জাতীয় সংসদ কোটিপতিদের ক্লাবে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। এছাড়া নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে এবং কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না দিলে, সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন সুজন নেতারা।
শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন-এর উদ্যোগে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সুস্পষ্ট করণীয় শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে সুজন নেতারা এ মন্তব্য করেন।
সুজন সভাপতি এম হাফিজ উদ্দিন খানের সভাপতিত্বে ও সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত এ গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনায় অংশ নেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন, সুজন নির্বাহী সদস্য সৈয়দ আবুল মকসুদ, আলী ইমাম মজুমদার, ইঞ্জিনিয়ার মুসবাহ আলীম ও আক্কাস হোসেন, সহ-সম্পাদক জাকির হোসেন, আবুল হাসান চৌধুরী, বিশ্বাস লুৎফর রহমান, মুহাম্মদ আব্দুল ওদুদ, সাইফুদ্দিন আহমেদ প্রমুখ। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুজন কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপকুমার সরকার।
মূল প্রবন্ধে দিলীপকুমার সরকার বলেন, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী, অর্থাৎ সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ ২৮ জানুয়ারি ২০১৯-এর মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে। আর সংবিধানের ১১৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, এ নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তবে নির্বাচন মানেই সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। শুধু তাই নয়, নির্বাচন বলতে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনও। তাই প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার দায়িত্বও নির্বাচন কমিশনের এবং এ লক্ষ্যে কমিশনকে সব প্রতিযোগীর জন্য সমান সুযোগ বা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির উদ্যোগ নিতে হবে।
তিনি বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। আর এই ভোটার তালিকা প্রণয়ন নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। আমরা দেখছি, ২০০৮-এর পরে ভোটার তালিকায় হালনাগাদ প্রক্রিয়ায় অপেক্ষাকৃত কমসংখ্যক নারী অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে, যার ফলে জেন্ডার-গ্যাপ নারীর জন্য ক্রমাগতভাবে প্রতিকূল হয়ে পড়ে। যেমন, ২০১৫-১৬ সালের তথ্যানুযায়ী পুরুষের তুলনায় ২৬ শতাংশ কম নারী ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হন। ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় বাড়ি বাড়ি গিয়ে তথ্য সংগ্রহ ও তালিকাভুক্তির কথা থাকলেও, সাম্প্রতিক অতীতে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি যাননি বলে অভিযোগ উঠেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ত্রুটিপূর্ণ ভোটার তালিকা দিয়ে নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
তিনি আরো বলেন, নির্বাচনী এলাকার সীমানা পুনঃনির্ধারণ নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব। কয়েকটি সুস্পষ্ট মানদণ্ডের ভিত্তিতে তা করা হয়, যার একটি হলো সংসদীয় আসনগুলোতে জনসংখ্যায় যতদূর সম্ভব সমতা আনা। তবে গণমাধ্যমের প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে আমরা জানতে পেরেছি, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণের জন্য একটি আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে। এই আইনটি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যমান সীমানাতেই অর্থাৎ ২০১৩ সালের নির্ধারিত সীমানার ভিত্তিতেই একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দুর্ভাগ্যবশত ২০১৩ সালের পুনঃনির্ধারিত সীমানা নিয়ে অনেক গুরুতর অভিযোগ ও সমস্যা রয়েছে। তাই ২০১৩ সালের নির্ধারিত সীমানার ভিত্তিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হতে বাধ্য।
ভোটারদের তথ্যভিত্তিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে তিনি বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের আইনে হলফনামার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হলেও, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তা বাদ রাখা হয়েছে। আমরা মনে করি, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও প্রার্থী কর্তৃক হলফনামা দেয়ার বিধান যুক্ত হওয়া উচিত। হলফনামার বিধানটি সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে, যদি নির্বাচন কমিশন এগুলোর সঠিকতা যাচাইয়ের উদ্যোগ নেয়; এবং সে ক্ষমতা কমিশনের রয়েছে। নির্বাচন কমিশন হলফনামার তথ্য খতিয়ে দেখার সিদ্ধান্ত নিলে অনেক বসন্তের কোকিল ও অবাঞ্ছিত ব্যক্তিকেই নির্বাচনী অঙ্গন থেকে দূরে রাখা যাবে। তাই আমরা মনে করি, হলফনামায় প্রদত্ত তথ্য কঠোরভাবে যাচাই-বাছাই করা আবশ্যক। এছাড়া হলফনামার ছকটিও অসম্পূর্ণ এবং এতে গুরুতর সীমাবদ্ধতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
