অনলাইন ডেস্ক : প্রশাসনের শীর্ষ পদে অবসরের হিড়িক পড়েছে। ২০২০ সালের শেষ সময়ে প্রশাসনের শীর্ষ অনেক কর্মকর্তারই অবসর শুরু হয়েছে, আগামী দুই মাসেও অনেকে অবসরে যাবেন। তাদের কারো কারো স্থানে আসছে নতুন মুখ, আবার কেউ কেউ চুক্তিতে আরও কিছুটা সময় থেকে যাচ্ছেন।
আগামী দুই মাসে যারা অবসরে যাবেন তাদের মধ্যে আস্থাভাজনরা চুক্তিতে থেকে যাবেন, কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের সচিব কিংবা সংস্থার শীর্ষ পদে নতুন মুখ আসবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শীর্ষ পদগুলোতে নতুন কর্মকর্তারা আসায় প্রশাসনের কাজে গতি আসবে। প্রয়োজনীয়তা ও দক্ষতা বিবেচনা করে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে অল্প সংখ্যককে চুক্তিতে নিয়োগ দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী।
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অসন্তোষও রয়েছে কর্মকর্তাদের মধ্যে। তারা বলছেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পদোন্নতির স্বাভাবিক ধারা ব্যাহত করে, এতে কর্মকর্তাদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়।
এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘সম্প্রতি স্বাভাবিকভাবেই শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা অবসরে যাচ্ছেন। এতে প্রশাসনের কাজে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। আমাদের যে সংখ্যক কর্মকর্তা প্রয়োজন এর চেয়ে অনেক বেশি কর্মকর্তা রয়েছেন। তারা যোগ্য কর্মকর্তা।’
তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত সচিব পর্যায়ে যেসব কর্মকর্তা রয়েছেন তাদের মধ্যে ন্যূনতম সংখ্যক কর্মকর্তা সচিব হন। আমি মনে করি অতিরিক্ত সবাই সচিব সচিব হওয়ার যোগ্য। সুযোগ না থাকায় আমরা তাদের সচিব করতে পারি না।’
কোনো মন্ত্রণালয়ে নতুন কর্মকর্তা আসলে গতিশীলতা বাড়ে জানিয়ে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘অপেক্ষাকৃত ইয়াং সচিবরা ইনোভেটিভ (উদ্ভাবনী) চিন্তার হন, দেশকে এগিয়ে নেয়ার তাড়না তাদের মধ্যে বেশি থাকে। তারা চিন্তা-চেতনায় আধুনিক হন। বয়স্কদের চেয়ে তরুণ সচিবরা সবসময়ই ভালো কাজ করেন। নতুন কর্মকর্তারা আসায় প্রশাসনে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে বলেই আমি মনে করি।’
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘প্রশাসনের শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের অবসরে যাওয়া নতুনদের আসা- এতে প্রশাসনের কর্মকাণ্ডে তেমন কোনো প্রভাবে পড়বে বলে মনে করি না। যারা নতুন আসছেন তারা ইমিডিয়েট নিচের স্তরের কর্মকর্তা। তারা সরকার পরিচালনায় যথেষ্ট দক্ষতা নিয়েই এই স্তরে আসেন।’
‘স্বাভাবিক নিয়মে যারা অবসরে যাবেন তাদের স্থানে যারা আসবেন, তারা আরো ভালো চালানোর চেষ্টা করবেন।’
বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের দায়িত্ব চালিয়ে আসা মো. মহিবুল হকের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ আগামী ৫ জানুয়ারি শেষ হবে। গত ২৪ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোকাম্মেল হোসেনকে পদোন্নতি দিয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
৩১ ডিসেম্বর অবসরে যাচ্ছেন ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মাকছুদুর রহমান পাটোয়ারী। ভূমি মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব হয়েছেন ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার (অতিরিক্ত সচিব) মো. মোস্তাফিজুর রহমান। গত ২৪ ডিসেম্বর মোস্তাফিজুর রহমানকে সচিব পদে পদোন্নতির পর এ নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) আবুল কালাম আজাদ ৫ জানুয়ারি অবসরে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে অর্থ বিভাগে সংযুক্ত অতিরিক্ত সচিব রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাসকে সচিব পদে পদোন্নতি দিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) করা হয়েছে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. মোস্তফা কামাল সচিব পদে পদোন্নতি পেয়ে হন ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব)। ভূমি সংস্কার বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) মো. ইয়াকুব আলী পাটোয়ারী ৩১ ডিসেম্বর অবসরে গেছেন।
এর আগে গত ১৭ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত অবসরে যান। গত ১০ ডিসেম্বর খুলনার বিভাগীয় কমিশনার মুহা. আনোয়ার হোসেন হাওলাদারকে দুদকের সচিব নিয়োগ দেয়া হয়।
গত ২৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) খাজা মিয়াকে পদোন্নতি দিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়। ২৮ নভেম্বর চাকরির মেয়াদ শেষ হয় তথ্য সচিব কামরুন নাহারের।
ডিসেম্বর মাসে মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সংস্থার শীর্ষ পদের কর্মকর্তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ায় তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘সচিব হওয়ার যোগ্যতা নিয়ে অনেক অতিরিক্ত সচিব অবসরে যান। সচিব পদ খুব বেশি নেই। এর মধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হলে বঞ্চনা আরো বাড়ে।’
