১৯৮৩ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। মস্কো থেকে ১০০ কিলোমিটার পশ্চিমে সামরিক কমান্ডো সেন্টারে ডিউটি শিফট পরিবতর্ন হয় রাতে। সোভিয়েত বিমান বাহিনীর অফিসার ৪৪ বছর বয়সী লেফটেনেন্ট কর্নেল স্তানিসলাভ পেত্রোভের রাতের ডিউটি শুরু হয়। পেত্রোভ ছিল তখনকার প্রধান দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও তৎকালীন ‘ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোস্যালিস্ট রিপাবলিক’ (ইউএসএসআর)-এর মধ্যে চলছিল ঠাণ্ডা লড়াই (কোল্ড ওয়ার)।উভয় দেশের নেতৃত্বে ভাগ হয়ে পড়ে গোটা দুনিয়া।
৩৪ বছর আগের ওই রাতে পেত্রোভ দায়িত্ব বুঝে নেন।দায়িত্ব নিয়ে তিনি সামরিক কেন্দ্রের বৃহৎ পর্যবেক্ষণ যন্ত্রটিতে চোখ রাখেন।যেটি ছিল সুপার কম্পিউটার পরিচালিত।৪টি গোয়েন্দা উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে পাঠানো তথ্য প্রদর্শন করত সেটি। যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা মহাসাগর অঞ্চলের তথ্য দেখা যেত ওই কম্পিউটারে।
পেত্রোভ দায়িত্ব নেয়ার ১৫ মিনিট পরেই কম্পিউটার সংকেত দিতে শুরু করে। ইলেক্ট্রিক মানচিত্রে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার উদ্দেশ্যে মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। স্যাটেলাইটের পাঠানো সংকেতে দেখা যায়, নিক্ষিপ্ত মিসাইল পরমাণু অস্ত্র বহন করছে। যুক্তরাষ্ট্রের নবম সামরিক বেজ থেকে এ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে পেত্রোভ সোভিয়েত নেতাদের কাছে সেই সংকেত পাঠিয়ে দেয়। সংকেত পাঠানো হয় ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে। দ্রুততার সঙ্গে ঊর্ধ্বতন মহল থেকে পেত্রোভকে পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিতে বলা হয়।
তখন পেত্রোভের অধীনে প্রায় ১০০ কমান্ডার ছিল। সবাই ইলেক্ট্রিক মানচিত্রে দেখতে পান, রাশিয়ার দিকে আন্তঃমহাদেশীয় ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হয়েছে।সেকেন্ডে ৭ দশমিক ৮ কিলোমিটার গতিসম্পন্ন ওই ক্ষেপণাস্ত্রটি মাত্র ৪০ মিনিটের মধ্যে মস্কোতে আঘাত হানবে।
কম্পিউটারে হামলার সর্বোচ্চ হুমকিমূলক সংকেত দেখাতে থাকে। অনেক কমান্ডারের মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। কিন্তু পেত্রোভ ছিলেন ধীর-স্থির।
এর ৪ সপ্তাহ আগে সোভিয়েত ২৬৯ জন যাত্রীসহ দক্ষিণ কোরিয়ার একটি যাত্রীবাহী বিমান নামিয়ে নেয়। যার মধ্যে একজন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসম্যান ছিল। বিমানটি অবৈধভাবে সোভিয়েত সীমানায় প্রবেশ করে।
তার কিছুদিন পর সোভিয়েত সশস্ত্র অবস্থায় আফগানিস্তানে শতাধিক সৈন্য পাঠায়। এসব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েতের মধ্যে চরম উত্তেজনা চলছিল। এ সময়ের পরিস্থিতি হামলার আশংকাও অমূলক ছিল না।
ঊর্ধ্বতন মহল থেকে পেত্রোভকে ফোন করে পাল্টা পরমাণু হামলার জন্য চাপ দেয়া হয়। পরমাণু বোমা হামলার জন্য পুরো টিম প্রস্তুত রয়েছে। লাল বোতামটি চাপা মাত্রই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ হবে পাল্টা পরমাণু বোমা।
