খুলনা প্রতিনিধি : খুলনা স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালক রাশেদা সুলতানা। দুই বছরেরও বেশি সময় আগে খুলনায় যোগদানের পর থেকেই সপরিবারে থাকছেন খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের রেস্টরুমে। দীর্ঘ এ সময় ধরে রেস্টরুম ব্যবহার করলেও তার জন্য কোনো ভাড়া দেন না রাশেদা সুলতানা। অথচ প্রতি মাসে বাসাভাড়া ভাতা হিসেবে ৩২ হাজার টাকা করে উত্তোলন করেন সরকারের তহবিল থেকে। খুলনায় দায়িত্ব পালনকালে রেস্টরুমের ভাড়া ও আনুষঙ্গিক খরচসহ প্রায় ৬ লাখ টাকা সরকারি তহবিলে জমা দেননি স্বাস্থ্য বিভাগের ঊর্ধ্বতন এ কর্মকর্তা।
এদিকে রাশেদা সুলতানা গেস্টরুম আটকে রাখায় ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সিভিল সার্জন কার্যালয়কে। ওই কার্যালয় সংশ্লিষ্ট কাজে অন্যান্য জেলা থেকে কোনো কর্মকর্তারা এলে তাদের বিকল্প কোনো জায়গায় রাখতে গলদঘর্ম হতে হচ্ছে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের। আর শুধু রেস্টরুম ব্যবহারই নয়, ভবনটির একটি সেমিনার কক্ষও রাশেদা সুলতানা প্রায়ই বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, খুলনা নগরীর বড় মির্জাপুরের সামসুর রহমান সড়কের শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের (স্কুল হেলথ ক্লিনিক) দুই তলায় খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের ‘রেস্টরুম’ রয়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের কাজে কোনো কর্মকর্তা খুলনায় এলে তাদের সেখানে অবস্থান করার কথা। অবশ্য তার জন্য ভাড়া দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। এখানে দুটি কক্ষ ও একটি রান্নাঘর রয়েছে। একটি কক্ষের সঙ্গে একটি শৌচাগার (বাথরুম) ও রান্নাঘর রয়েছে। দুই কক্ষে রয়েছে দুটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি)। একটি কক্ষের দিনপ্রতি ভাড়া ৩০০ টাকা। সেই অনুযায়ী দুটি কক্ষের ভাড়া হয় ৬০০ টাকা। এ ভাড়া দিয়ে রেস্টরুমের সব ব্যয় নির্বাহ করা হয়। সিভিল সার্জনের সভাপতিত্বে একটি কমিটি (সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সবাই সদস্য) এটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে।
রাশেদা সুলতানা খুলনা বিভাগের ঝিনাইদহ জেলা থেকে ২০১৯ সালের ৩০ মার্চ খুলনায় স্বাস্থ্য পরিচালক হিসাবে যোগ দেন। সেই দিন থেকেই তিনি পরিবার নিয়ে এই রেস্টরুমে বসবাস শুরু করেন। শুধু তাই নয়, স্বাস্থ্য পরিচালকের কোনো আত্মীয়স্বজন এলে তাদেরও এখানে রাখা হয়। যদিও এর জন্য তিনি কোনো প্রকার ভাড়া দেন না। এটা আইনসংগত না হলেও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার আদেশ রাখতে সিভিল সার্জনরা অনেকটা বাধ্য হয়ে চুপ থাকেন।
রাশেদা সুলতানা এ পর্যন্ত সঠিক নিয়মে রেস্টরুমের ভাড়া দিলে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ভাড়া হিসেবে সরকারি কোষাগারে জমা হতো। তাছাড়া বিদ্যুৎ বিল (এসিসহ) ও রেস্টরুমের রক্ষণাবেক্ষণবাবদ আরও প্রায় প্রায় দেড় লাখ টাকা উল্লিখিত সময়ে ভাড়ার সঙ্গে যোগ হওয়ার কথা। কিন্তু কোনো টাকাই দেন না রাশেদা সুলতানা। উপরন্তু বিদ্যুৎ বিল (এসিসহ) ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও সিভিল সার্জন কার্যালয়কে বহন করতে হয়। অথচ সরকারি চাকরির নীতিমালা অনুযায়ী প্রত্যেক চাকুরেকে নিজ কর্মস্থলে থাকার জন্য আবাসন ভাতা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী প্রতি মাসে ৩২ হাজার টাকা করে বাসাভাড়া ভাতা উত্তোলনও করেন রাশেদা সুলতানা।
খুলনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী জানান, রাশেদা সুলতানা গেস্টরুম আটকে রাখায় বিভিন্ন সময়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। সিভিল সার্জন কার্যালয় সংশ্লিষ্ট কাজে অন্যান্য জেলা থেকে কোনো কর্মকর্তারা এলে তাদের সার্কিট হাউস বা জেলা পরিষদের রেস্টহাউজে রাখতে হয়। অনেক সময় ওইসব কর্মকর্তার জন্য জরুরি প্রয়োজনে থাকার জায়গার সংকুলান করতে না পেরে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সিভিল সার্জন কার্যালয়কে। একই অবস্থা হয় ঢাকা থেকে আসা কোনো কর্মকর্তার বেলায়ও।
