দলীয় সংসদ সদস্যদের আত্মবিশ্বাসী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে নিজ দলের নেতাদের নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান আত্মকলহ দূর করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
বুধবার রাতে জাতীয় সংসদ ভবনের সরকারি দলের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় অংশ নেয়া একাধিক সংসদ সদস্য এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
সূত্র জানায়, রাত ৮টার কিছু সময় পর সংসদীয় দলের সভা শুরু হয়। সভায় সংসদ সদস্যরা নিজ এলাকার বিভিন্ন সমস্যার কথা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে তারা মন্ত্রীদের বিষয়েও বিভিন্ন অভিযোগ করেন প্রধানমন্ত্রীর কাছে।
সংসদ সদস্যরা নিজ নির্বাচনী এলাকায় একাধিক প্রার্থীর প্রচারণা প্রসঙ্গে নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। কেউ কেউ অভিযোগ করে বলেন, একাধিক প্রার্থী নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে বর্তমান সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। এতে করে নিজেদের অবস্থান নষ্ট হচ্ছে।
একজন সংসদ সদস্য মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, আমার এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে চারজন মন্ত্রী টেলিফোন করে আমার কথা শুনতে নিষেধ করেছেন। একজন সংসদ সদস্য হিসেবে আমি ওই এলাকায় কীভাবে কাজ করব?
এ ধরনের বক্তব্যে দলের সিনিয়র সংসদ সদস্যরা বলেন, নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অধিকার সবারই আছে। নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থাকতে পারে, তবে সেটা যেন কোনো অবস্থাতেই নোংরামির পর্যায়ে চলে না যায়।
সংসদ সদস্য শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আমাদের দলের একজন নেতা সংবাদ সম্মেলন করে বলছেন, বিরোধী দলের কোন নেতার গাড়িতে আমাদের সংসদ সদস্য আগুন দিয়েছে। এই ধরনের কথা কারা বলাচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।
তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে আমরা হেরে যাইনি, আমাদের হারিয়ে দেয়া হয়েছে। আগামী নির্বাচন সামনে রেখে যে ষড়যন্ত্র হচ্ছে সে বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।
সভায় বক্তব্য রাখেন সিনিয়র সংসদ সদস্য তোফায়েল আহমেদ, গৃহায়ণমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, হুইপ আতিউর রহমান আতিক, এ কে এম শামীম ওসমান, আবদুর রহমান বদি, ইফতেখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু, ছানোয়ার হোসেন তুহিন, অনুপম শাজাহান জয় প্রমুখ।
দলের মধ্যে বিভেদ, দ্বন্দ্ব ও গ্রুপিং সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ার করে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বচ্ছ, পরিচ্ছন্ন ও গ্রহণযোগ্য নেতারাই আগামীতে মনোনয়ন পাবেন। দল যাকে মনোনয়ন দেবে তার পক্ষেই সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। প্রতি ছয় মাস অন্তর প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় আমি জরিপ করছি। মন্ত্রী-এমপিদের নির্বাচনী এলাকায় কার কী অবস্থান তার আমলনামা আমার কাছে আছে। জনপ্রিয়তার ব্যারোমিটার বাড়ান, জনপ্রিয়তা ব্যারোমিটারে যারা এগিয়ে রয়েছেন তারাই মনোনয়ন পাবেন। কারো মুখ দেখে আমি মনোনয়ন দেব না। যারা এলাকায় নিজেদের অবস্থান বা গ্রহণযোগ্যতা রক্ষা করতে পারেননি, তিনি যত বড়ই নেতা হোন না কেন আগামী মনোনয়ন পাবে না। তাই কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে দলের পক্ষে ঐক্যবদ্ধভাবে সবাই কাজ করতে হবে।
তিনি বলেন, আমাদের আগামী নির্বাচনে জয়ী হতে হবে। নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড তুলে ধরুন। পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের ধ্বংসাত্মক রাজনীতি, জ্বালাও-পোড়াও তুলে ধরুন। নিজেদের মধ্যে কোন্দল করে লাভ নেই। কাকে মনোনয়ন দেয়া হবে সে বিষয় আমি দেখব।
