নিজস্ব প্রতিবেদক : সাতক্ষীরা সদর উপজেলার ধুলিহরে মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যান স.ম আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমাখানা পরিচালনার ক্ষেত্রে জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহবুবুর রহমানের সরকারি অর্থ অপচয়, জমি হস্তান্তর, শিক্ষক-কর্মচারিদের নিয়োগ,বেতন ভাতা প্রদানে অনিয়ম ও দূর্ণীতির অভিযোগে তদন্ত হচ্ছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের খুলনা বিভাগীয় পরিচালক হোসেন আলী খোন্দকার আগামি ৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের সম্মেলন কক্ষে এ তদন্ত শুরু করবেন।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের ষাটলিপিকার থেকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হয়ে এসএম মাহাবুবর রহমান একই স্থানে ২৭ বছর কাজ করার সুবাদে পেশী শক্তিকে ব্যবহার করে তিনি তার বাবার নামে মুক্তিযোদ্ধা চেয়ারম্যান স.ম আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানা তৈরি করে সভাপতি হয়ে জেলা পরিষদ থেকে নেওয়া ও প্রকল্প বরাদ্দ বাবদ কয়েক কোটি টাকা শিক্ষক- কর্মচারীদের বেতন, শিক্ষার্থীদের বোর্ডিং খরচ ও অবকাঠামো উন্নয়নের নামে বেআইনিভাবে অপচয় করছেন মর্মে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য গত ৮ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকে লিগ্যাল নোটিশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল। বিষয়টি অবগত হওয়ার পর গত ২৪ অক্টোবর ওই প্রতিষ্ঠান ও জেলা পরিষদের প্রশাসনিক কর্মকর্তা এসএম মাহাবুবর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত করার জন্য ওই দপ্তরের খুলনা বিভাগীয় পরিচালককে নির্দেশ দেন। এ চিঠি পাওয়ার পর খুলনা বিভাগীয় পরিচালক হোসেন আলী খোন্দকার গত ২৪ অক্টোবর এক চিঠিতে আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমাখানার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত অনিয়মে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, দলিলপত্রাদিসহ আগামি ৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ৯টায় উপস্থিত হয়ে তদন্ত কাজে সহযোগিতা করার জন্য অনুরোধ করেছেন। অ্যাড. সত্যরঞ্জন ম-ল, সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক, সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও খুলনা বিভাগীয় কমিশনারের একান্ত সচীবকে এ সংক্রান্ত চিঠি দেওয়া হয়েছে।
প্রসঙ্গত, জেলা পরিষদ আইন ২০০০ এর ২৭(৩) ধারা মোতাবেক প্রথম তফশীলের দ্বিতীয় অংশ ঐচ্ছিক কার্যাবলীর (গ) ২৬ মোতাবেক ২০১৩ সালের ৮ মে ও ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত জেলা পরিষদের সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ি ৪৮(২) গ ধারার বিধান রেজিস্ট্রি দলিল মূলে ধুলিহরে চেয়ারম্যান আব্দুর রউফ কমপ্লেক্সে ও এতিমাখানার স্থাবর সম্পত্তি জেলা পরিষদে দান সূত্রে নিয়ে জেলা পরিষদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। রেজিস্ট্রেশন পরবর্তী উক্ত প্রতিষ্ঠানের অস্থাবর সম্পত্তি সমূহ জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে নেয়া হয়। সেই থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানটি সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের নিজস্ব মালিকানায় ও অর্থায়নে পরিচালিত হচ্ছে।
অপরদিকে জেলা পরিষদ থেকে সংগৃহীত আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানা সম্পর্কিত কাগজপত্র ও চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি জেলা পরিষদ সদস্য মীর জাকির হোসেন, শিল্পী রানী মহালদার ও সৈয়দ আমিনুর রহমানের পরিদর্শন প্রতিবেদনের বিভিন্ন অংশে ভিন্নতা থাকায় জেলা পরিষদের টাকা তছরূপের বিষয়টি জেলাব্যাপী আলোড়ন তোলে। সরেজমিন পরিদর্শন প্রতিবেদনে প্রতিষ্ঠানটি ২০০৮ সালে প্রাথমিকভাবে স্থাপিত হয় ও ২০১৩ সালে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সমাজসেবা অধিদপ্তরের নিবন্ধন(সাত- ১১৭৭/২০১৩) লাভ করে। ওই প্রতিষ্ঠানে দানপত্রের মাধ্যমে এক একর ২৩ শতক জমি দেখানো হয়।
