অনলাইন ডেস্ক: ‘এমপিদের যেসব উন্নয়ন বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে, আর কী উন্নয়ন হয়েছে, তার হিসাব নেওয়া হবে। সবার আমলনামা আমার হাতে। বর্তমান এমপিরাই আবার মনোনয়ন পাচ্ছেন— এটা ভেবে ঘরে বসে থাকলে ভুল হবে। যোগ্যতার ভিত্তিতেই মিলবে দলীয় মনোনয়ন।’ দলীয় এমপিদের প্রতি এই হুঁশিয়ারি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।
আর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বার্তা এমপিদের প্রতি, ‘যারা পিয়ন, কনস্টেবল নিয়োগ ও মানুষের কাজ করে দেওয়ার নামে ঘুষ খান আর চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় দেন— তাদের দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হবে না।’ শীর্ষ দুই নেতার বক্তব্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে টেনশনে রয়েছেন আওয়ামী লীগের শতাধিক এমপি।
সূত্রমতে, আগামী নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে কঠোর অবস্থানে থাকবে আওয়ামী লীগ। প্রার্থীর জনপ্রিয়তা, এলাকায় অবস্থান, স্থানীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সম্পর্কসহ দল নির্ধারিত আরও বেশ কিছু মানদণ্ড অনুসরণ করেই দেওয়া হবে মনোনয়ন। দলের নেতারা জানান, আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। তাই প্রার্থী বাছাইয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে জনবিচ্ছিন্ন, বিশেষ করে নিজ এলাকায় দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করা এমপিদের এবার কোনোমতেই ছাড় দেবেন না প্রধানমন্ত্রী। বাদের তালিকায় থাকবেন তারা।
সম্প্রতি গণভবনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের এমপিদের হুঁশিয়ার করে বলেন, ‘এমপিদের মধ্যে কারা কী কাজ করছেন, তার সব প্রতিবেদন আমার কাছে রয়েছে। সবাইকে যোগ্যতার ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেওয়া হবে।’ আর কয়েক দিন আগে ঠাকুরগাঁওয়ে দলের পক্ষ থেকে শীতবস্ত্র বিতরণ এবং কর্মিসভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘যারা চাঁদাবাজদের প্রশ্রয় দেন, যাদের ভাই-ভাতিজা চাঁদাবাজি করে তারা মনোনয়ন পাবেন না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তাদের আমলনামা জমা হচ্ছে।’
জানা যায়, দলীয় বিভিন্ন মাধ্যমে এলাকায় এমপিদের অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে দলের শীর্ষ পর্যায়। এসব প্রতিবেদনে বেশ কিছু এমপির দুর্নীতি, তাদের পরিবারের সদস্যদের নেতিবাচক কর্মকাণ্ড, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে দূরত্ব, বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া ও দলের শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিষয়ে নানা তথ্য উঠে এসেছে। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার সুবাধে এবং কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল মাঠে না থাকায় বর্তমানে অনেকটাই বেপরোয়া আওয়ামী লীগের এমপিরা।
নির্বাচনী এলাকাগুলোতে নিজেদের একটি বলয় গড়ে তুলেছেন- এমন অভিযোগ রয়েছে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাদের। এ ছাড়া বেশ কয়েকটি জেলা-উপজেলায় চলছে ‘এমপি লীগ বনাম আওয়ামী লীগের’ বিরোধ। দলীয় পুরনো ত্যাগী নেতাদের বাদ দিয়ে বিভিন্ন দল থেকে আসা নবাগতদের নিয়ে গ্রুপ গঠন করেছেন এমপিরা। অনেক এমপি কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে ত্যাগী নেতাদের পরিবর্তে বিএনপির কর্মীদের পদ দিয়েছেন। রাতারাতি পদ পাওয়া এসব সুযোগসন্ধানী এলাকায় চাঁদাবাজি-মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে দলের বদনাম করছেন।
একইভাবে ধীরে ধীরে সংগঠন আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে চলে যাচ্ছে। বেশিরভাগ এলাকায় দলের পুরনো নেতাদের দল থেকে ছিটকে পড়তে হয়েছে। অনেক এমপির বিরুদ্ধে পুলিশের কনস্টেবল থেকে শুরু করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দফতরি নিয়োগে পর্যন্ত অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ আছে। নির্বাচনী এলাকার পুলিশ-প্রশাসন চলে এমপিদের নির্দেশে। এমপিদের সঙ্গে বিরোধ থাকলে ওই এলাকায় অন্য কারও আওয়ামী লীগের রাজনীতি করা কঠিন। মামলা দিয়ে হামলা করে কোণঠাসা করা হয়েছে এমপিবিরোধীদের।
কোনো কোনো এমপির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে খোঁজখবর নিয়েছেন। এ তালিকায় রয়েছেন দলের শতাধিক এমপি। বেশ কিছু জেলার দলীয় এমপিদের বিষয়ে খোঁজ নিয়েছেন দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এদের অনেকের মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা খুব ক্ষীণ।
আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা জানান, নির্বাচনী ফসল ঘরে তুলতে যা যা করণীয় তা-ই করা হবে। আগামী প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনের জন্য প্রার্থী বাছাইকেই গুরুত্ব দেবে আওয়ামী লীগ। এ কারণে আসনভিত্তিক শক্তিশালী প্রার্থী আগেভাগেই ঠিক করতে চায় দলটি। তবে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে আরও পরে। এখন প্রতিটি আসনেই একাধিক বিকল্প প্রার্থী ভেবে রেখেছে দল।
আওয়ামী লীগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান এমপিদের ভালো কাজ আর মন্দ কাজের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে প্রধানমন্ত্রীকে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট এলাকায় দলীয় অবস্থান, মনোনয়ন লাভে ইচ্ছুকদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, এলাকায় তাদের ভাবমূর্তিসহ তাদের ইতি এবং নেতিবাচক দিকগুলো থাকবে।
বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগের এমপি রয়েছেন ২৩৪ জন। তাদের মধ্যে পুরুষ ২১৬ এবং নারী ১৮ জন। শতাধিক এমপির অবস্থা ভালো থাকলেও অন্যদের কেউ জনবিচ্ছিন্ন, কেউ আত্মীয়করণে জড়িত, কেউ দুর্নীতিবাজ, কেউ টিআর-কাবিখার অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। আবার কেউ চাকরি দেওয়ার নাম করে গরিব চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে অর্থ লুটে নিয়েছেন। অনেকের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মাদক ব্যবসা এবং দখল বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। দলের মনোনয়ন নিয়ে এসব এমপি টেনশনে রয়েছেন।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।