মিয়ানমারের জাতিসংঘ কার্যালয়ের কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ইস্যু ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জাতিসংঘ এবং বিভিন্ন ত্রাণ সংস্থার একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে বিবিসির প্রতিবেদক জোনাহ ফিশারের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
জাতিসংঘের সাবেক এক কর্মকর্তা বলেছেন, মিয়ানমারে জাতিসংঘের কার্যালয়ের প্রধান মানবাধিকারকর্মীদের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের এলাকা পরিদর্শনে বাধা দিচ্ছেন।
গতকাল বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, রাখাইনে সেনাবাহিনীর অভিযানে সহিংসতার শিকার হয়ে গত ২৫ আগস্ট থেকে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।
তবে বিবিসির এই তথ্যের সঙ্গে জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করেছে জাতিসংঘের মিয়ানমার কার্যালয়।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গত মাস থেকে রোহিঙ্গা মুসলমানরা যখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসতে শুরু করে তখন জাতিসংঘ বেশ সক্রিয়ভাবে এর প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। সেই সঙ্গে সংস্থাটি বিবৃতির মাধ্যমে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের এমন আচরণের জোরালো নিন্দাও জানিয়েছে।
কিন্তু সূত্র বলছে, বর্তমান এই রোহিঙ্গা সংকটের চার বছর আগে থেকেই মিয়ানমারে জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমের (ইউএনসিটি) প্রধান রেনেটা লক-ডেসালিয়েন রোহিঙ্গাদের এলাকায় মানবাধিকারকর্মীদের প্রবেশে বাধা দিয়েছেন। এ ছাড়া এই বিষয়টির ওপর জনসমর্থন তৈরি বন্ধ করতে পদক্ষেপ নিয়েছেন এবং কর্মকর্তাদের এই ইস্যু থেকে দূরে রেখেছেন কানাডার নাগরিক ডেসালিয়েন।
ক্যারোলিন ভ্যানডেনাবিলি নামের এক সহায়তাকর্মী জানিয়েছেন, রাখাইনে তিনি ভয়ঙ্কর কিছুর ইঙ্গিত দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি ১৯৯৩ সালের শেষে এবং ১৯৯৪ সালের শুরুতে আফ্রিকার দেশ রুয়ান্ডাতে গণহত্যা চলাকালীন কাজ করেছেন। এরপর ক্যারোলিন যখন প্রথম মিয়ানমারে আসেন, তখন সেখানেও তিনি রুয়ান্ডার সঙ্গে উদ্বেগজনক মিল খুঁজে পান।
ক্যারোলিন বলেন, “একবার আমি বিদেশিদের একটি দলের সঙ্গে ছিলাম এবং মিয়ানমারের ব্যবসায়ীরা রাখাইন এবং রোহিঙ্গাদের বিষয়ে কথা বলছিলেন। মিয়ানমারের এক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘আমাদের উচিত কুকুরের মতো তাদের (রোহিঙ্গা) সবাইকে মেরে ফেলা।’” তিনি বলেন, মানুষের প্রতি অমানবিকতার একটি নিদর্শন।
বিবিসির প্রতিবেদক জোনাহ ফিশার দীর্ঘ এক বছর ধরে ক্যারোলিনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। ক্যারোলিন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, রুয়ান্ডা ও নেপালের সংঘাতপ্রবণ এলাকায় কাজ করেছেন।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১২ সালে রাখাইনে রোহিঙ্গা এবং বৌদ্ধদের মধ্যে সংঘর্ষে শতাধিক মানুষ মারা যায় এবং ১০ হাজারের অধিক রোহিঙ্গা রাজ্যের রাজধানী সিত্তের আশপাশে আশ্রয় নেয়। এরপর থেকেই বিদ্রোহের উত্থান হতে থাকে। গত বছর রোহিঙ্গাদের একটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর উত্থান হয়েছে। রাখাইনের বৌদ্ধদের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য সহায়তা কার্যক্রমে জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। তারা রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ সরবরাহকে ক্ষতিকর মনে করছে, একইভাবে তারা এই কার্যক্রমে বাধা দিচ্ছে। এমনকি ত্রাণের গাড়িগুলোতেও হামলা করছে বৌদ্ধরা।
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের গ্রাম পরিদর্শনের সময় জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের বাধা দেওয়ার বিষয়ে কথা বলেছেন থমাস কিনটানা নামের সংস্থাটির এক কর্মকর্তা। বর্তমানে তিনি উত্তর কোরিয়ায় জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে কর্মরত। ২০১৪ সাল পর্যন্ত ছয় বছর মিয়ানমারেও একই পদে কর্মরত ছিলেন কিনটানা।
আর্জেন্টিনা থেকে বিবিসির প্রতিবেদক জোনাহ ফিশারকে কিনটানা বলেন, মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুন বিমানবন্দরে তাঁর সঙ্গে ডেসালিনের দেখা হয়েছিল।
‘আমি তাঁর কাছ থেকে উপদেশ পেয়েছিলাম- তিনি বলেছিলেন তোমার রাখাইনে যাওয়া উচিত হবে না, দয়া করে তুমি সেখানে যেও না। সুতরাং আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন, এর কোনো সদুত্তর ছিল না। সেখানে শুধুমাত্র এই বিষয়টিই ছিল যে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো সমস্যায় যাওয়া যাবে না’, বলেন থমাস কিনটানা।
তবে জাতিসংঘ বলছে, ডেসায়িলেনকে অন্যত্র পাঠানো হয়েছে। এর সঙ্গে তাঁর পারফর্মেন্সের কোনো সম্পর্ক নেই।
তবে এ ব্যাপারে বিবিসির কাছে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি ডেসালিয়েন।
ইয়াঙ্গুনে জাতিসংঘ কার্যালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘আবাসিক সমন্বয়কারীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ আলোচনার বিষয়ে বাধা দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে আমরা জোরালোভাবে দ্বিমত পোষণ করছি। আবাসিক সমন্বয়কারী নিয়মিতভাবেই মিয়ানমারের জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করেছেন কীভাবে রাখাইন রাজ্যে শান্তি, নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনা যায়।’
ওই মুখপাত্র আরো বলেন, থমাস কিনটানা রাখাইন পরিদর্শনের সময় ডেসালিয়েন তাঁকে পরিপূর্ণ সহায়তা দিয়েছেন। লোকবল, নিরাপত্তাসহ নানা বিষয়ে দিয়েছেন।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযান শুরুর পর থেকে প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচনা ও নিন্দার মুখে পড়লেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি মিয়ানমার সরকার।