টাকা দিলেই এখন নিয়োগ পাওয়া যায়! সে যে ধরনের চাকরিই হোক না কেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে শুরু করে আধা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি বা পিওন পদে চাকরির জন্যও ঘুষ দিতে হয়? আর এই ঘুষের রেট এমন পর্যায়ে গেছে যা সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। এসব কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মেধাবী শিক্ষার্থীরা। টাকা দিয়ে বেশিরভাগ চাকরি মিলছে, জঙ্গি-জামায়াত শিবিরের। টাকার নেশায় ‘জামায়াত না জঙ্গি জিজ্ঞেসে কোনজন’।
তবে রাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয় হলো জঙ্গি-জামায়াতও ঘুষ দিয়ে ঢুকে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীতে। অস্ত্র নিয়ে তারা দায়িত্ব পালন করছেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আশপাশে। ঘুষের কারণে এদের পরিচয়ও বদলে যাচ্ছে, হয়ে যাচ্ছে আওয়ামী লীগের লোক। গ্রামের বাড়িতে যে পুলিশ ভেরিফিকেশন হয়, সেখানেও এক-দুই হাজার টাকায় পরিচয় বদলে ফেলা যায়। টাকা দিলে আওয়ামী লীগ সমর্থক আর টাকা না দিলে আওয়ামী লীগ সমর্থক পরিবারের সদস্যরাও হয়ে যাচ্ছেন জামায়াত-বিএনপি বা জঙ্গি গ্রুপের সদস্য।
পুলিশের মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেন, ‘পুলিশ ভেরিফিকেশনে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকবে তারা নির্বাচিত হলেও আমরা তাদের বাদ দেই। আর মাদকাসক্ত হলে নিয়োগের আগে যে মেডিক্যাল পরীক্ষা হয় সেখানে ধরা পড়ে। এ ধরনের কেউ ধরা পড়লে তাদেরও বাদ দেওয়া হয়। বর্তমানে যারা কর্মরত আছেন তাদের মধ্যেও কেউ যদি মাদকাসক্ত হন তাহলে ধরা পড়লে তাদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর ব্যবস্থা নেই।’
একজন নামকরা মনোরোগ বিজ্ঞানীর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানালেন আরো ভয়ঙ্কর তথ্য। তিনি বলেন, ‘বিপুল পরিমাণ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি নেওয়া শিক্ষার্থীদের অনেকেই মনে করেন দ্রুতই তার টাকা উঠে যাবে। কিন্তু এক-দুই বছরে যখন টাকা তুলতে পারছেন না, তারা তখন মানসিক বিষাদে ভোগেন। এর থেকে অনেকে নেশার জগতে চলে যাচ্ছেন। আর ইয়াবা সহজলভ্য হওয়ায় এতেই আসক্ত হচ্ছেন অনেক ভালো পরিবারের ছেলে। তবে আশঙ্কার কথা হলো, এমন আসক্ত কয়েকজন আমার সঙ্গে দেখা করেছে। তারা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সঙ্গে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন। মানসিক অবসাদে ভোগা এই লোকগুলো যে কোন সময় কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে। কারণ নেশাগ্রস্ত ব্যক্তিদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, তারা বিবেকহীন নিষ্ঠুর প্রকৃতির হয়।’
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অতি সম্প্রতি আওয়ামী লীগের একজন স্থানীয় নেতার ছেলেকে পুলিশ ভেরিফিকেশন রিপোর্টে জামায়াত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ ওই আওয়ামী লীগ নেতা স্থানীয় পুলিশ সদস্যের চাহিদা মতো টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ওই নেতার বক্তব্য ছিল এমন- আমরা আওয়ামী লীগ করি, আমাদের মাধ্যমেই আজ আওয়ামী লীগ এই জায়গায়। এর জন্য আমরা জেল খেটেছি, নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। এখন ছেলের যোগ্যতা দিয়ে চাকরি হবে তার জন্য পুলিশকে ঘুষ দিতে হবে- এটা কেমন কথা। আর ৫০ হাজার – এক লাখ হলে কথা ছিল। এখন পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরি নিতেও ১০ লাখ টাকা ঘুষ দিতে হয়। এসআই বা সার্জেন্ট পদে ঘুষের পরিমাণ ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। এই টাকা আমরা কিভাবে দেব? অবৈধ উপার্জন ছাড়া দুই তিন একর জমি বেঁচেও তো টাকার জোগাড় হবে না। ফলে যাদের টাকা আছে তারা চাকরি পাচ্ছে। আর পদ-পদবি থাকার পরও আমরা হয়ে যাচ্ছি জামায়াতের লোক। এভাবে তো দিনের পর দিন চলতে পারে না, সরকারকে অবশ্যই এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
সরকারের প্রশাসনে, দফতর-অধিদফতরের সর্বত্রই এখন চলছে একচেটিয়া ঘুষের রাজত্ব। ঘুষের বাড়তি টাকা ছাড়া কোথাও কোনো কাজ হচ্ছে না। সরকারি সব সেক্টরেই নিয়োগ, বদলি, পোস্টিং- প্রতিটি ক্ষেত্রেই লাখ লাখ টাকা লেনদেন এখন খোলামেলা ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে সারা দেশে পুলিশ কনস্টেবল ও সাব-ইন্সপেক্টর পর্যায়ে নিয়োগ নিয়ে জেলায় জেলায় ঘুষের যে মেলা বসে তা নজিরবিহীন। ঘুষ লেনদেন ও ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে অনেক জেলায় এসপি ও এমপিদের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। শুধু নিয়োগ নয়, লোভনীয় স্থানে পোস্টিং পাওয়ার ক্ষেত্রেও রয়েছে আলাদা রেট। এখন আর ঘুষ নিতে কেউ রাখ-ঢাক করেন না।
এসব অনিয়ম, ঘুষ আর দুর্নীতির কারণে অনেক তরুণ মেধাবী সরকারি চাকরি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। প্রভাবশালীদের তদবিরের স্তূপ এখন নিয়োগদানকারী কর্তৃপক্ষের টেবিলে। মন্ত্রণালয় ও সংস্থায় নিয়োগ নিয়ে অভিযোগের অন্ত নেই। এই পরিস্থিতিতে জনবল নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠনের দাবি জোরালো হয়ে উঠছে। মাঝে মধ্যে সচিব সভায় নিয়োগে আলাদা কর্তৃপক্ষ গঠন নিয়ে আলোচনা হলেও তা কথার কথাই থেকে যাচ্ছে।
একজন বিশ্লেষক বলেন, ছোট বা বড় যে চাকরিই হোক যোগ্যতার ভিত্তিতে হওয়া উচিত। তা না হলে সমাজে বৈষম্য ও অসন্তোষ বাড়বে। চাকরির ক্ষেত্রে জঙ্গি-জামায়াত শিবিরের সংখ্যা হয়ে পড়বে সর্বাধিক। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়বে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাকরি প্রত্যাশীদের অভিযোগ থেকে জানা গেছে, সরকারি নিয়োগে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় প্রথম হয়েও অনেক ক্ষেত্রে চাকরি মিলছে না। অর্থ দিলেই মিলছে। এটি এখন ওপেন সিক্রেট। নিয়োগ-ঘুষ বাণিজ্য আগের সরকারের আমলেও ছিল। সেখানে জামায়াত-শিবির, বিএনপি ছাড়া আওয়ামী লীগ সমর্থক বা এর অঙ্গ সংগঠনের সদস্যদের
চাকরি পাওয়া ছিল দুঃসাধ্য।
সূত্র: ইত্তেফাক, 22/08/2017