সাধারণ অর্থে বৈষ্ণব পদাবলি অবলম্বনে কৌতুহলের বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত ‘পদ’গুলিকে “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ” বলা হয়।
পদ গুলিতে যুগের প্রচলিত ধারায় রাধাকৃষ্ণের প্রেম বিরহ,মানাভিমানের নানা গভীর তত্ত্বের অবতারণা করেছেন বালক কবি ভানুসিংহ ঠাকুর।
ছন্দ মিলিয়ে কবিতা লিখলে মানুষের কাছে বড়কিছু হওয়া যায় বা মর্যদা পাওয়া যায় এমন সুপ্ত বাসনা থেকেই কবির এরূপ প্রয়াস! আরো ছোটকালে “জল পড়ে, পাতা নড়ে” “আমসত্ব দুধে ফেলি তাহাতে কদলি ডলি”,,,এ জাতীয় বহু শব্দমালা গাঁথা থেকে তাঁর লেখার সুত্রপাত।
ছোট বেলায় পদাবলি ধাঁচে কাঁচা হাতে লেখা তাঁর পদগুলি বহুকার পরে প্রকাশ পায়। সংকোচের কারণে পদকর্তা নিজেই নিজকে ‘ভানুসিংহ ঠাকুর ‘হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছদ্মনাম।
রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে সে কালের পদাবলি সাহিত্য রস ও ভাবের বিশেষ সীমানা দ্বারা বেষ্টিত। সেই সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ বৈষ্ণব পদাবলীর গণ্ডির মধ্যে তাঁর লেখনি আবদ্ধ ছিলনা; বরং পদগুলি পদকর্তার ইচ্ছা অনুযায়ী সৃষ্টি হয়েছিল। এ কারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর পদ সম্পর্কে বলেছেন,
“,,, ভানুসিংহের সঙ্গে বৈষ্ণবচিত্তের অন্তরঙ্গ আত্মীয়তা নেই”।
বাল্যকাল থেকেই নিভৃতচারী পারিবারিক পরিপাটি পরিবেশে কবি প্রতিভার লক্ষ্মণ ফুটে উঠেছিল স্কুল পালানো,পরীক্ষা না দেওয়া,পাশ না করা,কুনো,এক ঘেয়েমী স্বভাবের, আপন মনে খেলা পড়া করা,সামাজিক পারিবারিক হালকা শাসনযুক্ত এই লাজুক বালকের সুপ্ত চেতনায় কবিত্ব ভাব জেগে ওঠে ছন্দ গঠনের প্রচেষ্টা থেকে। তিনি পরবর্তীকালে বাংলা ভাষার কবি,বাঙালির কবি, আলোকিত কবি,কবিগুরু হিসেবে বিশ্বে প্রতিভাত হয়েছেন। বাংলাদেশ,বাঙালি সহ বহু শব্দ তাঁর লেখায় প্রকাশ পেয়েছে,যা সমসাময়িক বা তাঁর পুর্বে অন্য কোন লেখায় তেমনভাবে পরিলক্ষিত হয় না। তিনি লেখনীর মাধ্যমে মানব চেতনায় স্বাধীনতা বোধ,অধিকার রক্ষা বোধ,সংস্কৃতি বোধ উস্কে দিয়েছেন সকল মানুষের মধ্যে। তাঁর সঙ্গীত,কাব্য,সাহিত্য বিশ্বমানব কল্যাণমুখী। তাইতো তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হিসেবে চিহ্নিত হয়েছেন।
গতানুগতিকতার বাইরে পারিবারিক শিক্ষা- ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা,পোষাক-পরিচ্ছদ ব্যবহারে ব্যতিক্রমী অথচ রুচিশীল পরিমণ্ডলে তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা। তিনি বলেছেন,” বাংলা ভাষাটাকে তখন শিক্ষিত সমাজ অন্দরে মেয়েমহলে ঠেলে রেখেছিলেন ;সদরে ব্যবহার হত ইংরেজি _চিঠিপত্রে,লেখাপড়ায়,এমনকি মুখের কথায়। আমাদের বাড়িতে এই বিকৃতি ঘটতে পারেনি। সেখানে বাংলা ভাষার প্রতি অনুরাগ ছিল সুগভীর, তার বাবহার ছিল সকল কাজেই”,,,।
তেরো/চৌদ্দ বছর বয়সে তৎকালীন সমাজ-জীবনে ধর্মীয় ভাবধারায় যে কাব্যগীতির কথা তিনি জেনেছেন,সেই ধারা অনুস্মরণ করে তিনি ছন্দ তৈরীর কৌতুহল বশতঃ তাঁর মতন করে প্রচলিত প্রথা ভেঙে কিছু পদ রচনা করেন;যাকে বলা হয় ব্রজবুলি পদাবলি । রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
” পদাবলীর যে ভাষাকে ব্রজবুলি বলা হোত আমার কৌতূহল প্রধানত ছিল তাকে নিয়ে”,,,।
আভিধানিক অর্থ যাই থাক,ব্রজবুলি বলতে ব্রজ অঞ্চলের (নজরুলের ভাষায়,”এলাম ব্রজধাম”) বুলি বা ভাষাকেই বুঝানো হয়েছে। বৈষ্ণব কবিগণ ব্রজবুলি ভাষায় রাধাকৃষ্ণ প্রেমলীলা নিয়ে অসংখ্য পদ রচনা করেছেন। সেই ভাষারূপ হারিয়ে গেছে বা যাচ্ছে বললেও অত্যুক্তি হবেনা।কারণ ভাষাপ্রবাহ গতিশীল; পরিবেশের এবং স্থানের প্রভাবে ভাষার উচ্চারণগত রূপ পরিবর্তন হয়।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়,রবীন্দ্রনাথের যুগে কলকাতা এলাকার সাধারণের প্রচলিত ভাষা অপেক্ষা কলকাতা জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির ভাষার একটা আলাদা ভাব-ভঙ্গি ছিল।
