আমি খুব আশ্চর্য হব না যদি অদূর ভবিষ্যতেই কোনও বাঙালি পরিবারে দেখা যায় – শ্যামবর্ণ, খর্বকায়, খুব সাধারণ দেখতে বাবা মায়ের সন্তানের গায়ের রঙ ধবধবে ফর্সা, ৬ ফিট লম্বা, নীল চোখ।
অন্যান্য রাজ্যেও হয়তো দেখা যাবে বাবা মা ভারতীয় হলেও ঘরে ঘরে ককেশিয়ান বা ইউরোপিয়ান চেহারার কোনও সন্তান ভূমিষ্ঠ হচ্ছে।
আবার উল্টোটাও হয়তো ঘটছে, কারণ ইউরোপ ও আমেরিকায় নাকি ভারতীয় শুক্রাণুদাতার চাহিদা বাড়ছে।
আসলে দিন কয়েক আগে একটি খবর পড়ে আমার এমনটা মনে হচ্ছে। খবরে বলা ছিল ‘উচ্চ শিক্ষিত’ পুরুষের শুক্রাণু চাই। আর ডিম্বাণুর জন্য প্রয়োজন সুন্দরী মহিলা।
এমনিতে বন্ধ্যাত্ব বা অন্য শারীরিক কারণে স্বাভাবিক ভাবে যে সব নারী পুরুষের বাবা মা হওয়ার সুযোগ কম, পিতৃত্ব ও মাতৃত্বের অভাব মেটাতেই তাঁরা সন্তান লাভের জন্য স্পার্ম ব্যাঙ্কয়ের দারস্থ হন।
প্রথম দিকে ইচ্ছুক বাবা মা’দের প্রধান চাহিদাই ছিল সন্তান যেন সুস্থ ও সবল হয়। সেই হিসেবে শুক্রাণুদাতা ও ডিম্বাণুদাত্রীর নীরোগ ও সম্পূর্ণ সুস্থতাই ছিল বিচার্য। কিন্তু এখন দেখছি সেই চাহিদাতেও বদল ঘটছে।
ভারতের বিভিন্ন শহরে কয়েক দশক আগে বন্ধ্যাত্ব’র কারণে নিঃসন্তান দম্পতিদের সন্তান চাহিদা মেটাতেই গড়ে ওঠে ফারটিলিটি ক্লিনিক এবং স্পার্ম ও এগ তথা শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যাঙ্ক। এবং বন্ধ্যাত্ব পৃথিবীর নানা দেশের মতো ভারতেও ক্রম বর্দ্ধমান হওয়ায় সমস্ত রাজ্যেই ফারটিলিটি ক্লিনিক বাড়ছে। বাড়ছে শুক্রাণুদাতা ও ডিম্বাণুদাত্রীর চাহিদাও।
আমার মনে পড়ে যাচ্ছে, ‘ভিকি ডোনার’ সিনেমাটির কথা। যেখানে দেখেছিলাম একটি ফারটিলিটি ক্লিনিকের ডাক্তার নিঃসন্তান দম্পতির জন্য হন্যে হয়ে একজন স্মার্ট স্বাস্থ্যবান যুবক খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
কিছুতেই রাজি না হওয়ায় – ডোনার হওয়া যে ’একটা মহৎ সামাজিক কাজ’ – তা নানা ভাবে সেই যুবক তথা নায়ককে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত স্পার্ম ডোনার হতে তাকে রাজি করিয়েছিলেন।
এখন অবশ্য ধরে বেঁধে নয়, অনেকেই যেমন উপযাচক হয়ে ’মহৎ কাজ’-এর উদ্দেশ্যে শুক্রাণু দান করছেন, তেমনি কেউ দিচ্ছেন টাকা রোজগারের জন্য।
তবে অনেক শুক্রাণু ও ডিম্বাণু গ্রহীতার মনে ইদানীং যেন এই ভাবনা চলে আসছে যে, সন্তান যখন তৈরিই করা হবে, তাহলে যেমন চাই ঠিক তেমনটাই বা পাবো না কেন? আর ওই ভাবনার হাত ধরেই ইচ্ছুক বাবা মায়ের মনে উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, কখনও ইউরোপীয় চেহারা কখনও বা সুন্দর ও মেধাবী সন্তানের আকাঙ্ক্ষা।
চাষিরা যেমন ভাল ফসলের আশায় উন্নত মানের বীজ মাটিতে পোঁতেন। ঠিক তেমনি হবু বাবা মা’ও যেন মেধাবী সন্তানের খোঁজে উচ্চ শিক্ষিত পুরুষের বীজ তথা শুক্রাণু খুঁজে বেড়াচ্ছেন।
তাঁদের বিশ্বাস উচ্চ শিক্ষিত বা কৃতী পুরুষের শুক্রাণু থেকে জাত সন্তানও মেধাবী বা কৃতী হবে। কৃতী মানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট ইত্যাদি। তার জন্য বেশি দাম দিতেও পিছপা নয় গ্রহীতারা।
