নিজস্ব প্রতিনিধি:
সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার গ্রাহকের ৩ কোটি টাকারও বেশি অর্থ নিয়ে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকের দুইটি শাখাসহ চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কর্ণধার মহিব উল্লাহ মিন্টু আত্মগোপন করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে এলাকাবাসী। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে কয়েক কোটি টাকা হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ গ্রাহকরা স্থানীয় কর্মকর্তাদের বাড়িতে হানা দিতে শুরু করেছেন। এতেকরে বিপাকে পড়েছেন ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকসহ তার অধীনে পরিচালিত চারটি প্রতিষ্ঠানের কর্মরত প্রায় ৪০জন কর্মীসহ কয়েক হাজার গ্রাহকেরা। সরেজমিনে বৃহস্পতিবার সকালে উপজেলার শ্রীঊলা ইউনিয়নের নাকতাড়াস্থ ডাচ-বাংলা ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার সামনে গেলে দেখা যায় প্রতারনার শিকার চারটি প্রতিষ্ঠানের শত শত গ্রাহক তাদের আমানতকৃত টাকা উদ্ধারে ব্যাংকের সামনে অবস্থান করলেও ব্যাংক বন্ধ দেখে হতাশ হয়ে ফিরতে বাধ্য হচ্ছে তারা। সূত্রমতে, হিজলিয়া গ্রামের মহিব উল্লাহ মিন্টু ২০১৩ সালে সর্বপ্রথম প্রগতি ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও সংস্থা খুলে শ্রীঊলা ইউনিয়নে কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে “মিন্টু টেলিকম’ নামে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা শুরু করেন মিন্টু। ২০১৯ সালের ২২ ডিসেম্বর ব্যাংক উদ্বোধন করা হয়। পরবর্তীতে আরেকটি এজেন্ট ব্যাংকের শাখা তৈরী করলেও ব্যাংকটির সকল কার্যক্রম চলতো নাকতাড়াস্থ এজেন্ট ব্যাংকিং হতে। এসকল প্রতিষ্ঠানগুলোতে অফিস কর্মচারীসহ বিভিন্ন অঞ্চলভিত্তিক মাঠকর্মী নিয়োগের মাধ্যমে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আদলে ৬ বছরে দ্বিগুণ ও দশ বছরে তিনগুণ মুনাফা দেয়ার ঘোষণা দিয়ে মেয়াদি আমানত (এফডিআর), মাসিক আমানত (এমএসএস) এবং ক্ষুদ্র পরিসরে ঋণ বিতরণ কর্মসূচির কাজ শুরু করেন মিন্টু। ২০১৩ সাল থেকে প্রথমে প্রগতি ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু করে আমানত গ্রহণ ও ঋণদান কর্মসূচি শুরু করলেও সময়ের পরিক্রমায় ডাচ ব্যাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের এজেন্ট হিসেবে কাজ করতে থাকে।
বর্তমানে মিন্টুর এজেন্ট ব্যাংক দুটিতে গ্রাহক সংখ্যা রয়েছে কয়েক হাজার। এছাড়া এপর্যন্ত ৩৯ জন ব্যক্তি বিভিন্ন মেয়াদে স্থায়ী আমানত হিসাবে ২৯ লক্ষ ৭২ হাজার টাকা জমা করেছেন বলে জানা গেছে। সর্বশেষ চলতি বছরের প্রথমদিকে প্রগতি ফাউন্ডেশনের নামে কোটি টাকার প্রজেক্টের নয়জন কর্মী নিয়োগের কথা বলে থেকে মাথাপিছু এক লাখ টাকা করে গ্রহণ করেন মিন্টু। এছাড়াও ডাচ্ বাংলা ব্যাংক নাকতাড়াস্থ ও তালতলা বাজার এজেন্ট ব্যাংকিং শাখায় নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে টেইলার পদে মমতাজ বেগমের থেকে সাড়ে ৭ লক্ষ টাকা, রোজিনা আক্তারের থেকে ১লক্ষ , ম্যানেজার পদে সুকান্ত মন্ডলের থেকে ৩লক্ষ, বিপুল সানার থেকে ৫ লক্ষ টাকা, ওআরও পদে শিউলি মন্ডলের থেকে ২ লক্ষ, মারুফুল ইসলামের থেকে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টাকা পিয়ন পদে প্রশান্ত কুমার সানা ও আলামিন হোসেনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা জামানত হিসেবে সংগ্রহ করে মহিব উল্লাহ মিন্টু। এছাড়াও ইউনিয়নটির নাকতাড়াস্থ ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার এফ.ডি.আর গ্রাহক কলিমাখালী গ্রামের প্রণব মন্ডল, লাভলী রানী, কোলা গ্রামের রহিমা আক্তার, এরশাদ সানা, নাকতাড়ার মমতাজ পারভীনসহ তালিকাভুক্ত ৩৯জন গ্রাহকের ২৯ লক্ষ ৭২ হাজারটাকাসহ প্রগতি ফাউন্ডেশন ও প্রগতি প্রজেক্টের কয়েক হাজার গ্রাহক তাদের আমানত ও সঞ্চয়ের ৩কোটিরও বেশি টাকা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়েছে। কি আছে তাদের ভাগ্যে? কোথায় গেলে তাদের শেষ রক্ষা হবে? এ নিয়ে হতাসাগ্রস্থ গ্রাহকরা।