নির্বাচনী ব্যয় হ্রাস ও নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে দিলীপ কুমার সরকার বলেন, নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিগত কমিশন এ ব্যয়সীমা ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা করেছে। এর ফলে সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার থাকলেও তারা প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই কমিশনকে নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং একইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধ সীমা কমাতে হবে।
পরিশেষে তিনি বলেন, এটি সুস্পষ্ট যে, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ করণীয় রয়েছে। তবে নির্বাচনকালীন প্রশাসন ও আইনশৃংলা রক্ষাকারী বাহিনী তথা সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করলে এবং কমিশনকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা না দিলে, সবচেয়ে শক্তিশালী ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পক্ষেও সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা প্রায় অসম্ভব।
এম হাফিজ উদ্দিন খান বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেই হবে না, নির্বাচন হতে হবে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য এবং নির্বাচনে সব নাগরিকের ভোটাধিকারও থাকতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবার করণীয় রয়েছে, সবচেয়ে বেশি ভূমিকা নির্বাচন কমিশনের।
তিনি আরো বলেন, বর্তমানে সাংবিধানিক বিধান অনুযায়ী সংসদের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই পরবর্তী মেয়াদের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং তা বর্তমান সংসদ বহাল রেখেই। এই বিধান বহাল রেখেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে লেভেল প্লেইং ফিল্ড বা সবার জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করা দুরূহ হবে। আর সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠান হবে সুদূরপরাহত।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিবর্তন, প্রশাসনের রাজনীতিকরণ, নির্বাচন কমিশন গঠন, নিরাপত্তা ইস্যুতে যতদিন পরিবর্তন না আসবে ততদিন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন প্রায় অসম্ভব। কেননা আমাদের বাজেটের ৭৫ শতাংশ ব্যয় হয় নিরাপত্তা খাতে। ২০১৪ সালে যে নির্বাচন হয় সেখানে ১৫৩ জন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিল, সেই নির্বাচনেও নিরাপত্তা খাতে ৩৩০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে, যা সত্যিই অবিশ্বাস্য।
ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধসীমা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বিগত কমিশন এ ব্যয়সীমা ১৫ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকা করেছে। ফলে সাধারণ নাগরিকদের ভোটাধিকার থাকলেও প্রতিনিধি হওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আর জাতীয় সংসদ পরিণত হয়েছে কোটিপতিদের ক্লাবে। বস্তুত আমাদের বর্তমান ব্যবস্থা হয়ে পড়েছে বেস্ট ডেমোক্রেসি মানি ক্যান বাই। তাই কমিশনকে নির্বাচনী ব্যয়ের লাগাম টেনে ধরতে হবে এবং একইসঙ্গে নির্বাচনী ব্যয়ের বৈধসীমা কমাতে হবে।
তিনি আরো বলেন, নির্ভুল ভোটার তালিকা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের প্রধানতম পূর্বশর্ত। আর এজন্য প্রয়োজন ভোটার সংখ্যার মধ্যে যতদূর সম্ভব সমতা আনা। ২০০৮ ও ২০১৩ সালের মধ্যে ভোটার সংখ্যার পার্থক্য বেড়ে গেছে। সুতরাং বিদ্যমান ভোটার তালিকা অনুযায়ী নির্বাচন হলে তা প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।
সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, সবার অংশগ্রহণে সংসদ নির্বাচন আয়োজনে কমিশনকে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে, তা তাদেরই অনুধাবন করতে হবে এবং সবাইকে তা জানাতে হবে। নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপের পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনের উচিত জেলা প্রশাসক ও পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে সংলাপ করা।
আলী ইমাম মজুমদার বলেন, আমরা দেখছি, নির্বাচনী ব্যয়ের রিটার্ন নির্বাচন কমিশন যাচাই-বাছাই করে না, কিন্তু তারা যদি এটি যাচাই-বাছাই নাই করবে, তাহলে তারা এটি জমা নেয় কেন?
তিনি ভারতের নির্বাচন কমিশনের জনবলের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, আমাদের নির্বাচন কমিশনের জনবল প্রায় সাত হাজার ছাড়িয়ে গেছে, তাহলে নির্বাচনী কর্মকর্তারা কেন হলফনামা বা ব্যয়ের রিটার্ন যাচাই-বাছাই করতে পারবে না, তা আমার বোধগম্য নয়।
নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের সহযোগিতার প্রয়োজন মনে করে তা তারা চাইতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আবুল হাসান চৌধুরী বলেন, গণতন্ত্র মানে শুধু সরকার ও বিরোধী দল নয়। গণতন্ত্রের প্রতি সবার আনুগত্য ও মমত্ববোধ থাকতে হবে। আমরা একটি সত্যিকারের নির্বাচন চাই। তিনি নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সোশ্যাল কন্ট্রাক্ট-এ যাওয়া যায় কি না- সে ব্যাপারে সুজন-এর প্রতি আহ্বান জানান।