নিজস্ব প্রতিবেদক : স্কুলের সুনাম দেখানোর জন্য কিছু শিক্ষক, সামাজিকভাবে সম্মান অর্জনের জন্য কিছু অভিভাবক আর অর্থলোলুপ কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী – এই তিনের ষঢ়যন্ত্রে কত গরিব মেধাবী শিক্ষার্থী যে প্রাথমিক সমাপনী বৃত্তি বঞ্চিত হচ্ছে তার কোন ইয়াত্তা নেই। কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রির সময় নম্বর বাড়িয়ে অযোগ্যদের বৃত্তি পাইয়ে দেয়ার নামে দীর্ঘদিন ধরে একটি চক্র বিপুল পরিমাণ অর্থ বাণিজ্য করে আসছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এর ফলে অনেক যোগ্য শিক্ষার্থী হয় ট্যালেন্টপুলের পরিবর্তে সাধারণ গ্রেডে আবার অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী হয়ত কোন বৃত্তিই পাচ্ছে না যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও। সাতক্ষীরায় এই চক্রটি আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
আগামী ১৯ নভেম্বর থেকে দেশ ব্যাপী অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা। আর এই (একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা) প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বৃত্তি ও এ+ পাইয়ে দেওয়ার জন্য সাতক্ষীরায় শক্তিশালী একটি জালিয়াত চক্র সক্রিয় হয়ে উঠেছে। এদের নেটওয়ার্ক জেলা ব্যাপী বিস্তৃত।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা পদ্ধতি চালু হয়। এটি কোমমতি একজন শিক্ষার্থীর জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষা।
বিগত কয়েক বছর ধরে সাতক্ষীরা জেলা ব্যাপী একটি জালিয়াত চক্র প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় বৃত্তি ও এ+ পাইয়ে দেওয়ার কথা বলে কোমলমতি শিশুদের অভিভাবকদের কাছ থেকে মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে। তারা মাথাপ্রতি ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার পর যোগসাজশে কৌশলে কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রির সময় নাম্বার বাড়িয়ে দিয়ে তুলনামূলক কম মেধাবী শিক্ষাথীদেরকে বৃত্তি ও এ+ পাইয়ে দিচ্ছে। এমনকি যেসব শিক্ষকের কাছে এসব ছাত্র-ছাত্রীদের খাতা যাচ্ছে তাদের খুঁজে বের করে তাদের সাথেও চক্রটি যোগাযোগ করে নাম্বার বাড়িয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। ফলে প্রকৃত মেধাবীরা জীবনের প্রথম পাবলিক পরীক্ষায় ধাক্কা খাচ্ছে, হচ্ছে চরম প্রতারণার শিকার। একই সাথে তারা হতাশ হয়ে শিক্ষা জীবনে পিছিয়ে পড়ছে, হারাচ্ছে মনোবল।
প্রতারক ওই চক্রের সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা অফিসের দুর্নীতিবাজ কতিপয় শিক্ষা কর্মকর্তা ও কতিপয় শিক্ষক জড়িত বলে জানা গেছে।
গত বছর (২০১৬ সালে) সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ উপজেলার ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (বর্তমানে খুলনার ডুমুরিয়ায় কর্মরত) শেখ ফারুক হোসেন ও উপজেলা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ভবদেশ সরকারের বিরুদ্ধে ৯৭ জন শিক্ষার্থীর কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রির সময় নম্বর পরিবর্তনের অভিযোগ ওঠে। কালিগঞ্জের বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল হাকিম জানান, অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ইতোমধ্যে নির্দেশ দিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এছাড়া পরিবর্তীত টেবুুলেশন শিট পরিবর্তন করে যারা প্রকৃত বৃত্তি ও এ+ পাওয়ার যোগ্য তাদেরকেই দেওয়ার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
সাতক্ষীরা সদর উপজেলায় প্রতারক ওই জালিয়াত চক্রটি বেশ আগে থেকেই সুকৌশলে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছে। বৃত্তি ও এ+ পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাস দিয়ে তারা প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। কৌশলে কম্পিউটারে ডাটা এন্ট্রির সময় নম্বর বাড়িয়ে বৃত্তি ও এ+ পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থাও করছে তারা।
