স্বাস্থ্য ও জীবন : বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে নানা ধরনের ফলমূল দেখা যায়। প্রবাদ রয়েছে, জ্যৈষ্ঠমাস মাসে মধু মাস। কারণ, এই মাসে বিভিন্ন ধরনের রসাল, মিষ্টি ও সুগন্ধি ফল উঠতে শুরু করে।
নানা ফলের রয়েছে নানান পুষ্টিগুণ। বয়স, শারীরিক অবস্থা, রোগ ভেদে নিয়মিত ও সঠিক মাত্রায় ফল খেলে তা শারীরিক অনেক রোগব্যাধির ক্ষেত্রেও উপকারী। আবার যাদের কিডনির রোগ রয়েছে, তাদের ফলমূল খাওয়ার ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেছেন, ফলের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, এটি রান্না করতে হয় না। আর সব ফলের মধ্যেই পানির পরিমাণ বেশি থাকে। সে কারণে গরমের সময় শরীরের পানিশূন্যতা পূরণে এটি সহায়তা করে।
তিনি বলেন, ‘ফলের মধ্যে খাদ্যশক্তি থাকে, যা শরীরের ভেতর থেকে ক্ষতিকর চর্বি বের করে দেয়। তাই ফল সবার জন্য উপকারী। পুষ্টিমানের দিক থেকেও সব ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, খনিজ পদার্থ থাকে। বিশেষ করে রঙিন ফলে লাইকোপেট আর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, তা শরীরের ভেতরের বিষাক্ত জিনিস দূর করে দেয় এবং ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করে।’
বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে পাওয়া যায়, এমন কয়েকটি মৌসুমি ফলের গুণাগুণ এখানে তুলে ধরা হলো:
আম : স্বাদ, পুষ্টি ও গন্ধে অতুলনীয় জনপ্রিয় একটি ফল আম। বাংলাদেশে এপ্রিল মাস থেকেই কাঁচা আম পাওয়া যায়। তবে পাকা আম আসতে শুরু করে মে মাস থেকে। জুলাই বা আগস্ট পর্যন্ত দেশীয় আম পাওয়া যায়।
কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্ণনা অনুযায়ী, আয়রন ও সোডিয়ামের ঘাটতি পূরণে বেশ কার্যকরী আম। আম রক্তে ক্ষতিকারক কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। ডায়াবেটিসের সঙ্গে লড়াই করে। ক্যান্সার কোষকে মেরে ফেলতে সাহায্য করে। আমে রয়েছে উচ্চ পরিমাণ প্রোটিন, যা জীবাণু থেকে দেহকে সুরক্ষা দেয়। আমে রয়েছে ভিটামিন এ, যা দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে। চোখের চারপাশের শুষ্কভাবও দূর করে। পাকা আমে কাঁচা আমের তুলনায় শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে। কাঁচা আম দেহের শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। লিভারের সমস্যায় কাঁচা আম খাওয়া উপকারী। এটি বাইল এসিড নিঃসরণ বাড়ায়। অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়াকে পরিষ্কার করে। দেহে নতুন রক্ত তৈরিতে সাহায্য করে।
খনিজ পদার্থ আয়রনের ভালো উৎস আম। প্রচুর পরিমাণে আয়রন ও সোডিয়াম বিদ্যমান। এছাড়া খনিজ লবণ, ভিটামিন বি, ই, সেলেনিয়াম, এনজাইম, ম্যালিক এসিড, সাইট্রিক এসিড, টারটারিক অ্যাসিড বিদ্যমান। এজন্যই আমকে বলা হয় ফলের রাজা। এর মধ্যে রয়েছে এমন অনেক পুষ্টিগুণ, যা শরীরকে ভালো রাখে।
খসখসে চামড়া, চুলপড়া, চোখের নানা রোগ, হজমের সমস্যা দূর করতে আম কার্যকরী ভূমিকা রাখে। এ ছাড়া এই ফলটি বলকারক, মুখরোচক ও যকৃতের জন্য উপকারী।
