দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকই রোগীদের দেওয়া ব্যবস্থাপত্রে (প্রেসক্রিপশন) ওষুধের জেনেরিক নাম লিখছেন না। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসকরা ওষুধের ব্র্যান্ড নাম ব্যবহার করছেন। তাই নিজের পছন্দ অনুযায়ী ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের নাম লিখে দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অভিযোগ উঠেছে, এতে করে অনেক নিম্নমানের প্রতিষ্ঠানের ওষুধও নিতে হচ্ছে রোগীদের।
চলতি বছর ৯ জানুয়ারি রোগীর ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি হয়। এক রিট আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি আবু তাহের মো. সাইফুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই রুল জারি করেন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য সচিব ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চার সপ্তাহের মধ্যে জবাব দেওয়ার নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তবে ওই ব্যাপারে শুনানি এখন পর্যন্ত হয়নি।
জেনেরিক নাম
যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) দেওয়া ধারণা অনুযায়ী ওষুধের জেনেরিক নাম হচ্ছে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধের রাসায়নিক নাম। ওই নাম বললে ওই ওষুধকে বিশ্বের যেকোনো জায়াগায় চেনা যাবে। ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান এসব ওষুধের ব্র্যান্ড নাম দেয়। কিন্তু এর নিচে লেখা থাকে ওষুধটির জেনেরিক নাম।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি ওষুধের জেনেরিক নাম প্যারাসিটামল। এই প্যারাসিটামল তৈরি করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারী অনেক প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান নাম দিয়েছে এইস। একই ওষুধ অন্য একটি প্রতিষ্ঠান তৈরি করেছে নাপা নামে। এখানে নাপা ও এইস হচ্ছে ব্র্যান্ড নাম। আর প্যারাসিটামল হলো জেনেরিক নাম।
অভিযোগ উঠেছে চিকিৎসকরা ব্যবস্থাপত্রে জেনেরিক নাম না লিখে ব্র্যান্ড নামই লিখছেন। আর এতে সরাসরিই চিকিৎসক কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের ওষুধ লিখে দিচ্ছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও বিক্রয় প্রতিনিধিদের (মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ) চাপেই জেনেরিক নাম লিখছেন না চিকিৎসকরা।
এ বিষয়ে কথা হয় একাধিক বিক্রয় প্রতিনিধির। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাঁদের একজন বলেন, ‘জেনেরিক নামে ওষুধ লিখলে তো ডাক্তারদের আয় কমে যাবে। তখন উনারা আর কোম্পানির লোকদের কাছে পেইড ডাক্তার থাকবেন না।’
‘এটা লেখা নিয়ে কোনো নির্দেশনা নেই’
জেনেরিক নাম লেখা হয় কি না এ ব্যাপারে একাধিক চিকিৎসকের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘আসলে এটা লেখা নিয়ে আমাদের তেমন কোনো নির্দেশনা নেই। বাংলাদেশে জেনেরিক নাম লিখলেও সমস্যা না লিখলেও সমস্যা। এই অবস্থায় কি করা হবে সেটা পরিচালকরাই ভেবে দেখবেন।’
এ ব্যাপারে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. গোলাম কিবরিয়ার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অবশ্যই জেনেরিক নামে ওষুধ লেখা উচিত। তবে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটা বেশ কঠিন কাজ। জেনেরিক নামে লেখা শুরু হয়ে গেলে অনেকগুলো তুলনা মূলক খারাপ ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে কারণ তখন সবাই শুধু ভালো প্রতিষ্ঠানের দিকেই ঝুঁকবে। তবে তখন কিছু অসৎ ব্যবসায়ী বেশি মুনাফার জন্য যে কোনো তুলনা মূলক খারাপ ওষুধ বিক্রি করবে না এটা ভাবা যাবে না। এ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে আমরা মহাপরিচালকের সঙ্গে কথা বলব।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে ওষুধের শুধু জেনেরিক নাম লেখা বেশ কঠিন একটা ব্যাপার। ওষুধের দোকানের লোকজন তো বেশি শিক্ষিত না যে তাদের উপর সব কিছু ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে।’
‘জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন হলে তো খারাপ না’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আব্দুর রব বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করবো। আমরা শুধু সরকারি হাসপাতালগুলোতে ভালো ভাবে দেখতে পারব কিন্তু বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে সেভাবে তদারকি করতে পারব না।’
বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সভাপতি ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দীন বরেন, ‘যেহেতু ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সেহেতু এটা নিয়ে আমাদের ভাবা উচিত।’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) উপাচার্য ডা. কামরুল হাসান খান বলেন, বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী মাল্টি ন্যাশনাল বিজনেস সিস্টেমের কারণে এটা করা বেশ কঠিন কাজ তবে অসম্ভব নয়। জেনেরিক নামে প্রেসক্রিপশন হলে তো খারাপ হয় না। যার যার ইচ্ছে মতো ওষুধ কিনতে পারবে।’
গত ২ জানুয়ারি চিকিৎসকদের ব্যবস্থাপত্র সম্পর্কে হাইকোর্টে রিট করেন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে (এইচআরপিবি) আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৯ জানুয়ারি ব্যবস্থাপত্রে ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না- তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
এ ব্যাপারে মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। বিচারকার্য শেষ হলেই আশা করছি ওষুধের জেনেরিক নাম লিখতেও হাইকোর্ট নির্দেশনা দেবেন।’