এমনও ঘটেছে যে, একজন ইচ্ছুক চার্টার্ড অ্যাক্যাউন্টেন্ট শুক্রাণু গ্রহীতা নাকি কেবল তাঁর সমপেশার দাতারই শুক্রাণু খুঁজে বেড়াচ্ছেন। বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা তাঁর সন্তানও ভবিষ্যতে চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্টই হবে।
আসলে জিনের মধ্যে যে প্রফেশনের কোনও দলিল লেখা থাকে না, যা উত্তরাধিকার সূত্রে তাঁদের সন্তানেও তা বর্তাবে সেই ব্যাপারে অজ্ঞতাই তাঁদের তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।
তবে ডিম্বাণুর ক্ষেত্রে মেয়েদের সৌন্দর্যই যেন একমাত্র মাপকাঠি।
ইচ্ছুক গ্রহীতারা ভাবছেন সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে পাওয়া ডিম্বাণুর জিন’এ নিশ্চয়ই সৌন্দর্যের বারতা লেখা থাকবে, যার দৌলতে সন্তানও হবে সুন্দর।
হায়, মেধাবী সন্তান জন্মের জন্য নারীর তবে কোনও অবদান নেই? নারী মানেই তবে মেধাহীন বা কম মেধার মানুষ? আর যত মেধার সত্ত্ব লুকিয়ে থাকে ওই পুরুষেরই জিন’এ?
আমার মনে হচ্ছে এই ‘কু’-বিশ্বাসের পরম্পরা আমাদের সমাজে এতটাই দৃঢ়মূল যে, সেই কারণেই গোটা দেশের মতো পশ্চিমবঙ্গেও এই ‘উচ্চ শিক্ষিত’-এর শুক্রাণুর চাহিদা হু হু করে বেড়ে চলেছে।
অবশ্য এও বোঝা যাচ্ছে যে, চাহিদা অনুযায়ী জোগান কম, বিশেষ করে ওই ‘উচ্চ শিক্ষিত’র। তাই আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের মতো ভারতেও এর চাহিদা বা বাজার এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, শুক্রাণুর দামও লাগামছাড়া ভাবে বাড়ছে।
দেশের প্রায় সমস্ত ফারটিলিটি ক্লিনিক জানাচ্ছে যে, গত ৫/৬ বছরে শুক্রাণুর দাম বেড়েছে ৫০%-১০০%। এবং সেখানে ডাক্তারি ও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ডিগ্রিধারীদের শুক্রাণুর দামই সব থেকে বেশি।
‘কম শিক্ষিত’ দাতাদের কাছ থেকে যেখানে এক ভায়েল শুক্রাণু ২০০০ টাকায় মিলছে। ’উচ্চ শিক্ষিত’দের জন্য প্রতি ভায়েল শুক্রাণুর দাম অনায়াসে উঠে যাচ্ছে ১২ থেকে ১৫ হাজার টাকা।
দেখে শুনে মনে হচ্ছে বিয়ের বাজারের মতোই ভারতে শুক্রাণুদাতাদের ক্ষেত্রেও ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের বাজার দর চড়চড়িয়ে বাড়ছে।
আসলে বাজার অর্থনীতিতে তো সবই কমোডিটি। তাই মনে হচ্ছে প্রোডাক্ট, সে সন্তান বা পোশাক যাই হোক না কেন বিনিয়োগের অর্থ যাতে সুদে আসলে উঠে আসে, বিনিয়োগকারীর সতত দৃষ্টি রয়েছে সেখানে।
তাই অর্ডার দিয়ে পছন্দ অনুযায়ী জামা কাপড় বা খাবার কেনার মতোই বেশি অর্থ খরচ করলেই মিলে যেতে পারে সুন্দর মেধাবী সন্তানও।
কিন্তু প্রশ্ন একটা থেকেই যাচ্ছে – এই আব্দার কি সবার মেটানো সম্ভব?
কারণ আমাদের সমাজে নানা কারণে নারী পুরুষের বন্ধ্যাত্ব যে হারে বাড়ছে, তাঁদের সবাই যদি ফার্টিলিটি ক্লিনিকের সাহায্যে নিতে চান এবং সবাই যদি মেধাবী ও দেখতে সুন্দর সন্তানের বাবা মা হওয়ার বাসনা পোষণ করেন, তাহলে তা পূরণ করা কতটা সম্ভব?
তা ছাড়া ভবিষ্যতে জাত গোত্র ঠিকুজি কুলুজি মিলিয়ে যারা ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে চান তাঁরাই বা ‘শুদ্ধ’ জাত গোত্র পাবেন কি করে? ততদিনে যে সব ঘেঁটে যাবে।
লেখক: সাংবাদিক, কলকাতা ।
সূত্র : বিবিসি বাংলা।
পূর্ববর্তী পোস্ট