এদিকে শুধু ভাড়া ফাঁকিই নয়, শিশু স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের একটি সেমিনার কক্ষও রাশেদা সুলতানা প্রায়ই বিনা ভাড়ায় ব্যবহার করেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কক্ষের এক দিনের ভাড়া ১ হাজার ৫০০ টাকা। ওই কক্ষে বিভিন্ন সেমিনার ও সভা করেন রাশেদা। যা সিভিল সার্জন কার্যালয় সংশ্লিষ্ট নয়, এমনকি স্বাস্থ্য বিভাগ সংশ্লিষ্ট নয় এমন অনুষ্ঠানও মাঝেমধ্যে সেখানে করে থাকেন। আর এসব অনুষ্ঠানের জন্য রাশেদা কোনো ভাড়াই দেন না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ম্যাডাম (রাশেদা সুলতানা) একজন বড় কর্মকর্তা। ভাড়া না দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করলেও আমাদের কিছু করার নেই। তিনি এভাবে থাকায় আমার কার্যালয়ের গেস্টদের অন্য জায়গায় রাখতে হয়। সবাই সব জানে, কিন্তু আমরা অসহায়। নিয়ম অনুযায়ী তাকে বাসা নিয়ে থাকতে হবে। তার জন্য সরকার তাকে ঘরভাড়াও দেয়। তিনি ঘরভাড়া নিচ্ছেন, কিন্তু ঘরভাড়া দিচ্ছেন না। তার বিরুদ্ধে কথা বলে কে চাকরি হারাবে?’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) খুলনা জেলার সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী কুদরত-ই-খুদা বলেন, ‘একজন সরকারি কর্মকর্তা নিয়ম অনুযায়ী দুটি সুযোগ নিতে পারে না। এটা ক্ষমতার অপব্যবহার। সম্পূর্ণ অবৈধ ও দুর্নীতির শামিল। এটা হওয়া উচিত নয়।’
অন্যদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর খুলনা শাখার সাবেক সভাপতি শিক্ষাবিদ আনোয়ারুল কাদির বলেন, ‘সিভিল সার্জন বলছেন গেস্টরুম আছে আর ম্যাডাম বলছেন নেই। গেস্টরুম যদি ব্যবহারযোগ্য না থাকে তাহলে ওনার মতো একজন হাই অফিশিয়াল দিনের পর দিন আর মাসের পর মাস থাকেন কীভাবে? বিদ্যুৎ বিলটাও তিনি বহন করছেন না! সিভিল সার্জনও এই দায় নিচ্ছেন না। আমাদের জিজ্ঞাসা তাহলে এই দায়টা কার?’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খুলনার সিভিল সার্জন নিয়াজ মোহাম্মদ বলেন, ‘আমি এখানে কয়েক মাস আগে যোগদান করেছি। এখানে একটি গেস্টরুম আছে বলে জেনেছি। ওখানে যে গেস্টরা থাকবেন তাদের ভাড়ার টাকা থেকে মূলত ওই গেস্টরুমের রক্ষাবেক্ষণসহ সব ব্যয় বহন করা হয়। এখন আরও খোঁজখবর নিয়ে ও ম্যাডামের সঙ্গে আলোচনা করে এর একটি সুরাহা করার চেষ্টা করবো।’
ভাড়া না দিয়ে গেস্টরুম দখলে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘গত ডাইরেক্টররাও (খুলনা স্বাস্থ্য দপ্তরের পরিচালক) এখানে থাকতেন। এর আগের সিভিল সার্জন রাজ্জাক সাহেব আমাকে এখানে থাকতে দিয়েছিলেন। সেই হিসাবেই থাকছি। পরবর্তী সময়ে করোনা এসে গেল। তাছাড়া আজ পর্যন্ত আমি কোনো রেজল্যুশন পাইনি যে এ জায়গাটি একটি গেস্টরুম। আমাদের সরকারিভাবে থাকার কোনো জায়গা নেই। রেস্টরুমের ভাড়ার তো নির্দিষ্ট তালিকা নেই। তাহলে কীভাবে ভাড়া কাটব? তাছাড়া রুমটির অবস্থা বেশ খারাপ। আমি কয়েকবার এর কাজ করিয়েছি।’
সরকারের তহবিল থেকে মাসে মাসে বাসাভাড়া ভাতা উত্তোলন করলেও রেস্টরুমের ভাড়া না দেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ওটা তো (রেস্টরুম) আর বাসা নয়, তাহলে কীভাবে আমি বাসা ভাড়া দেবো?’
আর বিদ্যুৎ বিল পরিশোধের বিষয়ে রাশেদা সুলতানা বলেন, ‘ভবনের নিচতলায় কোল্ডস্টোরেজ (যেখানে করোনার টিকাসহ সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সকল প্রকার ভ্যাকসিন রাখা হয়) রয়েছে। সেই রুমের মিটারের সঙ্গে আমার রুমের বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া। ফলে ওই বিলের সঙ্গে আমার বিল পরিশোধ হয়।’