সামরিক বাহিনীর কয়েক হাজার সদস্য ও কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তারা সবাই পেত্রোভের নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করছে। পেত্রোভ নির্দেশ দিলে ১ বা ২ সেকেন্ডের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে পরমাণু বোমাবাহী মিসাইল ছুটতে শুরু করবে।
এমন সময় পেত্রোভ খেয়াল করেন,কম্পিউটার যে সংকেত দেখাচ্ছে সেখানে উড়ন্ত মিসাইলের সংকেত দেখা যাচ্ছে না। একইসঙ্গে মিসাইলের পেছনের অংশ বোঝা যাচ্ছে না।
তিনি তখন দেখেতে পান যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু বোমা প্রতিরোধী কোনো ব্যবস্থা কার্যকর করেছে এমন কোনো সংকেতও দেখা যাচ্ছে না।তখনই কম্পিউটারের দেখানো তথ্য নিয়ে তার সন্দেহ হয়।
তার মনে হয়, যদি যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু বোমা নিক্ষেপ করে তাহলে পাল্টা পরমাণু বোমা থেকে রক্ষার জন্য ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা প্রস্তুত করবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ক্ষেপণাস্ত্র বিধ্বংসী ব্যবস্থা প্রস্তুত করেনি।
অন্যদিকে সোভিয়েতের ভূমিভিত্তিক রাডারে কোনো সংকেত ধরা পড়েনি। যখনই তিনি বুঝতে পারেন পরমাণু হামলা হয়নি এবং পাল্টা হামলা না করাটাই সঠিক সিদ্ধান্ত।
পেত্রোভ বলেন, আমি বুঝতে পারি কম্পিউটারে দেখানো সিগন্যাল ভুল। তখন আমি চিৎকার দিয়ে উঠি এবং বলতে থাকি এটি সম্পূর্ণ ভুল সংকেত, ভুল সংকেত। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই, কম্পিউটারকে বিশ্বাস করা যাবে না।
কিছুক্ষণ পর তারা কম্পিউটারের সমস্যা শনাক্ত করতে পারে বলে তৎকালীন সোভিয়েত বিমান বাহিনীর প্রধান কর্নেল জেনারেল উরি ভেটিনসেভ রাশিয়ার একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন।
এ নিয়ে পরে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তদন্ত করে ওই কম্পিউটারে আরো কিছু সমস্যা শনাক্ত করে।
তদন্তে এও ধরা পড়ে, সূর্যের আলোর প্রতিফলনের কারণে সোভিয়েত স্যাটেলাইটে ভুল বার্তা পাঠাচ্ছে। যখন সূর্যের আলো থেকে স্যাটেলাইটটি অন্ধকারের মধ্যে পড়তে শুরু করে তখনকার ওই পরিবর্তনের সংকেতকে স্যাটেলাইটে মিসাইল হামলার সংকেত হিসেবে দেখাচ্ছে।
পেত্রোভ ১৯৮৪ সালে অবসরে যান। এরপর তিনি একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। ৭৭ বছর বয়সে ২০১৭ সালের ১৭ মে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
পেত্রোভের এই সিদ্ধান্তের গল্প ১৯৯১ সালে প্রথম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর জন্য রাশিয়ায় পেত্রোভকে কোনো পুরস্কৃত করা হয়নি। বরং অনেকে তাকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে।
তবে ২০০৬ সালে নিউইয়র্কভিত্তিক যুদ্ধবিরোধী সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়ার্ল্ড সিটিজেন’ থেকে পেত্রোভভকে ১৯৮৩ সালের ওই সিদ্ধান্তের জন্য পুরস্কৃত করে।
২০১৪ সালে ড্যানিশ চলচ্চিত্রকার পিটার এ্যান্থোনি তাকে নিয়ে ‘দ্যা ম্যান হু সেভ না ওয়ার্ল্ড’ নামে একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করে, যেটি পুরস্কৃত হয়।