অনলাইন ডেস্ক : নতুনভাবে গঠন করা হবে হেফাজতে ইসলাম। সংগঠনে থাকবে না কোনো রাজনৈতিক নেতা। কাজ করবে সরকারের সঙ্গে সমন্বয় করে। সরকারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বৈঠকে এমন আশ্বাস দিয়েছেন কারাগারের বাইরে থাকা হেফাজতের শীর্ষনেতারা। সমঝোতা করতে এবং নিজেদের অবস্থান জানাতে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) সঙ্গে বৈঠক করেন হেফাজতের শীর্ষনেতারা। সেখানে নেতারা এমন আশ্বাস দেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
হেফাজতের একজন শীর্ষনেতা নাম প্রকাশ না করে বলেন, পুলিশের বিশেষ শাখার সঙ্গে বৈঠকে হেফাজত জানায় যে, মোদিবিরোধী আন্দোলন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সোনারগাঁসহ বিভিন্ন স্থানে নাশকতার ঘটনায় হেফাজতের কৌশলগত কিছু ভুল ছিল। তবে নাশকতার উস্কানিদাতারা হেফাজতের কেউ নন।
বৈঠকে বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ-এসবি) ঊর্ধ্বতনরা বলেন, ২০১০-এ হেফাজতে ইসলাম অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। তবে হেফাজতের আমির আল্লামা শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর পর তারা একটি রাজনৈতিক সংগঠনে রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা হেফাজতের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগর কমিটিতে রয়েছেন এবং তারা রাজনৈতিকভাবে আন্দোলন চালাচ্ছেন।
হেফাজতের ওই নেতা জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বৈঠকে তারা হেফাজতকে সংস্কারের কথা বলেছেন। তারা হেফাজতের সব কমিটি থেকে রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যক্তিত্বদের সরিয়ে নতুন কমিটি দিতে বলেছে। পাশাপাশি কওমি মাদ্রাসা কার্যক্রম পরিচালনা ‘আল-হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’ বোর্ডের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরিচালনার কথা বলেছে। হেফাজত যেন কওমি মাদ্রাসার কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে পারে সে বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলেছে।
সূত্র জানায়, হেফাজতের বর্তমান কমিটি যেকোনো সময় ভেঙে দেওয়া হতে পারে। ইতোমধ্যে হেফাজতের কমিটি আল্লামা শফীর যোগ্য উত্তরসূরি খুঁজতে শুরু করেছে।
এদিকে, শীর্ষ ১২ নেতাসহ একাধিক সমর্থক গ্রেপ্তার হওয়ার পর চাপে পড়া হেফাজতের নেতারা গ্রেপ্তার এড়াতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন সোমবার (১৯ এপ্রিল) রাতে। সভায় তারা সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার না করার অনুরোধ জানান। তবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাদের বলেছেন, পুলিশ অভিযুক্তদের গ্রেপ্তার করছে, নিরীহ কাউকে নয়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্র জানায়, তারা সাম্প্রতিক নাশকতার জন্য প্রায় ৪৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এছাড়াও হেফাজতের মধ্যে থেকে যেসব রাজনৈতিক নেতা সরকার উৎখাতের উদ্দেশ্যে নাশকতা করেছেন তাদের তালিকাও তৈরি করা হয়েছে। খুব শিগগিরই তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।
দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ রয়েল রিসোর্টে নারীসহ ধরা পড়া মামুনুল হককে নিয়ে হেফাজতে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়েছিল। সংগঠনটির শীর্ষনেতারা এ বিষয়ে হেফাজতে ইসলামের আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে পরামর্শ করে মামুনুলকে নিয়ে মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসায় সালিশে বসেন।
রিসোর্টকাণ্ডে মামুনুল কেন হেফাজত ও আলেমসমাজের মুখে কালিমা লেপন করেছেন, সে বিষয়ে তাকে প্রশ্নের মুখোমুখি করা হয়। তখন মামুনুল সবাইকে বলেন, জান্নাত আরা ঝর্ণা নামে রিসোর্টের ওই নারী তার দ্বিতীয় স্ত্রী। তিনি শরিয়াহ মোতাবেক তাকে বিয়ে করেছেন। বিয়েতে সাক্ষীসহ মোট তিনজন উপস্থিত ছিলেন। হেফাজতের নেতারা মামুনুলকে ওই তিন সাক্ষীকে তাৎক্ষণিক উপস্থিত করার নির্দেশ দেন। মামুনুল তখনই তাদের সবার সামনে সাক্ষীদের ডাকেন এবং সাক্ষীরা মামুনুলের বিয়েতে উপস্থিত থাকার কথা স্বীকার করেন।
তখন হেফাজতের নেতারা তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তাহলে কেন মামুনুল ফোনে তার প্রথম স্ত্রীকে বললেন যে, উনি এক মাওলানার স্ত্রী? উত্তরে মামুনুল জানান, তার প্রথম স্ত্রী তাকে খুব ভালোবাসেন, সে প্রচণ্ড আবেগী। হঠাৎ দ্বিতীয় বিয়ের কথা শুনলে প্রথম স্ত্রীর হার্ট অ্যাটাকের সম্ভাবনা ছিলো। এ কারণে তাকে সেসময় সামাল দেওয়ার জন্য অন্যের স্ত্রী বলেছিলেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একজন দায়িত্বশীল সদস্য বলেন, সালিশে হেফাজতের নেতারা মামুনুলের যুক্তি বিশ্বাস করে তাকে সাংগঠনিকভাবে সবধরনের সহযোগিতার আশ্বাস দেন। তবে একের পর এক ফাঁস হওয়া ফোন রেকর্ড এবং মামুনুলের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগে বিরক্ত হয়ে তাকে আর সহযোগিতা না করার সিদ্ধান্ত নেন তারা।
মামুনুল হক বর্তমানে মোহাম্মদপুর থানার একটি মামলায় সাতদিনের রিমান্ডে আছেন। তবে তাকে রাখা হয়েছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের কার্যালয়ে।
রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়ে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) হারুন-অর রশিদ বলেন, কওমি মাদ্রাসার কোমলমতি ছাত্রদের উস্কানি দিয়ে মাঠে নামিয়েছিলেন মামুনুল হক। তার উদ্দেশ্য ছিল মোদির বাংলাদেশ সফরের বিরোধিতার আন্দোলনকে পুঁজি করে সরকার উৎখাত এবং পরবর্তীতে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করা। হেফাজতের নেতাকর্মীদের সরকারবিরোধী নানা উস্কানি দিতেন তিনি। বলতেন, শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে হেফাজতের সমর্থন ছাড়া কেউ ক্ষমতা দখল করতে পারবে না।
তবে মোহাম্মদপুর থানায় যে চুরি ও হত্যাচেষ্টার মামলায় মামুনুলকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো কথা বলেনি পুলিশ।
এদিকে, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে দায়ের করা ২৩টি মামলার তদন্ত করছে সিআইডি। মামুনুলের বিষয়ে পুলিশের কোনো কর্মকর্তা মুখ না খুললেও সিআইডির প্রধান ব্যারিস্টার মাহবুবুর রহমান বলেন, আমরা নারায়ণগঞ্জের একটি মামলায় তার সংশ্লিষ্টতা পেয়েছি। তিনি বর্তমানে অন্য একটি মামলায় রিমান্ডে আছেন। সেই মামলার রিমান্ড শেষ হলে আমরা তাকে রিমান্ডে নেব।