আধুনিক যুগে নদীয়া শান্তিপুর অঞ্চলের ভাষাকে যেমন মিষ্টি ভাষা হিসেবে চিহৃিত করা হয়; তেমনি মধ্যযুগে ব্রজবুলি ভাষাও মানুষের কাছে প্রিয় মিষ্টি ভাষা রূপে পরিচিত ছিল বলে বোধকরি। এ প্রসংগে বলতে চাই,বাংলা ভাষা,সাহিত্য-সংস্কৃতি রবীন্দ্রনাথের হাতে একদিকে যেমন পরিশীলিত হয়েছে,অন্যদিকে হারিয়ে যাওয়া বা লুপ্তপ্রায় সুর-তাল-লয়,রাগ রাগিনী সহ অনেক কিছুই ব্রজবুলি পদ ও সুরের মোতই তাঁর কাব্য,সাহিত্য-সংগীত থেকে আমরা পাই।
রবীন্দ্রনাথ অক্ষয়চন্দ্র সরকারের কাছে বালক কবি চ্যাটার্টনের গল্প শুনে বাল্য কালেই পদ রচনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ছিলেন। পদাবলি সাহিত্য প্রসংগে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,” পদাবলী শুধু কেবল সাহিত্য নয়,তার রসের বিশিষ্টতা বিশেষ ডাবের সীমানার দ্বারা বেষ্টিত”। এ-ই ভাব রসে
ভিজে সেই তের/চৌদ্দ বছরের কিশোর একান্তই আপন খেয়ালে ব্রজবুলি ভাষায় গান লেখেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, ” প্রথম গানটি লিখেছিলুম একটা
স্লেটের উপরে,অন্তঃপুরের কোণের ঘরে –
গহনকুসুমকুঞ্জমাঝে
মৃদুল মধুর বংশি বাজে।”,,,
মনে বিশ্বাস হল চ্যাটার্টনের চেয়ে পিছিয়ে থাকব না”।
ভানুসিংহের এই প্রথম প্রয়াস এবং আত্মবিশ্বাস রবীন্দ্রনাথের কবি প্রতিভাকে জাগ্রত করেছে।
রবি ঠাকুরের অন্তঃপুরবাসী সেদিনের ভানু ঠাকুর তাঁর সৃষ্টিকর্ম বলে, বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে সিংহের মতন সৌর্য-বীর্য
প্রদর্শন করে নিজকে ভানুসিংহ ঠাকুর হিসেবে পরিচয় দিয়ে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন।
অথচ পদগুলি বিষয়ে সংকোচন তাঁর পিছু ছাড়েনি।
বলেছেন,” ভানুসিংহের পদাবলী বহুকাল সংকোচের
সঙ্গে বহন করে এসেছি। একে সাহিত্যের একটা অনধিকার প্রবেশের দৃষ্টান্ত বলেই গণ্য করি “।
প্রকাশিত ” ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী ” তে কুড়িটি পদ আছে। উদাহরণ হিসেবে কয়েকটি পদের অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হল।
” বসন্ত আওল রে!
মধুকর গুন গুন, আমুয়ামঞ্জরী
কানন ছাওল রে!,,,।
শুনহ শুনহ বালিকা,
রাখ কুসুমমালিকা,
কুঞ্জ কুঞ্জ ফেরনু সখি শ্যামচন্দ্র নাহি রে।,,,
শ্যাম রে,নিপট কঠিন মন মন তোর।
বিরহ সাথি করি সজনী রাধা
রজনী করত হি ভোর।,,,
বঁধুয়া, হিয়া’পর আও রে,
মিঠি মিঠি হাসয়ি,মৃদু মধু ভাষয়ি,
হমার মুখ’পর চাও রে!,,,।
সজনি গো,
শাওনগগনে ঘোর ঘনঘটা,
নিশীথযামিনী রে।
কুঞ্জপথে,সখি,কৈসে যাওব
অবলা কামিনী রে!,,,।
মাধব,না কহ আদরবাণী,
না কর প্রেমক নাম।
জানয়ি,মুঝকো অবলা সরলা
ছলনা না কর শ্যাম।,,,।
মরণ রে,
তুঁহু মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ,মেঘজটাজুট,
রক্ত কমলকর,রক্ত অধরপুট,
তাপ-বিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান।
তুঁহু মম শ্যামসমান।,,,।
ভানুসিংহের ভনিতায় রবীন্দ্রনাথ রচিত এরূপ ২০(কুড়ি)টি পদ ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’তে স্থান পেয়েছে।
ভানুসিংহ ঠাকুর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের স্কুল পলাতক রবি’র কবি এবং বিশ্বকবি হওয়ার প্রথম স্তম্ভ। অন্যভাবে বলা যায়,ভানুসিংহ ঠাকুরের তেজোদৃপ্ত কাব্যকিরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বময়। আরও বলা যায় ভানুসিংহ ঠাকুর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে বিশ্ব কবি’র আসনে অধিষ্ঠিত করেছেন।
( “ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ শান্তিনিকেতন ১১/৭/৪০)
তথ্যসূত্রঃ রবীন্দ্র-রচনাবলী, প্রথম খণ্ড; প্রকাশনায়ঃ
ঐতিহ্য সংস্করণ, ঢাকা।
জানুয়ারি ২০০৪।
লেখক ; প্রাবন্ধিক ও গবেষক।