সরকারি নিয়ত অনুযায়ী এক উপজেলার পলীক্ষার খাতা অন্য উপজেলার শিক্ষকরা দেখবে। উপজেলা শিক্ষা অফিস থেকে অন্য উপজেলায় খাতা পাঠানোর সময় প্রতিটি পরীক্ষার খাতায় একটি কোর্ড নাম্বার বসবে, যা উপজেলা শিক্ষা অফিসে সংরক্ষণ থাকবে। পরবর্তী নাম্বার আসার পর উপজেলা ডাটা এন্ট্রি অপারেটর কোর্ড নাম্বার অনুযায়ী প্রথমে ডাটা এন্ট্রি করে একটি খসড়া টেবুলেশন শিট তৈরি করবেন। টেবুুলেশন শিট তৈরীর সময় সংশ্লিষ্ট উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা শিক্ষা অফিসার ও ডাটা এন্ট্রি অপারেটর ছাড়া আর কেউ তা জানতে পারবে না। এটি চেক ক্রস চেক করে তাদের তিন জনের স্বাক্ষরে তা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে পাঠাতে হবে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস উপজেলা শিক্ষা অফিসের ওই টেবুলেশন শিট প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে পাঠানোর ব্যবস্থা করবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত নাম্বারের ভিত্তিতে ফলাফল (ইউনিয়ন কোটা অনুযায়ী বৃত্তি ও এ+ সহ ) ঘোষনা করা হবে।
প্রতারক চক্রটি উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে যখন টেবুলেশন শিট তৈরী হয় তখন মূলত: সুকৌশলে নাম্বার বাড়ানোর ব্যবস্থা করে থাকে।
চলতি বছরও জালিয়ত চক্রটি প্রতারণার জাল ফেলেছে। ধরা না পড়লেও তাদের নেটওয়ার্ক বেশ শক্তিশালী। বড় বড় রাঘোব বোয়ালরা এই প্রতারণার সাথে জড়িত বলে জানাগেছে।
জি. গাইন ও এম. ইসলাম নামের দুই শিক্ষা কর্মকর্তা , গোপাল ও শফিউল নামের দুই সহকারী শিক্ষক এবং কৃঞ্চ নামের এক ডাটা এন্ট্রি অপারেটর এই প্রতারক চক্রের মূল হুতা বলে জানাগেছে। জেলাব্যাপী তারা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।
আর তাদের এই অবৈধ কাজে ২০১৬ সালে যারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাদেরকে এবছর পরীক্ষার আগেই অন্যত্রে বদলির জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং শিক্ষা মন্ত্রনালয় পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানা গেছে।
গত বছর ( ২০১৬ সালে ) সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো: কামরুজ্জামান ও সাতক্ষীরা সদর উপজেলা রিসোর্স সেন্টারের সহকারী ইন্সট্রাক্টর মো: ইয়াছিন আলী চক্রটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। তাদের কারণে প্রতারণা করতে বেশ বাধাগ্রস্ত হয় চক্রটি। আর এ কারণে সম্প্রতি ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো: কামরুজ্জামান ও সহকারী ইন্সট্রাক্টর মো: ইয়াছিন আলীর বিরুদ্ধে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কৌশল অবলম্বর করে নানা ধরনের আপত্তিকর মন্তব্য করে ফেসবুকে তাদের বন্ধু মহলে পোষ্ট ছড়িয়ে দেয়। বিষয়টি নজরে আসার পর গত ২২ অক্টোবর সহকারি ইন্সট্রাক্টর ইয়াছিন আলী ‘তথ্য প্রযুক্তির অপ-ব্যবহার, তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকা এবং ব্লাক মেইল করার অভিযোগ এনে কুচক্রী মহলটিকে খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত প্রতিকার চেয়ে যথাযথ কর্র্তপক্ষের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বরাবর আবেদন করেছেন।
এদিকে, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক বরাবর গত ২০ সেপ্টেম্বর ডাকা এন্ট্রি অপারেটর মো: কামরুজ্জামান প্রতিকার চেয়ে পৃথক একটি আবেদন করেন। যেটি সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারের কার্যালয় হয়ে বর্তমানে সাতক্ষীরা সদর থানায় তদন্তাধীন রয়েছে। এছাড়া ডাটা এন্ট্রি অপারেটর মো: কামরুজ্জামান গত ২২ অক্টোবর সাতক্ষীরা পি.টি.আই অফিসের সুপাররিনটেনডেন্ট বরাবর আইনগত প্রতিকার পাওয়ার অনুমতি চেয়ে আরও একটি আবেদন করেছেন।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা পি.টি.আই অফিসের সুপারিনটেনডেন্ট মহাদেব ব্যানার্জী অভিযোগপত্র পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, আবেদনপত্র পেয়েছি। বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এদিকে, লিখিত আবেদনের ফলে ওই জালিয়াত চক্রটির দৌড়-ঝাঁপ বেড়ে গেছে। তারা নিজেদেরকে রক্ষা করার জন্য আবেদনকারীদের বিরুদ্ধে নানা ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। অভিযোগকারীদেরকে আগামী প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার আগেই সাতক্ষীরা থেকে অন্যত্রে বদলির জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে বলে তারা জানিয়েছেন।
সাতক্ষীরার অভিভাবক মহল এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো: মহিউদ্দিনের আশু দৃষ্টি কামনা করেছেন। যাতে এবছর ওই জালিয়াত চক্রটি জাল বিস্তার না করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে প্রত্যাশা অভিভাবকদের।