অনলাইন ডেস্ক : শিক্ষানীতি অনুযায়ী দেশের শিক্ষার স্তর হবে তিনটি। কিন্তু আপাতত বিদ্যমান পাঁচটি স্তরে ছাত্রছাত্রীদের লেখাপড়া চলবে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসার শিক্ষকরা কোচিং-টিউশনি করতে পারবেন না। প্রকাশ করা যাবে না নোট-গাইড। তবে সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ ও বাজারজাত করা যাবে।
পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং এর আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর কোনো সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া প্রকাশ করতে পারবে না। যদি মুদ্রণ ও প্রকাশ করতে চায় তবে গণমাধ্যমকে সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমোদন নিতে হবে। ব্যবসায়িকভাবে পরিচালিত সব ধরনের কোচিং সেন্টার নিবন্ধন নিয়ে চালানো যাবে।
এমন বিধানসহ শিক্ষা আইন-২০২১ এর খসড়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এটি চূড়ান্ত করতে আজ বেলা ৩টায় বৈঠক বসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে। শিগগিরই অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। বর্তমানে দেশে সম্মিলিত কোনো শিক্ষা আইন নেই। সম্প্রতি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছেন, শিক্ষা আইন চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। জানতে চাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরির কাজে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো যাবে।
আইনে পাঁচ স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে- প্রথম শ্রেণির আগে প্রাক-প্রাথমিক, পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক, দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি উচ্চ মাধ্যমিক এবং এরপরে উচ্চশিক্ষা স্তর। তবে এখন যে স্তরই চালু থাকুক না কেন সরকার শিক্ষার স্তর (প্রাথমিক ও মাধ্যমিক) পুনর্নির্ধারণ করতে পারবে বলে প্রস্তাবিত আইনে উল্লেখ আছে। ২০১০ সালে সংসদে পাস করা শিক্ষানীতিতে প্রাক-প্রাথমিক বাদে তিন স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের কথা বলা আছে। ড. কুদরত-এ-খুদা কমিশনের প্রতিবেদনেও অনুরূপ সুপারিশ ছিল।
আইনে সব শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব আছে। এটা শিশুর মৌলিক অধিকার হিসাবে গণ্য হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে দেশের মধ্যে চালু সব ধারায় অভিন্ন পাঠ্যপুস্তক বাধ্যতামূলকভাবে পড়ানো হবে। এ পাঠ্যপুস্তক, এর শিক্ষাক্রম ইত্যাদি তৈরি ও প্রকাশ করবে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)।
বিদেশি শিক্ষাক্রমের আওতায় (ইংরেজি মাধ্যমসহ অন্য মাধ্যম) পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে সরকার নির্ধারিত বিষয়ও বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। এর ব্যত্যয় ঘটালে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকার একটি জাতীয় শিক্ষাক্রম নীতিকাঠামো (ন্যাশনাল কারিকুলাম পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক) প্রণয়ন করবে। এতে বিদ্যমান প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও অষ্টম শ্রেণিতে চলমান পরীক্ষা (পিইসি ও জেএসসি) সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। বাংলা ভার্সন ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টিউশনসহ সব ফি সরকার ঠিক করে দেবে। অনুমোদন ছাড়া ফি আদায় করা যাবে না।
সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রস্তাবিত আইনে কোচিং সেন্টার এবং নোট-গাইড সংক্রান্ত বিধান ১৮০ দিন পর কার্যকর হবে। ইতঃপূর্বে প্রস্তাবিত আইনে ৯০ দিন পর কার্যকরের প্রস্তাব ছিল। এতে নোট-গাইডের পরিবর্তে বর্তমানে প্রকাশিত ‘সহায়ক গ্রন্থ’ (রেফারেন্স বুক) এবং সব ধরনের কোচিং সেন্টারকে বৈধতা দেয়া হয়েছে। তবে উভয়টিই শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে পূর্বানুমোদনক্রমে পরিচালনা ও প্রকাশ করা যাবে। সংবাদপত্র বর্তমানে শিক্ষাপাতায় ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের অনুশীলনমূলক পাঠ (কনটেন্ট) প্রকাশ করছে। এটা প্রকাশ করতে হলেও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পূর্বানুমোদন নিতে হবে।
‘নোট-গাইড’ বলতে সরকার অনুমোদিত সহায়ক পুস্তক বাদে পাঠ্যবইয়ের বিষয়বস্তুর আলোকে পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর লেখা থাকে যেসব পুস্তকে এবং যা বাণিজ্যিকভাবে বিক্রির জন্য প্রকাশ করা হয়ে থাকে। এসব গ্রন্থ প্রকাশ নিষিদ্ধ। বিধানের লঙ্ঘন করা হলে তিন বছরের কারাদণ্ড, ৫ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড দেয়া যাবে। আর সরকারের অনুমোদিত সহায়ক গ্রন্থ প্রকাশ হলেও তা পাঠে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা শিক্ষক বাধ্য করতে পারবে না শিক্ষার্থীদের।
এমন কাজ অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। জনসংখ্যার ঘনত্বসহ ৭টি কারণে সরকার প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষার স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন বা পুনঃস্থাপন করতে পারবে। আবার প্রয়োজন না থাকলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত, একীভূত (অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে) বা স্থানান্তর করা যাবে। মন চাইলেই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা যাবে না।
