জাতিসংঘ মানবাধিকার সংস্থা প্রধানের অভিযোগ * রাখাইনের খুনীদের আন্তর্জাতিক আদালতে নিন :তিন নোবেল বিজয়ী * মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত ইইউ
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ রা’দ আল হুসেইন মিয়ানমারের উত্তর রাখাইনকে কসাইখানা বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রতিককালে এটি মানুষ হত্যাযজ্ঞের সবচেয়ে ভয়াবহ স্থান। রাখাইন ও অন্যান্য এলাকায় বাড়তে থাকা ভয়াবহ সহিংসতা ঠেকাতে আগেভাগে সমন্বিতভাবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলেও অভিযোগ তুলেছেন তিনি। গতকাল সোমবার জেনেভায় মানবাধিকার কাউন্সিলের ৩৭তম অধিবেশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।
‘পাঁচ স্থায়ী সদস্যকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে’
জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার জেইদ আরো বলেন, রোহিঙ্গারা নিজভূমিতে অমানবিক আচরণ, বঞ্চনা ও হত্যার শিকার হয়েছে। এজন্য দুটি পক্ষ দায়ী। প্রথমত, যারা রোহিঙ্গাদের হত্যা ও জখম করেছে এবং দ্বিতীয়ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য দেশ। যারা এই নৃসংসতা অব্যাহতভাবে চলতে দিয়েছে। তিনি অভিযোগ করে বলেন, যখন ব্যবস্থা নেওয়া সবচেয়ে জরুরি ছিল এবং নিষ্পাপ জনগণের চরম দুর্দশা লাঘব করা যেত তখন ভেটো দেওয়া হয়েছে। তাই পাঁচ স্থায়ী সদস্যকে অবশ্যই নির্যাতিতদের সামনে জবাবদিহি করতে হবে।
পাঁচ সদস্য দেশের মধ্যে ফ্রান্স ভেটো ব্যবহারের নীতিমালা নিয়ে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে। ১১৫ টির বেশি দেশের সমর্থন থাকা এই উদ্যোগে যুক্তরাজ্যও যোগ দিয়েছে। ভেটোর ক্ষতিকর ব্যবহার বন্ধ করতে এবার সেই উদ্যোগে চীন, রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রকে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন হাইকমিশনার জেইদ।
উল্লেখ্য, গত বছরের আগস্টে নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পর রাখাইন রাজ্য থেকে ছয় লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা মেডিসিন সান ফ্রন্টিয়ারস (এমএসএফ) যেটি ডক্টরস উইদআউট বর্ডারস নামে পরিচিত তারা জানিয়েছে, রাখাইনে সহিংসতা শুরুর মাত্র প্রথম এক মাসে প্রায় সাত হাজার বেসামরিক রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়েছে। যাদের মধ্যে ৭৩০টি শিশু ছিল। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরাতে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে ইতিমধ্যে ‘ফিজিকাল অ্যারেজমেন্ট’ চুক্তি হয়েছে। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া এখনো শুরু হয়নি।
মিয়ানমারের জেনারেলদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপে একমত ইইউ
রোহিঙ্গা নিধনযজ্ঞ চালানোর জন্য মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জেনারেলদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারির প্রস্তুতি নিতে গতকাল বৈঠকে সম্মত হয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা। বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, একইসঙ্গে মন্ত্রীরা ইইউ’র অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা জোরালো করতে এবং ব্যাপকভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের জন্য নিরাপত্তা বাহিনীকে অভিযুক্ত করতে সম্মত হয়েছে।
মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে এটাই ইইউ’র সবচেয়ে কঠোর পদক্ষেপ হতে পারে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ১৯৯০ এর দশকে মিয়ানমারের ওপর আরোপ করা অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরও কঠোর করতে সম্মত হয়েছেন। বৈঠকে মিয়ানমারের কোনও সেনা কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করা হয়নি। যদিও ইতিমধ্যে মেজর জেনারেল মং মং সোয়ে’র বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা।
গত সপ্তাহে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইইউ’র পররাষ্ট্র নীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মঘেরিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ডেকেছেন। বৈঠকে বেশ কিছু ব্যক্তির ইউরোপ ভ্রমণে ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করার বিষয়ে আলোচনা হবে।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পাশে থাকবে ইইউ
রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে ইইউ বাংলাদেশের পাশে থাকবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশে ইইউ’র রাষ্ট্রদূত রেনসে টেরিংক। গতকাল পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাত্ শেষে সাংবাদিকদের এ কথা বলেন ইইউ রাষ্ট্রদূত। তিনি বলেন, ইইউ বাংলাদেশকে সহায়তা দিচ্ছে। এই সহায়তা অব্যাহত থাকবে।
রাখাইনের খুনিদের আন্তর্জাতিক আদালতে নিন: তিন নোবেল বিজয়ী
রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নির্মূলে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হচ্ছে অভিযোগ করে দোষীদের আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন কক্সবাজার সফররত শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী তিন নারী। নোবেল বিজয়ী ইরানের শিরিন এবাদি, ইয়েমেনের তাওয়াক্কুল কারমান ও যুক্তরাজ্যের মরিয়েড মুগুয়ার গতকাল সোমবার কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরির্দশন করে এ দাবি জানান।
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করে তাওয়াক্কুল কারমান বলেন, মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা গণহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়। এরপরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চুপ থাকলে তা বিশ্বাবাসীর জন্য লজ্জার হবে। যারা অপরাধ করেছে তাদেরকে আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের মুখোমুখি করতে হবে।
১৯৭৬ সালে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী মরিয়েড মুগুয়ার বলেন, রোহিঙ্গা নারীরা হত্যা-ধর্ষণ আর বর্বরতার যে বিবরণ দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় মিয়ানমারে পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞ চলছে। এটা স্পষ্টভাবে গণহত্যা। মিয়ানমার সরকার আর সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে যা করছে, সেটা মিয়ানমার থেকে, ইতিহাস থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে মুছে ফেলার পরিকল্পিত চেষ্টা মাত্র। মিয়ানমার সরকারের এই নীতিকে ধিক্কার জানাই।
শিরিন এবাদি বলেন, রোহিঙ্গা সঙ্কট শুরুর পর ছয় মাস পেরিয়ে গেলেও শরণার্থীদের ঢল থামছে না। বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর কারণে বাংলাদেশের মানুষের ওপরও বড় ধরনের চাপ তৈরি হচ্ছে। বাংলাদেশের ভূমিকার প্রশংসা করে তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার হতে হবে। দোষীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পদক্ষেপ নিতে হবে। রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখতে নোবেল বিজয়ী এই তিন নারী কক্সবাজারে অবস্থান করছেন।