কাঁঠাল : বাংলাদেশের জাতীয় এই ফলের প্রতিটি অংশই খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশের কৃষি তথ্য সার্ভিসের বর্ণনা অনুযায়ী, কাঁঠালে প্রচুর এনার্জি। কাঁঠালে শর্করার পরিমাণ বেশি। কাঁঠাল গ্রীষ্মকালের ফল। পাকা কাঁঠালের ক্যালরি প্রতি ১০০ গ্রামে প্রায় ৯০ কিলোক্যালরি এবং খনিজ লবণের পরিমাণ প্রায় ০.৯ গ্রাম। কাঁচা কাঁঠালের ফাইবারের পরিমাণ পাকা কাঁঠালের বেশ কয়েক গুণ বেশি। তাই ডায়াবেটিক মানুষের জন্য কাঁচা কাঁঠাল উপকারী। রক্তের চিনির মাত্রা স্বাভাবিক রাখার জন্য কাঁচা কাঁঠালের জুড়ি নেই।
এতে আছে থায়ামিন, রিবোফ্লাভিন, ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, আয়রন, সোডিয়াম, জিঙ্ক এবং নায়াসিনসহ বিভিন্ন প্রকার পুষ্টি উপাদান। কাঁঠালে প্রচুর পরিমাণে আমিষ, শর্করা ও ভিটামিন থাকায় তা মানবদেহের জন্য বিশেষ উপকারী। কাঁঠালের প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন এ আছে, যা রাতকানা রোগ প্রতিরোধ করে। এ ছাড়া উচ্চ রক্তচাপের উপশম হয়। কাঁঠাল সর্বত্র পাওয়া যায় তবে আশুলিয়ায় বেশি উৎপন্ন হয়।
লিচু : এটি গ্রীষ্মকালীন একটি স্বল্পমেয়াদি ফল। এই ফলটি টিউমার রোধে বেশ ভূমিকা রাখে। রসাল এই ফলটিতে রয়েছে খাদ্য শক্তি, শর্করা, আমিষ, ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ভিটামিন-সি।
জাম : অরুচি ভাব ও বমিভাব নিরাময়ে জামের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। অনেকে মনে করেন, জাম দেহে রক্ত তৈরি করে। যদিও সেরকম কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই। তবে জামের ভেতর খাদ্য শক্তি, শর্করা, আমিষ, চর্বি, আঁশ, ক্যালসিয়াম, লৌহ, ভিটামিন-সি ও ক্যারোটিন থাকে।
এটি শরীরের হাড়কে মজবুত করে, ডায়রিয়া ও আলসার নিরাময়ে ভূমিকা রাখে। জাম ত্বক টানটান করতে, স্মৃতিশক্তি বাড়াতে আর ডিটক্সিফায়ার হিসেবেও কাজ করে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জামের নির্যাস ক্যান্সার সৃষ্টিকারী ফ্রি র্যাডিকেলের কাজে এবং বিকিরণে বাধা দেয়।
পেয়ারা : বাংলাদেশে এখন সারা বছর ধরেই পেয়ারা পাওয়া যায়। প্রতি ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ৫১ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১১.২০ গ্রাম শর্করা, ০.৯০ গ্রাম আমিষ, ১০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ২১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন-সি আর ১০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন থাকে। কারো কারো জন্য পেয়ারা অম্বলের তৈরি করলেও বেশিরভাগ মানুষের জন্য এই ফলটি উপকারী।
সফেদা : সফেদায় প্রচুর পরিমাণে গ্লুকোজ থাকে, যা দেহে শক্তি যোগায়। এ ছাড়া এই ফলে ক্যালসিয়াম ও লৌহ রয়েছে, যা হাড় ও দাঁত সুস্থ রাখে। সফেদা মানসিক চাপ কমাতে, অনিদ্রা, উদ্বেগ ও বিষণ্ণতা দূর করতে ভূমিকা রাখে বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান, ভিটামিন এ, সি ও ই এবং ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, কপার ও আয়রনসহ অপরিহার্য বহু পুষ্টি উপাদান রয়েছে ফলটিতে।
তরমুজ : তরমুজে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, যা স্ট্রেস কমিয়ে দেয়। এ ছাড়া প্রোস্টেট ক্যান্সার, কোলন ক্যান্সার, ফুসফুসের ক্যান্সার ও স্তন ক্যান্সারে ঝুঁকি কমায়।
তরমুজে প্রচুর পানি থাকে, তাই গরমের সময় শরীরের পানিশূন্যতা দূর করতে তরমুজ ভূমিকা রাখে। শরীরকে সুস্থ ও সতেজ করে তোলে। এতে থাকা ক্যারোটিনয়েড চোখ ভালো রাখতে সহায়তা করে।