নিতে হবে সরকারের পূর্বানুমতি। দেশের ভেতরে চালাতে হলে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন থাকতে হবে। নিবন্ধিত ট্রাস্ট বা সংস্থা সরকারের অনুমোদনক্রমে প্রতিষ্ঠান স্থাপন করলেও এর আলাদা ব্যাংক হিসাব থাকতে হবে। কোনোক্রমেই প্রতিষ্ঠানের আয়ের টাকা সংস্থা, ট্রাস্ট বা অন্যত্র স্থানান্তর করা যাবে না।
কোচিং সংক্রান্ত ৩০ নম্বর বিধানে উল্লেখ আছে, কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট-টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতেও প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণ বলে গণ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হবে। তবে পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি সাপেক্ষে স্কুল সময়ের পরে বা আগে সরকার কর্তৃক প্রণীত বিধি বা নীতিমালা অথবা জারিকৃত পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণপূর্বক অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
আইনে ভর্তি, চাকরি, ও-এ লেভেল, আইইএলটিএ-জিআরইসহ বিভিন্ন ধরনের বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারকে বৈধতার প্রস্তাব করা হয়েছে। পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতাকেও বৈধ করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে শর্ত আরোপ করা হয়েছে। তা হচ্ছে-
এক. শিক্ষক তার নিজের শিক্ষার্থীকে নিজের কোচিং সেন্টারে নিতে পারবেন না। করলে তা অসদাচরণের অপরাধে শাস্তিপ্রাপ্ত হবেন।
দুই. শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চলাকালীন সময়ে কোচিং সেন্টার কার্যক্রমে অংশ নিতে পারবে না। করা হলে উক্ত কোচিং সেন্টারের অনুমোদন ও নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। এছাড়া কোচিংয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া যাবে।
তিন. এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে হবে নিবন্ধন নিয়ে।
চার. নিবন্ধন করতে হবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আইনের অধীনে। একই প্রতিষ্ঠানে দেশি এবং বিদেশি কারিকুলামে পাঠদান করা যাবে না। শেষের দুটি লঙ্ঘন করলে তিন বছরের কারাদণ্ড, ১০ লাখ টাকা জরিমানা এবং উভয় দণ্ড দেয়া যাবে।
খসড়ায় উচ্চ শিক্ষার স্তরের প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ৫টি ধারা আছে। এগুলোর মধ্যে সংজ্ঞা, সরকার প্রদত্ত অনুদান, শিক্ষার্থীদের বেতন, ফি, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন এবং শিক্ষক নিয়োগের বিধান আছে। সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বেতন ও অন্যান্য ফি সরকার বা সরকার কর্তৃক নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে নির্ধারণ করবে। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষার্থী মূল্যায়ন অভিন্ন গ্রেডিং পদ্ধতিতে হবে। নির্ধারিত নিয়োগবিধির আলোকে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের মান নির্ণয় করবে সরকার।
শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক শাস্তির ওপর বিধিনিষেধ এবং শিক্ষক সুরক্ষার বিধান যুক্ত করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের সাময়িক পরীক্ষা এবং ধারাবাহিক পদ্ধতিতে মূল্যায়নের অধীনে আনা হবে। পরীক্ষায় নকলে সহায়তা করা এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও এতে সংশ্লিষ্টতা দণ্ডনীয় অপরাধ। এ ধরনের অপরাধের জন্য ২ বছর কারাদণ্ড অথবা দুই লাখ টাকা দণ্ড অথবা উভয়দণ্ড দেয়া যাবে। নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগ করা যাবে, যা সংশ্লিষ্ট আইন দ্বারা পরিচালিত হবে। কোনো শিক্ষক নৈতিকতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার শিক্ষক নিবন্ধন বাতিল করা যাবে। জাল সনদে চাকরি নিলে তা ১৮৬০ সালের আইনের অপরাধ বলে গণ্য হবে।
সরকার মনে করলে সব ধরনের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বা তদূর্ধ্ব পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানে প্রধান শিক্ষক ও অধ্যক্ষ তিন বছরের জন্য নিয়োগ দিতে পারবে। এছাড়া সরকার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের মধ্য থেকেও একই ধরনের পদে নিয়োগ দিতে পারবে।
এতে নয়টি কারণে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমপিও আংশিক বা সম্পূর্ণ সাময়িকভাবে বন্ধ ও কর্তন এবং বাতিলের কথা বলা হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনা কমিটি এর চেয়ারম্যান কার্যপরিধির বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এবং এ কারণে কোনো অনিয়ম বা পাঠদান বাধাগ্রস্ত হলে কমিটি সার্বিকভাবে বা ক্ষেত্রমতে চেয়ারম্যান দায়ী হবেন। এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ উক্ত কমিটি বাতিল বা ক্ষেত্রমতো চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে পারবে। সূত্র:যুগান্তর