শেখ হাসিনা বলেন, কারো মুখ দেখে আমি মনোনয়ন দিতে পারব না। সবাই কাজ করছে, আমি নিয়মিত বিষয়টি মনিটরিং করছি। জনপ্রিয়তার ভিত্তিতেই আমি মনোনয়ন দেব। কাঁদা ছোঁড়াছুড়ি বন্ধ করে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ষড়যন্ত্র অতীতেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এ সকল ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী আত্মবিশ্বাসী হয়ে নির্বাচনী এলাকায় জনগণের দ্বারে দ্বারে গিয়ে নৌকা মার্কার পক্ষে ভোট চাওয়ার জন্য দলীয় সংসদ সদস্যদের প্রতি নির্দেশ দিয়ে বলেন, বর্তমান সরকার গত ৮ বছরে দেশের যত উন্নয়ন করেছে, গত ৪০ বছরে অন্য সরকারগুলো তা করতে পারেনি। তাই ভোটে বিজয়ী হওয়ার আত্মবিশ্বাস নিয়েই নির্বাচনী এলাকায় কাজ করে যান। দেশের জনগণ আমাদের পক্ষেই রয়েছেন। ইনশাল্লাহ আগামী নির্বাচনেও জনগণের ভোটে আমরা বিজয়ী হব।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, আর কোনো সময় অপচয় নয়, নির্বাচনী এলাকায় জনগণের ঘরে ঘরে গিয়ে তাদের মন জয় করার চেষ্টা করুন। মনে রাখবেন, সবার আমলনামা আমার হাতে রয়েছে। আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধ থাকলে আমাদের কেউ পরাজিত করতে পারবে না। তাই এলাকার যার জনপ্রিয়তা রয়েছে, দলের নেতাকর্মী, সমর্থক ছাড়াও জনগণ যার সঙ্গে রয়েছে- তিনিই আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন পাবেন। দলের মধ্যে কোনোরূপ দ্বন্দ্ব-বিবাদ বা কোন্দলে জড়িত হবেন না। দল যাকে মনোনয়ন দেবে, তার পক্ষেই কাজ করতে হবে। দলের বিরোধিতাকারীদের ক্ষমা করা হবে না।
নির্বাচনী প্রচারে সরকারের ব্যাপক উন্নয়নের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত জোটের দুর্নীতি-দুঃশাসন, অগ্নিসন্ত্রাসের চিত্র জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য এমপিদের নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি নেত্রীর পুত্রদের পাচারকৃত অর্থ সিঙ্গাপুর থেকে আমরা আনতে সক্ষম হয়েছি। এখন বছরের পর বছর লন্ডনে বসে তারেক রহমান বিলাসবহুল জীবন-যাপন করছে। সেখানে পাচার করা অর্থ আমরা ফেরত আনতে পারিনি। জনগণকে বুঝাতে হবে এরা আবার ক্ষমতায় এলে দেশ আবার অন্ধকারে ডুবে যাবে, উন্নয়ন-অগ্রগতি থমকে যাবে, দুর্নীতি-দুঃশাসন আবার ফিরে আসবে। বিএনপি তো আগেরও দু’বার ক্ষমতায় ছিল। কেন তারা আমাদের মতো উন্নয়ন করতে পারেনি, কেন দেশকে সবক্ষেত্রে পিছিয়ে দিয়ে গেছে। ওরা ক্ষমতায় এলে আবারও পুড়িয়ে মানুষ হত্যা করবে- এ বিষয়গুলোও জনগণকে জানাতে হবে।
সংসদ সদস্যদের বিভিন্ন অভিযোগের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে আগেও ষড়যন্ত্র ছিল, আগামীতেও থাকবে। সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি, আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তিনি বলেন, আমরা দেশে ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। আরও অনেক উন্নয়ন পাইপলাইনে আছে। এগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরতে হবে এবং বুঝাতে হবে সরকারের ধারাবাহিকতা না থাকলে এসব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যহত হবে। তাই আত্মবিশ্বাসী হয়ে নির্বাচনী মাঠে নামুন। একটি আসনে দশজন প্রার্থী থাকতেই পারে। সবাই সরকার, দল ও নৌকার পক্ষে ইতিবাচক কথা বলবেন।
সূত্র জানায়, সভায় ৫/৭ জন সংসদ সদস্য মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে অসহযোগিতার অভিযোগ তুলে বলেন, অনেক মন্ত্রী আছেন তাদের কাছে গেলে আমাদের কথা শোনেন না। আবার অনেক মন্ত্রী ইউএনও-ওসিকে ফোন করে আমাদের কথা না শোনার নির্দেশ দেন। আবার বেশ ক’জন তরুণ সংসদ সদস্য অভিযোগ করেন, আমরা নির্বাচনী এলাকায় ব্যাপক উন্নয়ন করলেও সিনিয়র নেতারা আমাদের পাত্তা দেন না। আবার কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা রয়েছেন যারা নির্বাচনী এলাকায় আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন, স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেন আমাদের কথা যেন তারা না শোনেন।
কক্সবাজারের সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদি বলেছেন, আমার নির্বাচনী এলাকায় রোহিঙ্গার আশ্রয় নিয়েছে। তাদের জন্য পানি বিশুদ্ধকরণ প্লান দিতে হবে।
সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ বলেন, বর্তমান সরকার যে উন্নয়ন করেছে, জনগণের জন্য যে সামাজিক নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সে বিষয়গুলো নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের কাছে তুলে ধরতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী। একই সঙ্গে বিএনপির ধ্বংসাত্মক রাজনীতি তুলে ধরতে বলেছেন তিনি। আমরা সঠিকভাবে প্রচারণা চালাতে পারলে অতীতের মতো বিপুল ভোটে জয়ী হব।