আমড়া : প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী আমড়াতে ৬৬ কিলো ক্যালরি খাদ্যশক্তি, ১৫ গ্রাম শর্করা, ১.১০ গ্রাম আমিষ, ৫৫ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ৯২ মিলিগ্রাম ভিটামিন- সি, ৩.৯০ মিলিগ্রাম লৌহ ও ৮০০ মাইক্রোগ্রাম ক্যারোটিন ও ৮৩.২০ গ্রাম জলীয় অংশ রয়েছে। এ ছাড়া পিত্ত ও কফ নিবারক, রুচিবর্ধক হিসেবে আমড়া যথেষ্ট উপকারী। আমড়া কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়।
জামরুল : এই ফলে রয়েছে ক্যারোটিন ও ভিটামিন-বি। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাদের জন্য জামরুল একটি উপকারী ফল।
লটকন : লটকন পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ অম্ল মধুর ফল। এ ফল খেলে বমিভাব দূর হয় ও তৃষ্ণা নিবারণ হয়।
বেল : পেটের নানা অসুখ, আমাশয়, ডায়রিয়া, কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে বেল একটি উপকারী ফল। খাবার হজমে এটি সাহায্য করে। এর মধ্যে ভিটামিন সি, ভিটামিন এ, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম রয়েছে।
যেকোনো ফল কি ইচ্ছামতো খাওয়া উপকারী?
পুষ্টিবিদ অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলেছেন, ফলমূল শরীরের জন্য উপকারী হলেও সব ফল ইচ্ছামতো খাওয়ার সুযোগ নেই। কারণ বয়স, অসুস্থতা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনায় নিয়ে পরিমিতভাবে ফল খেতে হবে। যেমন ডায়াবেটিস রোগীদের মিষ্টি ফল হিসেব করে খেতে হবে, তেমনি কিডনি রোগীদের ফলমূল বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া যাবে না।
ফল খেয়ে পানি খাওয়া ঠিক নয়
ড. ইসলাম বলেছেন, শুধু ফল নয়, সব ধরনের খাবার খাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে পানি খেতে না বলা হয়। এর কারণ হলো, পেটের ভেতরের এনজাইম যেন সেটাকে ভেঙ্গে হজমে সহায়তা করে। ফলে এমনিতেই ৭০% পানি থাকে। তখন সঙ্গে সঙ্গে পানি খেলে সেটা হজমে কিছুটা সমস্যা তৈরি করে। তখন এনজাইম ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। সেই কারণে ফলমূল খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পানি খেতে না বলা হয়।
রাতের বেলায় ফল না খাওয়া ভালো
পুষ্টিবিদ অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলছেন, আগে যেভাবে বলা হতো, রাতে ফল খাওয়া যাবে না, এখন আর সেভাবে বলা হয় না। তবে কিছু ফল খেয়ে হজম হতে সময় লাগে। ফলে সেসব ফল খেয়ে শুয়ে পড়লে অনেকের অস্বস্তি ভাব হতে পারে, গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে পারে। কিন্তু রাতে যে একেবারে ফল খাওয়া যাবে না, তা নয়। বিশেষ করে যারা অনেক রাত জেগে কাজ করেন, তারা অবশ্যই খেতে পারেন।
আনারস খেয়ে দুধ খাওয়া যাবে না
পুষ্টিবিদ অধ্যাপক ড. খালেদা ইসলাম বলছেন, এটার বৈজ্ঞানিক একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। আনারস বা টকজাতীয় কিছু জিনিস খেয়ে দুধ খেলে সেটা পেটে গিয়ে দুধটাকে ভেঙে কঠিন এক ধরনের ছানা তৈরি করে। ফলে সেটা হজম হতে অনেক সময় লাগে। এই কারণে আনারসের সঙ্গে দুধ খেতে না বলা হয়।
ফলের মিষ্টি শরীরের জন্য খারাপ নয়
এটি একটি ভুল ধারণা বলছেন অধ্যাপক খালেদা ইসলাম। তিনি বলেছেন, ফলের মিষ্টি চিনির মতো ক্ষতিকর নয়, কিন্তু এটিও শরীরে মিষ্টির পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের অবশ্যই হিসাব করে মিষ্টি ফল খেতে হবে। সাধারণ মানুষদেরও অতিরিক্ত ফল খাওয়া ঠিক নয়।