অনলাইন ডেস্ক: ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনের নেজারত ডেপুটি কালেক্টরের (এনডিসি) দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার কিশোর কুমার দাশ লাঠি দিয়ে দুই চাকরিপ্রার্থীকে পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগী চাকরিপ্রার্থী কাজী মোশারফ হোসেন (৩০) ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসপাতালের নিচতলার পেয়িং ওয়ার্ডের ১১ নম্বর বেডে তিন দিন শয্যাশায়ী ছিলেন। ব্যথায় বাম পা ও হাত নড়াতে পারছেন না তিনি। পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবেন, সেই ক্ষমতা নেই মোশাররফ হোসেনের।
গত শুক্রবার সকালে শহরের ১২টি কেন্দ্রে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের রাজস্ব প্রশাসনের অধীন তৃতীয় শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষা এবং বেলা ৩টা থেকে সাড়ে ৪টা পর্যন্ত একটি কেন্দ্রে সাধারণ প্রশাসনের অধীন তৃতীয় শ্রেণির নিয়োগ পরীক্ষা হয়।
চাকরিপ্রার্থী কাজী মোশারফ হোসেন বলেন, “আমার কেন্দ্র ছিল শহরের বিরাশার এলাকায় বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সকাল ১০টায় পরীক্ষা দিতে যাওয়ার সময় আমার হাতে মোবাইল ও ঘড়ি ছিল। পরীক্ষা শুরুর ১৫ মিনিট আগে সেগুলো কক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে গচ্ছিত রাখি। পরে আমার মোবাইল সেটসহ আরও সাত থেকে আট জন পরীক্ষার্থীর মোবাইল সেট ও ঘড়ি ওই কক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছ থেকে কেন্দ্র সুপারের দায়িত্বে থাকা সহকারী কমিশনার কিশোর কুমার দাশ নিয়ে যান। পরীক্ষা শেষে কক্ষ পর্যবেক্ষকের কাছে মোবাইল সেট ফেরত চাইলে তিনি সহকারী কমিশনারের সঙ্গে কেন্দ্রের নিচে গিয়ে দেখা করতে বলেন। এরপর সেখানে গিয়ে কিশোর কুমার দাশের সঙ্গে সাক্ষাত করলে তিনি কেন্দ্রের মেইন গেটে যেতে বলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা পরীক্ষার্থীদের তিনি বলেন, ‘এগুলো কেন নিয়ে আসছো, ফেরত দেওয়া যাবে না।’ কিছু সময় পরে তাদেরকে ডিসি অফিসে যেতে বলে সেখান থেকে চলে যান কিশোর কুমার। ডিসি অফিসে যাওয়ার পর বলেন, ‘তোমরা কেন এখানে আসছো। মোবাইল ফেরত দেওয়া যাবে না। বেশি বেশি করলে পুলিশ ডাকবো।’ এ সময় চাকরিপ্রার্থীরা বলেন, ‘স্যার আমরা গরিব মানুষ, আমাদের ভুল হয়ে গেছে, মোবাইল ফেরত দিন।’
কাজী মোশারফ হোসেন আরও বলেন, ‘মোবাইল ফেরত দেওয়ার অনুনয়-বিনয় করলেও ওই কর্মকর্তা আমাদের পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার হুমকি দেন। সাড়ে ১১টায় পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত ক্রমাগত অনুরোধ করার পরও মোবাইল ফেরত না দেওয়ার ব্যাপারে অটল থাকেন কিশোর কুমার দাশ। একপর্যায়ে মোবাইল-ঘড়ি পাওয়ার আশা বাদ দিয়ে হতাশ হয়ে তাদের অনেকে চলে যান।’
মোশারফ বলেন, ‘এমন অবস্থায় ডিসি অফিসে পরিচিত এক কর্মচারীকে পেয়ে তাকে ঘটনা জানিয়ে সহায়তা কামনা করেন। পরে ওই কর্মচারীকে সঙ্গে নিয়ে বেলা ৩টার দিকে কিশোর কুমার দাশের কক্ষে যাই আমি ও আরেক পরীক্ষার্থী। ওই কর্মচারীকে দূরে সরিয়ে দিয়ে প্রথমে মোশারফকে সামনে হাত রেখে পেছন ঘুরে দাঁড়াতে বলেন কিশোর কুমার। এরপর ওই কর্মচারীকে একটি লাঠি আনতে বলেন। লাঠি আনার পর এটি দিয়ে যতো খুশি মারার জন্যে ওই কর্মচারীকে নির্দেশ দেন। দু-আড়াই হাত লম্বা ওই লাঠি দিয়ে প্রথমে ওই কর্মচারী সাত-আটটি বাড়ি দেন মোশারফের কোমরের নিচ থেকে পা পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে। এরপর কিশোর কুমার দাশ আমি যে কর্মচারীকে সহায়তার জন্যে নিয়ে গিয়েছিলাম তাকে বলেন আমাকে পেটাতে। ওই কর্মচারী আমার আত্মীয় হওয়ায় তিনি আমাকে পেটাতে পারবেন না বলার পর কিশোর কুমার আরেকজনকে ফোন করে সেখানে আনেন। তিনিও সজোরে আমাকে ১০ থেকে ১২টি বাড়ি দেন। তারপরও হয়নি বলে কিশোর কুমার দাশ নিজেই লাঠি দিয়ে আমাদের দুজন চাকরিপ্রার্থীকে পেটান। একপর্যায়ে আমি মেঝেতে বসে পড়ি। পরে সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে আমাদের মোবাইল ফোন ফেরত দেওয়া হয়। কিন্তু আমি চলার শক্তি হারিয়ে ফেলি। পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পারছিলাম না।’
এ অবস্থায় জরুরি ৯৯৯ নম্বরে কল করলে সেখানে গিয়ে সন্ধ্যার দিকে আমাকে উদ্ধার করেন সদর মডেল থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আতিকুল্লাহ।
এসআই আতিকুল্লাহ বলেন, ‘আনুমানিক সোয়া ৫টার দিকে আমি কল পাই। এরপর সেখানে গিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় ডিসি অফিসের মসজিদের কাছে মোশারফকে পড়ে থাকতে দেখি। তিনি পা লম্বা করে পড়ে ছিলেন। কথা বলতে পারছিলেন না। কান্নাকাটি করছিলেন। এই অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তির জন্য পাঠাই।’
সদর হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক ফয়সাল আল হাসান বলেন, ‘হাতে এবং বাম পায়ে আঘাত পেয়েছেন মোশারফ হোসেন।’
এ বিষয়ে কথা বলার জন্যে অভিযুক্ত সহকারী কমিশনার কিশোর কুমার দাশের মোবাইল ফোনে কয়েকবার কল করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কিশোর কুমার দাশ প্রায় তিন বছর ধরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসনে রয়েছে। ২০২১ সালের ২ সেপ্টেম্বর নেজারত ডেপুটি কালেক্টরের দায়িত্ব নেন। তার বিরুদ্ধে করোনাকালে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সময় দুই যুবককে মারধর করার অভিযোগ রয়েছে। মাস্ক না পরার অপরাধে জরিমানা দিতে দেরি করায় রড দিয়ে পিটিয়ে এক যুবকের হাত ভেঙে দেন।
জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলমের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
তবে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। যদি এমন ঘটনা ঘটে তাকে তবে এটি খুবই দুঃখজনক।’