এসময় শহিদুল্লাহ্ নামে এক ভুক্তভোগী গ্রাহক জানান, তার সহায়-সম্বল যা ছিল তারই সঞ্চিত বা আমানত গচ্ছিত রেখেছিল ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাতে লাভের আশায়। কেননা, প্রতিষ্ঠানটির কর্নধার মহিবউল্লাহ মিন্টু বহুবছর ধরে প্রগতি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করেন। পরে একেএকে প্রগতি ফাউন্ডেশন, ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাসহ চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে সে। ওইসময় মিন্টু মাসিক ১৫’শত টাকা লাভ দেওয়ার কথা বলে তার থেকে দুই দফায় ৩লক্ষ ৭০ হাজার টাকা গ্রহণ করে। টাকার গ্যারান্টি স্বরুপ মহিবউল্লাহর স্বাক্ষরিত কয়েকটি সাদা চেকও দেওয়া হয় তাকে। সাদা চেক থাকলেও তার গচ্ছিত অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে শঙ্কিত তিনি। শহিদুল্লাহর মতো একাধিক ভূক্তভোগী গ্রাহকরা জানান, দীর্ঘ সময় ধরে মহিবউল্লাহ মিন্টু বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্যদিয়ে কার্যক্রম ও স্থানীয় কর্মী নিয়োগ এবং উচ্চ মুনাফা দিয়ে প্রগতি ফাউন্ডেশন, ডাচ্ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকিং শাখাসহ মোট চারটি প্রতিষ্ঠান গড়ার মধ্যে দিয়ে এলাকার মানুষের ভরসা অর্জন করে । একদিকে স্থানীয় কর্মীদের উপর আস্থা, অন্যদিকে নামডাক দুই-ই মিলে আমাদের বিশ্বাস অর্জন করতে সক্ষম হয় প্রতারক মিন্টু। বাজারের ব্যবসায়ীরা ব্যবসায় মূলধনের বিনিয়োগের পাশাপাশি তার প্রতিষ্ঠান গুলোতে লাখ লাখ টাকা গচ্ছিত রাখে। এলাকার ছোট ছোট দোকানদার, ব্যবসায়ী, ভ্যান-চালক, কুলি-মজুরীসহ নিম্ন আয়ের লোকজন তাদের সকল গচ্ছিত ও সঞ্চয়কৃত টাকার নিরাপদ স্থান হিসাবে এখানে টাকা বিনিয়োগ করে। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার মহিবউল্লাহর প্রতারণার কারনে এখন নিঃস্ব হয়ে জীবনযাপন করে চলেছেন বলে জানান গ্রাহকরা। এব্যাপারে ডাচ্ বাংলা ব্যাংকের নাকতাড়াস্থ এজেন্ট ব্যাংকের টেইলার মমতাজ বেগমসহ অন্যরা জানান, সাতক্ষীরা থেকে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের এস এস এম, এবি মোঃ মোরশেদ আলম গত ১৬ আগষ্ট ব্যাংকে এসেছিলেন এবং তিনি এফডিআর বাবদ নগদ টাকা নিয়ে গ্রাহকের অ্যাকাউন্টে জমা না করার কারনে ৩ দিনের মধ্যে ব্যাখ্যা দিতে সতর্কীকরণ নোটিশ দিয়ে যান মহিবউল্লাহ মিন্টুকে। তবে মহিবউল্লাহর মিন্টুর অনুপস্থিতে নোটিশটি মমতাজ বেগম গ্রহণ করেন। তবে সে (মিন্টু) তো পলাতক গ্রাহকের টাকা নিয়ে। একারনে ব্যাংক বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। এসময় তারা আরো বলেন, মহিব উল্লাহ মিন্টুর দূর্নীতির কারনে আজ আমরা জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। আমরা নিজেরা ক্ষতিগ্রস্থ। আমাদের কয়েক মাসের বকেয়া বেতন, জামাতনকৃত অর্থসহ গ্রাহকের সকল অর্থ মিলিয়ে তিনকোটি টাকারও বেশি অর্থ আত্মসাৎ করে পালিয়েছে সে। আমরাসহ গ্রাহকেরা যেনো সুষ্ঠু বিচার পাই সেকারনে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। এব্যাপারে এজেন্ট ব্যাংকির তদারকিতে থাকা ব্যাংকটির এবি মোরশেদ আলম (এসএসএম) জানান, আমি ব্যাংকটি ভিজিট করে সকল ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন করেছি। উপস্থিত ব্যক্তিবর্গ ও মোবাইলে অনেকের সাথে কথা বলেছি। অনিয়ম ধরা পড়ার পর মিন্টুকে নোটিশ পাঠিয়েছিলাম এবং কেন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবেনা সেটার জন্য তিন কার্য দিবসের ভিতরে জানানোর কথা উল্লেখিত করেছি। তবে মিন্টু পলাতক থাকাই নোটিশটা মমতাজ বেগমের জিম্মায় ছিলো। সে নোটিশটা মিন্টুকে পাঠিয়েছে বলে শুনেছি। পরবর্তীতে কী হয়েছে সেটা সম্পর্ক অজ্ঞাত জানিয়ে তিনি বলেন, ব্যাংক ব্যতিত অন্য প্রতিষ্ঠানের দূর্নীতিতে যদি মিন্টু ব্যাংককে ব্যবহার করার চেষ্টা করে অনৈতিক কিছু করে থাকলে তার দায় তাকেই নিতে হবে। এজন্য ব্যাংকের কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। এবিষয়ে আশাশুনি থানার ওসি গোলাম কবির বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু দিন আগে জেনেছি। তবে এখনও কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তবে যদি কেউ এ ব্যাপারে লিখিত অভিযোগ দেয় তবে অভিযুক্ত মহিব উল্লাহ মিন্টুর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।