জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার জন্য ৮ ফেব্রুয়ারি দিন ধার্য করেছেন বিচারক। এ মামলায় খালেদা জিয়া প্রধান আসামি হওয়ায় কী রায় হচ্ছে তা জানার আগ্রহ সবার। তিনি খালাস পাবেন, নাকি দোষী সাব্যস্ত হয়ে কারাগারে যাবেন, জানার জন্য সবার দৃষ্টি আদালতের দিকে। খালেদা-তারেকের বিরুদ্ধে থাকা এ মামলার রায় নিয়ে নানা প্রশ্নও ঘুরপাক খাচ্ছে সবখানে। আইনাঙ্গনও এ আলোচনার বাইরে নেই। রাষ্ট্রপক্ষ ও আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা এ মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে দাবি করলেও বিএনপিপন্থি আইনজীবীদের মন্তব্য এর পুরোপুরি বিপরীত।
মামলাটি সম্পর্কে বিশ্লেষণ করতে গিয়ে আইনজীবীরা বলছেন, এ মামলায় দণ্ডবিধি ও দুদক আইনের ধারা দুটোই রয়েছে। দণ্ডবিধির অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ শাস্তি হতে পারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আর দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছরের কারাদণ্ড। তবে সাজা এক বছরের নিচে হলে আপিলের শর্তে বিবাদী তাত্ক্ষণিক জামিনের আবেদনে যেতে পারবেন কিনা তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী মত দিচ্ছেন তারা। যে যাই বলুক, ৮ ফেব্রুয়ারিই মিলবে এসব প্রশ্নের উত্তর।
এ বিষয়ে দুদকের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল বলেন, ‘খালেদা জিয়ার মামলাটি সংবেদনশীল। আমরা তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। এখন রায়ের অপেক্ষা। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি অনুযায়ী অপরাধ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ যাবজ্জীবন এবং দুর্নীতির ধারায় সাত বছরের কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। আমরা বিচারাধীন বিষয়ে খুব বেশি কথা বলতে চাই না।’ এক বছরের কম সাজা হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে যেতে হবে, নাকি তিনি সেই মুহূর্তে জামিন চাইতে পারবেন— এমন প্রশ্নে আইনজীবী কাজল বলেন, ‘যদি এক বছরের কম সাজা হয় তবে আপিলের শর্তে তিনি তাত্ক্ষণিক জামিন চাইতে পারবেন।’ সেই জামিনের আবেদন যে আদালত রায় দেবে সেখানেই করা যাবে, নাকি কারাগারে গিয়ে করতে হবে— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, ওই আদালতেই তাত্ক্ষণিকভাবে বিবাদী তা করতে পারবেন।’
এদিকে মামলাটির বিচার প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ দুর্নীতি বা দণ্ডবিধির কোনো অভিযোগই প্রমাণ করতে পারেনি বলে আবার দাবি করেছেন খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আদালতে দুর্নীতির মামলার যে ধারা, সেটি বা দণ্ডবিধির ৪০৯ ধারা কোনোটিই প্রমাণিত হয়নি। আমরা আশাবাদী তিনি (খালেদা জিয়া) খালাস পাবেন।’ এদিকে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগের আইনবিষয়ক সম্পাদক শ ম রেজাউল করিম বলেন, ‘খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা, তা যদি প্রমাণিত হয়, তার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন এবং সর্বনিম্ন ১৪ বছরের জেল। আদালত নিজ বিবেচনায় ভিন্ন দণ্ড দিতে পারে কিন্তু সর্বনিম্নের বাইরে যাওয়ার কোনো বিধান নেই। দুর্নীতি মামলায় যদি এক বছরের নিচে সাজা হয় তাহলেও খালেদা জিয়াকে কারাগারে গিয়েই আপিল করতে হবে।’ কোনো মামলায় এক বছর বা তার কম সময়ের শাস্তি হলে আপিল করার শর্তে জামিন পাওয়ার সুযোগ আছে কিনা এবং তা ওই আদালতেই তাত্ক্ষণিক করা যাবে কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখানে সাজা এক বছর হওয়ার সুযোগ একেবারেই নেই। জামিন চাইতে হলে খালেদা জিয়াকে কারাগারে গিয়ে আপিল করতে হবে।’
সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদের (২)(ঘ) উপ-অনুচ্ছেদে সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতার বিষয়ে বলা আছে। এ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হইয়া অন্যূন দুই বৎসরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তাহার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বৎসরকাল অতিবাহিত না হইয়া থাকে’ তাহলে তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অযোগ্য হবেন। সংবিধানের এ ধারা অনুযায়ী খালেদা জিয়া দণ্ডিত হলে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা, তা নিয়ে আইনজীবীদের ভিন্নমত পাওয়া গেছে।
দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ কতটুকু— সে ব্যাপারে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘ফৌজদারি মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত হলে সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি সাংবিধানিক বার (বাধা) রয়েছে। ন্যূনতম দুই বছর দণ্ডপ্রাপ্ত হলে এবং এরপর পাঁচ বছর অতিবাহিত না হলে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।’ হাই কোর্ট যদি সাজা স্থগিত করে এবং আসামিকে জামিন দেয়, সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কিনা— জানতে চাইলে সাবেক এই আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাজা স্থগিত করলে তো সাজা বাতিল হলো না। সাজা খাটা হলো না। সে ক্ষেত্রে পারবেন না।’
তবে ড. শাহ্দীন মালিক এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি যদ্দুর জানি, ফৌজদারি অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তির নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয়টি এখনো সেটেল হয়নি। কোনো রায়ে নেই, আবার আইনও হয়নি। অনেক আগে একটি রায়ে বিচারপতি জয়নাল আবেদীন বলেছিলেন, নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। আর বিচারপতি খায়রুল হক বলেছেন পারবেন না। বিষয়টি সুরাহার জন্য তৃতীয় কোনো বেঞ্চে যায়নি।’
এদিকে রায়ে দোষী সাব্যস্ত করে সাজা দেওয়া হলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারেই যেতে হবে বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। তার গুলশানের বাড়িকে ‘সাবজেল’ ঘোষণা করা হতে পারে এমন গুঞ্জন শোনা গেলেও এখন তা হচ্ছে না। মঙ্গলবার পুলিশের ওপর হামলার পর চূড়ান্ত পর্যায়ে হার্ডলাইনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র এমনটি জানিয়েছে। ১০ বছর আগে এতিমদের জন্য বিদেশ থেকে আসা ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ৩ জুলাই রমনা থানায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলাটি করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ২০০৯ সালের ৫ আগস্ট আসামিদের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে প্রধান আসামি করা হয় মামলায়। এ ছাড়া তার বড় ছেলে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানও এ মামলার আসামি। বিদেশে অর্থ পাচারের দায়ে সাত বছর কারাদণ্ডের রায় মাথায় নিয়ে তারেক রহমান পালিয়ে আছেন দেশের বাইরে। এ মামলায়ও তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি রয়েছে। মামলার ছয় আসামির মধ্যে খালেদা জিয়া জামিনে রয়েছেন। মাগুরার সাবেক এমপি কাজী সালিমুল হক কামাল ও ব্যবসায়ী শরফুদ্দিন আহমেদ রয়েছেন কারাগারে। আর তারেক ছাড়াও সাবেক মুখ্য সচিব ড. কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ভাগ্নে মমিনুর রহমান মামলার শুরু থেকেই পলাতক। রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় ৩৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ৩২ জনকে আদালতে উপস্থাপন করে। তাদের জবানবন্দি উপস্থাপনের পর আসামিপক্ষ জেরা করেছে। এরপর আসামিপক্ষও তাদের পক্ষে সাফাই সাক্ষী উপস্থাপন করেছে আদালতে। গত বছর ২০ ডিসেম্বর জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার যুক্তিতর্ক উপস্থাপন শুরু হয়। এদিন খালেদা জিয়াসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে যুক্তি উপস্থাপন শেষ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল। দণ্ডবিধির ৪০৯, ১০৯ এবং দুদক আইনের ৫(২) ধারায় শাস্তি প্রার্থনা করেন তিনি। এরপর ২১, ২৬, ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর এবং ৩, ৪, ১০, ১১ ও ১৬ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন তার আইনজীবীরা। যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের সময় প্রতিদিনই খালেদা জিয়া আদালতে উপস্থিত ছিলেন। সব মিলিয়ে ২৩৬ কার্যদিবস শুনানির পর মামলাটির রায়ের দিন ঠিক হলো।
সূত্র: বাংলাদেশ প্রতিদিন।