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগও হচ্ছে, সেটা নিয়ে আবার সমালোচনা ও অসন্তোষও আছে- এ বিষয়ে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, ‘কর্মকর্তাদের কর্মদক্ষতা দেখে প্রধানমন্ত্রী চুক্তি দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করেন। যোগ্যরাই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান। যোগ্য না হলে তাকে কন্ট্রাক্ট দেয়া হয় না।’
‘অনেক কর্মকর্তা অবসরে যাচ্ছেন, কই সবাইকে তো কন্ট্রাক্ট দেয়া হচ্ছে না। যারা চুক্তিতে নিয়োগ পাচ্ছেন, তারা যোগ্য বলেই পাচ্ছেন। কোনো একটি মন্ত্রণালয়ে হয়তো বিশেষ একটি কাজ চলে, ওই কাজ সম্পর্কে ওই সচিব পুরোটাই জানেন, তিনি অবসরে গেলে হঠাৎ করে যদি অন্য একজন কর্মকর্তাকে সেখানে সচিব করা হয়, তার সবকিছু বুঝতে একটু সময় লাগবে। সেজন্য রাষ্ট্রের স্বার্থে ও জনগণের প্রয়োজনে ওই সচিবকে হয়তো চুক্তি দেয়া হয়। সেই সংখ্যাও নগণ্য।’
জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে আরো ১০ জনের মতো সচিব অবসরে যাচ্ছেন জানিয়ে শেখ ইউসুফ হারুন বলেন, ‘যারা অবসরে যাচ্ছেন বেশির ভাগই নতুন মুখ থাকবে। কাউকে কন্ট্রাক্ট দিতে হলে সেই বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীই সিদ্ধান্ত দেবেন। কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাদের সবাইকে মূল্যায়ন করেন। কোন সচিব কেমন কাজ করেন, কার সততা ও দক্ষতা কেমন- তা প্রধানমন্ত্রী জানেন। এসব বিচার করে প্রধানমন্ত্রী যেটি ভালো মনে করবেন সেটিই করবেন।’
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ‘সরকার যাকে অপরিহার্য মনে করে তাকে কন্ট্রাক্ট দেয়। এটা নতুন নয়। এটা আগেও ছিল, এখনো আছে। তবে এটা (চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ) যত কম হয় তত ভালো।’
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের চুক্তির মেয়াদ আগামী ১৫ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। গত ৮ ডিসেম্বর তার চুক্তির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানো হয়।
চুক্তিতে আরো দুই বছর প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব থাকছেন ড. আহমদ কায়কাউস। তার অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) ও এ সংশ্লিষ্ট ছুটি স্থগিতের শর্তে এই নিয়োগ দিয়ে গত ২৪ ডিসেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ জারি করা হয়।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব মো. আলী নূর চুক্তিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। গত ২৪ ডিসেম্বর তাকে এই নিয়োগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চাকরির মেয়াদ শেষে আগামী ৫ জানুয়ারি আলী নূরের অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. সেলিম রেজাও চুক্তিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ পেয়েছেন। গত ২৮ ডিসেম্বর এই চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পান তিনি। ৩০ ডিসেম্বর তার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলমের মেয়াদ ৩০ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। গত ২৪ ডিসেম্বর তাকে চুক্তিতে আরো দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে সরকার।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. কাজী দীন মোহাম্মদের চুক্তির মেয়াদ তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ ১১ জানুয়ারি শেষ হওয়ার কথা ছিল।
এছাড়া মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক কাজী শামস আফরোজের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর শেষ হওয়ার কথা ছিল। তাকেও চুক্তিতে এক বছরের জন্য নিয়োগ দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, আগামী ১২ জানুয়ারি জ্বালানি ও বিদ্যুৎ গবেষণা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান (সচিব) সুবীর কিশোর চৌধুরী ও ১৪ জানুয়ারি পরিকল্পনা কমিশনের সচিব মো. আসাদুল ইসলাম অবসরে যাচ্ছেন। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর পিআরএলে যাবেন ২ ফেব্রুয়ারি, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সিনিয়র সচিব এন এম জিয়াউল আলমের চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি।
এছাড়া ১৫ ফেব্রুয়ারি অবসরে যাবেন পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) মো. জাকির হোসাইন আকন্দ। ২৮ ফেব্রুয়ারি চাকরির মেয়াদ শেষ হচ্ছে নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আক্তার ও ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান (সচিব) উম্মুল হাছনার। ৩ মার্চ অবসরে যাচ্ছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেবা সুরক্ষা বিভাগের সচিব মো. শহিদুজ্জামান।