এদিকে জেলা পরিষদের প্রধান নির্বার্হী এ.এন.এম মঈনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত কাগজপত্র থেকে জানা গেছে ২০১২ সালে আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানার কার্যক্রম শুরু হয়। ২০১৩ সালের ১১ নভেম্বর দানপত্র দলিলমুলে সাড়ে ২০ শতক জমি জেলা পরিষদে দান করেন আব্দুর রউফ কমপ্লেক্সের পক্ষে ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি এসএম মাহবুবুর রহমান। এ ছাড়া আরো ছয়জন দাতা মিলে এক একর আড়াই শতক জমি দান করেছেন উল্লেখ করলেও তার কোন দলিল পত্র হদিস মেলেনি। এমনকি ৪৮৮০ নং দলিলমুলে যে সাড়ে ২০ শতক জমি হস্তান্তর দেখিয়ে ২৮৩৬/৪ যে নামপত্তন জারি করা হয়েছে তাতে এসএ দাগ ৭৪৩০ দেড় শতক ও ৭৪৩০ এবং ৭৪৩২ দু’টি দাগে সাড়ে ছয় শতক মিলে মোট আট শতক জমি মাহাবুবর রহমানের নামে নামপত্তন দেখানো হয়েছে। এসএ ৭৪৩০ দাগটি বর্তমান জরিপে ১০৮৬৪ দাগের মোট ৬৪ শতক সম্পত্তির মধ্যে দানকৃত সম্পত্তি সাড়ে ১৬শতক কবরস্থান। বর্তমান জরিপে এসএ ৭৫২৩ দাগটি বর্তমান জরিপে ১০৮৫৯ দাগের মোট ৯৪ শতক সম্পত্তির মধ্যে দানকৃত সম্পত্তি সাড়ে চার শতক ডাঙা। কিন্তু উক্ত চার শতক সম্পত্তির মালিক ধুলিহরের জনৈক আবুল কাশেম ও রাশিদা খাতুনের। ফলে ওই জমি জেলা পরিষদের নামে দান দেখানো হলেও তার কোন বাস্তবতা খুঁজে পাওয়া যায় না।
অপরদিকে পরিদর্শন প্রতিবেদনে আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানার নামে মোট জমির পরিমান এক একর ২৩ শতাংশ দেখানো হলেও জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ওই প্রতিষ্ঠানের জমির পরিমান দু’ একর ১৯ শতাংশ। যার কাগজপত্রের কোন বাস্তবতা মেলেনি। অথচ তৎকালীন জেলা পরিষদ কর্তৃপক্ষ উক্ত প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ভার চালানোর লক্ষ্যে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা ও ওই প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে দু’কেটি ১৬ লাখ ৪৫ হাজার টাকা অনুমোদন দিয়েছেন। অন্যদিকে পরিদর্শন প্রতিবেদনে অবকাঠামো ব্যয় দু’কোটি ৩৮ লাখ টাকা দেখানো হয়েছে।
পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী মতামত কলামে প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত সকল ব্যাংক হিসাব বন্ধ করে অন্যান্য সকল আয় জেলা পরিষদ তহবিলে জমা দেওয়ার ব্যবস্থার জন্য আলাদা একটি ব্যাংক হিসাব খোলার সুপারিশ করা হয়। কিন্তু জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী গত ২২ ফেব্রুয়ারি সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক উক্ত প্রতিষ্ঠানের আয়ের অর্থ জমা রাখার জন্য’ ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক লিঃ’ সাতক্ষীরা শাখায় হিসাব নং- ০১৪৬১২২০০০২০১৯৪ খোলা হয়েছে। যা জেলা পরিষদের নামে নয়। এ ছাড়া আব্দুর রউফ কমপ্লেক্ষ ও এতিমখানার আয়-ব্যয় জেলা পরিষদকে দেওয়া হয় না।
ওই প্রতিষ্ঠানটি জেলা পরিষদের মাধ্যমে পরিচালিত হলেও শিক্ষক -কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন সরকারি নিয়ম নীতি অনুসরণ করা হয়নি। আবার জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন নো ওয়ার্ক নো পে অনুযায়ী প্রদান করা হচ্ছে।
উক্ত প্রতিষ্ঠানে মাটিয়াডাঙা ও ধুলিহর গ্রাম থেকে ২০ জন করে ছাত্র ভর্তি দেখানো হয়েছে। এবং মোট ছাত্র ২২০ জন দেখানো হলেও বাস্তবে এ সংখ্যা অনেক কম।
২০১৩ সালে শুরু থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত জেলা পরিষদ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী শিক্ষক, কর্মচারীর বেতন ও ছাত্রদের বোর্ডিং খরচ বাবদ এক কোটি দু’ লাখ সাত হাজার ১৪৬ টাকা দেখানো হয়েছে। কিন্তু গত ১৯ ফেব্রুয়ারির পরিদর্শন প্রতিবেদন অনুযায়ী তার পরিমান এক কোটি ৫৭ লাখ ৭৮ হাজার ৮৭৬ টাকা। অর্থাৎ তিন মাস ১২ দিনে শিক্ষক কর্মচারিদের বেতন ও শিক্ষার্থীদের বোডিং খরচ তো লাগেই নি বরং জেলা পরিষদের দেওয়া পরিসংখ্যান পরিদর্শণ প্রতিবেদনের চেয়ে ৫৫ লাখ টাকা কম দেখানো হয়েছে যা ’ পুকুর চুরির সামিল। সেকারণে জেলা পরিষদ থেকে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে বরাদ্দকৃত ও প্রকল্প অনুমোদন বাবদ নিয়ম বহির্ভূতভাবে বরাদ্দকৃত সকল সরকারি অর্থ অবলিম্বে বন্ধ করে দেওয়া উচিত বলে জানান অনেকেই।
যদিও জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী এএনএম মঈনুল ইসলাম গত ৫ সেপ্টেম্বর সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে, দীর্ঘ সময় ধরে আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানাটি আইন অনুযায়ী পরিচালিত হচ্ছে। কবরস্থানের জমি হস্তান্তরযোগ্য দাবি করে তিনি বলেছিলেন আব্দুর রউফ কমপ্লেক্স ও এতিমখানার পক্ষে ‘ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকে’ যে হিসাব খোলা হয়েছে তা জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীর নামে।
পূর্ববর্তী পোস্ট