চারপাশে শুধুই গোলাগুলি আর ভারী অস্ত্রের ঝনঝনানি। যত দূর দেখা যায় তত দূর কেবল আগুনের লেলিহান শিখা আর আকাশ অন্ধকার করা কালো ধোঁয়া। মিয়ারমারের সরকারি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ আর নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে যেদিকে পারছে প্রাণ হাতে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু রাখাইন রাজ্যের বলিবাজার গ্রামের জাফর আলমের বাড়িতে অসুস্থ মা: কী করবেন, কোথায় যাবেন, সেটাই তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না। কোনও উপায় না দেখে সব সহায় সম্পদ ফেলে মা আছিয়া খাতুনকে কাঁধে তুলে নিয়ে বাড়ি ছাড়েন জাফর। প্রাণের ভয়ে কয়েকদিন রাখাইন রাজ্যের এদিকে ওদিক ছুটে এক পর্যায়ে অন্যান্যদের সঙ্গে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগ পান। এরপর মাকে কাঁধে নিয়ে ৬৫ কিলোমিটার পথ হেঁটে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন তিনি।
নিজের মাকে বহন করে দেশ ছেড়ে আসার দুর্বিষহ এ অভিজ্ঞতার কথা বুধবার (৬ সেপ্টেম্বর) জানান জাফর আলম।
জাফরের বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বুধবার বিকালে উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সামনে এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় তার। জাফর আলম জানান, তার মায়ের নাম আছিয়া খাতুন। বয়স ৮০ পেরিয়ে গেছে। অসুস্থতার কারণে কথা বলতে পারেন না খুব একটা। বৃদ্ধার দুই ছেলে ও পাঁচ মেয়ের মধ্যে জাফরই সবার ছোট।
মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে আসার ব্যাপারে জাফর বলেন, ‘বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের নো-ম্যানস ল্যান্ড থেকে রাখাইন রাজ্যে অবস্থিত তার গ্রামের বাড়ি বলিবাজারের সঠিক দূরত্ব আমার জানা নেই। তবে লোকে মুখে শুনেছি সীমান্ত থেকে বলিবাজারের দূরুত্ব ৬০ থেকে ৬৫ কিলোমিটার হবে। পায়ে হেঁটে গেলে দু’দিন লাগে। আঁকা-বাঁকা পথ, বেশির ভাগ এলাকায় যানবাহন নেই। যতটুকু রাস্তায় যানবাহন চলাচল করতো, তাও এখন বন্ধ করে দিয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়াও পথে পথে চেকপোস্ট। এ কারণে বিকল্প পথ হিসেবে পাহাড়-জঙ্গল পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে আমাদের। এজন্য সময় লেগেছে পাঁচ দিন।’
তিনি আরও বলেন, ‘এতো দিনের এই দৌড়ঝাঁপের কারণে আমার মা আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনাহারে অর্ধাহারে সঙ্গে থাকা অন্যান্যদের সহযোগিতায় কোনও মতে নো-ম্যানস ল্যান্ডে পৌঁছেছি। সেখানে একদিন অবস্থান নেওয়ার পর ৫ সেপ্টেম্বর কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পের বস্তিতে উঠি। তবে মায়ের অবস্থা খারাপ হওয়ায় তাকে আবারও কাঁধে নিয়ে কুতুপালং ক্যাম্পের ‘এমএসএফ’ হাসপাতালে আসি। এতো মানুষের ভিড়ে কবে ডাক্তারের দেখা পাবো জানি না।’
উল্লেখ্য, গত ২৪ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশ পোস্টে হামলা চালায় সে দেশের একটি বিদ্রোহী গ্রুপ। এতে ১২ পুলিশ সদস্যসহ অনেক রোহিঙ্গা হতাহত হয়। এ ঘটনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে অভিযানের নামে সাধারণ মানুষ ওপর হত্যা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে আগুনসহ নানা ধরণের নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে দেশটির আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। এ কারণে প্রতিদিন পালিয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিচ্ছেন হাজার হাজার রোহিঙ্গা।
জাতিসংঘের তথ্যমতে এ পর্যন্ত এক লাখ ২০ হাজার মানুষের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করার কথা বলা হলেও স্থানীয়দের দাবি এই সংখ্যা দুই লাখের ওপরে। এছাড়াও নাফ নদীর জল সীমানা থেকে শুরু করে স্থল সীমানা পার হয়ে নো-ম্যানস ল্যাণ্ডে অবস্থান নিয়েছে আরও হাজার হাজার রোহিঙ্গা। এর আগে গত বছরের ৯ অক্টোবরের পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে একইভাবে হামলার ঘটনা ঘটে। সেসময় প্রাণ ভয়ে পালিয়ে আসে প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা। এরপর আন্তর্জাতিক মহল নানাভাবে চাপ সৃষ্টি করে মিয়ানমার সরকারের ওপর। কিন্তু তার কোনও তোয়াক্কা না করে রাখাইন রাজ্যে ফের সেনা মোতায়েন করলে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহী গ্রুপ।