঙ্গেও তাকে তুলনা করা হয়েছে। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী ভি এস নাইপল শতরঞ্জ কে খিলাড়ি-র একটি দৃশ্যকে শেক্সপিয়ারের নাটকের সাথে তুলনা করেন! সত্যজিতের চলচ্চিত্রের নান্দনিকতা নিয়ে যারা সন্তুষ্ট ছিলেন না তারাও স্বীকার করেন যে একটি সম্পূর্ণ সংস্কৃতিকে তার বিভিন্ন সু² দ্যোতনাসহ চলচ্চিত্রে তুলে ধরার ব্যাপারে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়।
সত্যজিৎ রায় নির্মিত প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী ’১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যাদের মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া “শ্রেষ্ঠ মানব দলিল” পুরস্কারটি।
এছাড়া সত্যজিৎ রায়ের বর্ণময় কর্মজীবনে বহু পুরস্কার পেয়েছেন। তবে এগুলির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হল ১৯৯২ সালে পাওয়া একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারটি (অস্কার)।
বাংলা সাহিত্যে সত্যজিৎ রায় একটা বড় জায়গা দখল করে আছেন। বিশেষ করে শিশুতোষ গোয়েন্দা কাহিনী ফেলুনাথ সিরিজ ছেলে-বুড়ো সবার প্রিয়। এছাড়া বিজ্ঞানী প্রফেসর শঙ্কুও সবার কাছেও দারুণ পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছিল। তিনি একাধিক ছোট গল্প লিখেছেন।
চলচ্চিত্রের ওপর লেখা সত্যজিৎ রায়ের প্রবন্ধের সংলনগুলো হল: আওয়ার ফিল্মস, দেয়ার ফিল্মস (১৯৭৬), বিষয় চলচ্চিত্র (১৯৮২), এবং একেই বলে শুটিং (১৯৭৯)। ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সত্যজিতের চলচ্চিত্র বিষয়ক নিবন্ধের একটি সঙ্কলন পশ্চিমে প্রকাশ পায়। এই বইটির নামও ‘ঙঁৎ ঋরষসং, ঞযবরৎ ঋরষসং’।
বাংলা চলচ্চিত্রের এই দিকপাল ১৯৯২ সালের ২৩ এপ্রিল মারা যান।
ছবি : সংগৃহীত