দেশের খবর : গ্যাস ও বিদ্যুৎ গ্রিডের আদলে ‘জাতীয় ওয়াটার গ্রিড’ তৈরির চিন্তা করছে সরকার। দেশের সব এলাকার মানুষের জন্য নিরাপদ পানি নিশ্চিত করতে এমন ভাবনা। ‘ওয়াটার গ্রিড’ হলে ভূ-গর্ভস্থ পানির উত্তোলন কমবে, ভূ-উপরিস্থ উৎসের পানির ব্যবহার দিয়েই চাহিদা মেটানো সম্ভব হবে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ সব এলাকার মানুষ সুপেয় পানি পাবে আর সেটা হলে দেশের ভূ-গর্ভস্থ পানির লেভেল ঠিক থাকবে। ভূমিধসের ঝুঁকি কমবে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখা সম্ভব হবে। পানি উৎপাদন ও সরবরাহের টেকসই এ উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হবে বড় উপহার।
জানা যায়, গত ২৬ মে দি রিজিওনাল সেন্টার অন আরবান ওয়াটার ম্যানেজমেন্টের (আরসিইউডব্লিউএম) ‘গভর্নিং বোর্ড মিটিং-২০২১’ এ বক্তৃতা করেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় (এলজিআরডি) মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। ভার্চুয়াল ওই সভায় মন্ত্রী ‘জাতীয় ওয়াটার গ্রিড’ তৈরির পরিকল্পনার কথা জানান। এ ছাড়া আঞ্চলিকভাবে পানি সমস্যা সমাধানে আন্তঃসীমান্ত ওয়াটার গ্রিড লাইন চালুর বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতি আহ্বান জানান। এরপর ধারাবাহিকভাবে বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার ও সাংবাদিকদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে তিনি ‘জাতীয় ওয়াটার গ্রিড’ করার দৃঢ় ইচ্ছার কথা জানান।
মন্ত্রী বলেন, দেশের কিছু কিছু এলাকায় সুপেয় পানি সরবরাহ করা চালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘জাতীয় ওয়াটার গ্রিড’ তৈরির মাধ্যমে জোন এবং সাব-জোন করে পানি সরবরাহ করলে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব হবে। আর এ অঞ্চলের অনেক দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত পানি রয়েছে। কিছু দেশে প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি রয়েছে। সদস্য দেশগুলোর সমন্বয়ে পানি স্বল্পতা নিরসন সম্ভব।
তিনি বলেন, সুপেয় পানির চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ এবং আন্তঃসীমান্ত ওয়াটার গ্রিড নির্মাণ সংক্রান্ত ধারণাটি আরসিইউডব্লিউএম’র সদস্য দেশগুলোর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নেওয়া যেতে পারে। রাশিয়া, রোমানিয়া ও গ্রিসে এ ধরনের কানেক্টিভিটি থাকলে এশীয় অঞ্চলে থাকবে না কেন। আঞ্চলিক সহযোগিতা ছাড়া এ অঞ্চলের পানি সংকট নিরসন সম্ভব নয়।
অস্টেলিয়ার ন্যাশনাল ওয়াটার অথোরিটির ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে দেশটির সরকার জাতীয় ওয়াটার গ্রিড কর্তৃপক্ষ গঠন করেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেটে ওয়টার গ্রিড উন্নয়নের কার্যক্রম জোরদার করতে ১২টি প্রকল্প গ্রহণ করেছে। দেশটির সরকার মনে করছে, ওয়াটার গ্রিড কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করবে এবং অঞ্চলিক স্থিতাবস্থা তৈরিতে সহায়তা করবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা ওয়াসা বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা বলেন, ঢাকা ওয়াসা নতুন করে পানি সরবরাহ লাইন তৈরির কাজ করছে। এটা তৈরির কাজ শেষ হলে ঢাকার দুই সিটির ৩০৫ বর্গকিলোমিটার এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য ‘ওয়াটার গ্রিড’ তৈরি করা সম্ভব হবে। এক এলাকায় পানি সংকট হলে অন্য এলাকার সরবরাহ লাইন থেকে সেটা দেওয়া সম্ভব হবে। তবে জাতীয়ভাবে এটা কিভাবে সম্ভব সেটা আমার বুঝে আসছে না।
তিনি বলেন, ঢাকা ওয়াসা ভূ-গর্ভস্থ পানির উৎস থেকে ভূ-উপরিস্থ উৎসে যাওয়ার চেষ্টা করছে। সে লক্ষ্যে বেশ কিছু প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে সেটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে। আমরা ১৪৫টি অঞ্চলে ভাগ করে নতুন পাইপলাইন তৈরির কাজ করছি। ইতোমধ্যে অর্ধেক কাজ শেষ হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইরিগেশনের মাধ্যমে এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে পানি সরবরাহের উদাহরণ রয়েছে। সেহেতু এটা অবাস্তব বা অসম্ভব কোনো চিন্তা বা উদ্যোগ নয়। তবে এটা খুবই ব্যয়বহুল ব্যাপার। এটা নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা করে সামনে এগোতে হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘জাতীয় ওয়াটার গ্রিড’ স্থানীয় সরকারমন্ত্রীর একটি চিন্তা। তিনি দেশের সুপেয় পানি ব্যবস্থাপনা টেকসই সমাধান করতে এমন চিন্তা করছেন। তবে এটা বাস্তবায়নের ব্যাপারে এখনো মন্ত্রণালয় থেকে কোনো কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।
তিনি বলেন, গ্যাস ও বিদ্যুতের মতো জাতীয় ওয়াটার গ্রিড তৈরির চিন্তা করছেন মন্ত্রী। যে কোনো বিষয়ে প্রথমে তো চিন্তা আসে তারপর সেটা ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করতে হয়। মন্ত্রীর নির্দেশনা পেলে এ ব্যাপারে কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
দেশের পানি ব্যবস্থাপনার চিত্র :
স্থানীয় সরকার বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ৯৮ শতাংশ মানুষ পানি সরবরাহের আওতায় এসেছে। এর মধ্যে ৫০ শতাংশ মানুষ ভূ-উপরিস্থ উৎসের পানি ব্যবহার করছে। আর ৫০ শতাংশ ভূ-গর্ভস্থ উৎসের পানি ব্যবহার করছে। দেশের চারটি মহানগর অর্থাৎ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহী মহানগরের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে কাজ করছে স্বতন্ত্র কর্তৃপক্ষ।
জানা যায়, চট্টগ্রামে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ঢাকার মতো নেমে যাচ্ছিল। এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার সেখানে সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপন করেছে। বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরের ৯৫ শতাংশ ভূ-উপরিস্থ পানি সরবরাহ করছে। সেখানকার বর্তমান পানির চাহিতা দৈনিক ৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে দৈনিক ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে ৪৫ কোটি লিটার। বাকি ৫ কোটি লিটার পাম্পের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন সরবরাহ করছে। চট্ট্রগ্রামে ৪০০টি পাম্প ছিল, ভূ-উপরিস্থ উৎসের সরবরাহ বেড়ে যাওয়ায় ২০০টি পাম্প ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। বর্তমানে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের চাপ কমায় ওই এলাকার পানির ভূগর্ভস্থ স্তরও স্বাভাবিক পর্যায় চলে আসছে। আর খুলনা শহরে চাহিদার ৫০ ভাগ ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে সরবরাহ করছে খুলনা ওয়াসা। সেখানে বর্তমান পানির চাহিদা ২৪ কোটি লিটার। প্রতিদিন ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে পরিশোধিত পানি সরবরাহ করা হচ্ছে প্রায় ১২ কোটি লিটার। বাকি ১২ কোটি লিটার পানির চাহিদা পূরণ হচ্ছে ১০ হাজার চাপকলের মাধ্যমে। এ শহরের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে হলে শতভাগ ভূ-উপরিস্থ উৎসের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে। খুলনা ওয়াসায় কোনো পাম্প নেই। রাজশাহী মহানগরে দৈনিক পানির চাহিদা ১১ কোটি লিটার। এর মধ্যে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে ৩০ ভাগ পানি সরবরাহ করছে। এটা আসছে একমাত্র ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট থেকে। বাকি ৭০ ভাগ ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে সরবরাহ করছে। এ কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলের এ শহর পানির ভূগর্ভস্থ স্তর শুষ্ক মৌসুমে নিচে নেমে যাচ্ছে।
রাজধানীতে পানি সরবরাহ করছে ঢাকা ওয়াসা। এখানে দৈনিক পানির চাহিদা ২৪০ কোটি লিটার। এর প্রায় ২৫ ভাগ সরবরাহ করছে ভূ-উপরিস্থ উৎস থেকে। আর বাকি ৭৫ ভাগ ভূ-গর্ভস্থ উৎস থেকে সরবরাহ করা হয়। এ চাহিদা পূরণে প্রায় ৮০০ পাম্প পরিচালিত হচ্ছে। ভূগর্ভস্থ উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ উৎসের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়াতে সরকার তাগিদ দিলেও ওয়াসা সে লক্ষ্যে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর জানায়, এখনো সারা দেশের গৃহস্থালি ও খাবার পানির ৯৪ শতাংশ চাহিদা পূরণ হচ্ছে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে। এ উৎস থেকে গ্রাম এলাকায় ৯৯ শতাংশ ও ৮০ ভাগ শহর এলাকায় পানি সরবরাহ করা হয়। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে দেশের ১৮ শতাংশ নলকূপের পানি উত্তোলনে সমস্যা হয়। ঢাকা মহানগর, পার্শ্ববর্তী শিল্পাঞ্চল ও বরেন্দ্র অঞ্চলগুলোতে পানির ভূগর্ভস্থ স্তর দ্রুত পুনঃভরণ সম্ভব হয় না। এজন্য ক্রমেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। আর সেচ ও অন্যান্য কাজে ভূগর্ভস্থ পানির অতিরিক্ত উত্তোলন পানি সংকটকে আরও প্রকট করে তোলে। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকার গভীর ও অগভীর ভূ-স্তরের মাত্রাতিরিক্ত আয়রণ ও আর্সেনিকের উপস্থিতি এবং উপযুক্ত ভূ-গর্ভস্থ পানির আধারের দুষ্প্রাপ্যতার কারণে নিরাপদ পানিপ্রাপ্তি বিঘ্নিত করে। উপকূলীয় এলাকায় পলিমাটির আধিক্য ও গভীর নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হচ্ছে না। এ অঞ্চলগুলোতে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়। জলবায়ূ পরিবর্তনজনিত কারণে শুষ্ক মৌসুমে খরা, অনাবৃষ্টি ও বিলম্বিত বৃষ্টিপাতের কারণে পুকুর ও খাল শুকিয়ে যাওয়ায় চলতি বছরে দেশের বেশির ভাগ এলাকার মানুষ সুপেয় পানির চরম কষ্টে পড়েন।