খরস্রোতা তিস্তাসহ উত্তরাঞ্চলের শতাধিক নদ-নদী পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। পানির অভাবে বিলীনের পথে অনেক নদ-নদীর অস্তিত্ব। ফলে এসব নদীতে নেই মাছ, চলছে না নৌকা। এ অবস্থায় নদী অববাহিকার লাখ লাখ মানুষ নিজেদের পেশা হারিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে পথে বসেছে। পাশাপাশি পানি সংকটের কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমে গিয়ে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। অথচ এসব নদীতে এক সময় পানি প্রবাহের গতি এতোটাই প্রবল ছিল যে, নদী পার্শ্ববর্তী হাজার হাজার হেক্টর জমি বছরের ৬ মাসই পানির নিচে তলিয়ে থাকত। নদীতে নৌ-চলাচল স্বাভাবিক ছিল। মাঝি-মাল্লাদের কণ্ঠে ভেসে উঠতো ভাওয়াইয়া, পল্লীগীতি ও ভাটিয়ালি গানের সুর। নদীর ওপর নির্ভরশীল মত্স্যজীবীরাও পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন-যাপন করতো। অথচ বর্তমানে এ অঞ্চলের নদ-নদীগুলো মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় পাল্টে গেছে সার্বিক পরিস্থিতি।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের তিস্তা, ঘাঘট, ধরলা, করতোয়া, দুধকুমার, স্বতী ঘাঘট, নীলকুমার, বাঙালি, বরাই, মানাস, কুমলাই, ধুম, বুড়িঘোড়া, সোনাভরা, হলহলিয়া, লহিতা, ঘরঘরিয়া, নলেয়া, জিঞ্জিরাম, ফুলকুমার, কাঁটাখালি, সারমারা, রায়ঢাক, যমুনেশ্বরী, চিতনী, মরা করতোয়া, ইছামতি, আলাই, কুমারীসহ শতাধিক নদ-নদী আজ মৃতপ্রায়। মানচিত্র থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে এসব নদ-নদী। শুকনা মৌসুমে নদ-নদীগুলো শুকিয়ে যাওয়ায় চারিদিকে ধু-ধু বালুচরে পরিণত হয়েছে হাজার হাজার হেক্টর জমি। ফলে কমে গেছে আবাদি জমির পরিমাণ। রংপুর মহানগরী থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে গঙ্গাচড়া উপজেলার ১০টি ইউনিয়নের মধ্যে ৭টি ইউনিয়ন তিস্তা বেষ্টিত। এ অঞ্চলের কৃষক, জেলে, মাঝি-মাল্লারা বেকার হয়ে পড়েছে। ডালিয়া থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত প্রায় ৭০ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে জেগে উঠেছে বিশাল বিশাল বালুচর। পানির অভাবে তিস্তা প্রকল্পে আধুনিক সেচ সুবিধা থাকলেও পানি প্রবাহ না থাকায় তিস্তা অববাহিকার লাখ লাখ মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়েছে। নদীর ওপর নির্ভরশীল এসব মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম হাহাকার। এক সময় তিস্তার শাখা ঘাঘট ও মানাস নদের পানি প্রবাহে এ অঞ্চলে সবুজের সমারহ বিরাজমান ছিল। এসব বহমান নদীর দু’পারে ছিল অসংখ্য খেয়াঘাট। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ পারাপার হতো খেয়াঘাট দিয়ে। সেই সব খেয়াঘাটের অনেক স্থানে এখন ব্রিজ নির্মাণ করে রাস্তাঘাট করা হয়েছে।
গঙ্গাচড়া উপজেলার আলমবিদিতর, সদর থেকে পীরগাছা উপজেলার প্রায় ৮০ কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল মানাস নদ। বর্তমানে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। একই অবস্থা ঘাঘট নদের। ঘাঘট নদকে কেন্দ্র করে এক সময়ের গড়ে ওঠা বন্দর বিলীন হয়ে গেছে। ১৮২০ সালের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রমত্তা করতোয়া নদ ক্ষীণ হয়ে আজ প্রায় মরে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। পীরগাছা দিয়ে এক সময়কার প্রবাহিত আড়াইকুমারীর কোনো অস্তিত্বই আজ আর নেই। শুধু রংপুর বিভাগে প্রায় ৩৪টি নদ শুকিয়ে গেছে। ধ্বংস হয়ে পড়েছে কৃষি ক্ষেত্র। প্রতিটি জেলায় দেখা দিয়েছে মত্স্য ঘাটতি। নদ-নদীগুলো মরে যাওয়ার উপক্রম হওয়ায় উত্তরাঞ্চলজুড়ে মরুকরণ সৃষ্টির লক্ষণ দেখা দেওয়ায় শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন পরিবেশবিদরা। পরিবেশবিদদের মতে, বাঁধ নির্মাণ করে ভারতের একতরফা পানি প্রত্যাহারের ফলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এ অঞ্চলের নদ-উপনদ, শাখা-প্রশাখা, ছড়ানদ এবং নদীখাতগুলোকে বাঁচিয়ে তুলতে পর্যাপ্ত পানির প্রবাহ বজায় রাখতে হবে। পাশাপাশি নদীগুলোর অবৈধ বাঁধ অপসারণ, তলদেশ খনন, ড্রেজিং মাধ্যমে উত্স মুখ খোলাশা করে কৃত্রিম ক্যানেলের মাধ্যমে ছোট নদীগুলোর সঙ্গে বড় নদীগুলোর সংযোগ করা প্রয়োজন। দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে না পারলে এক সময় উত্তরাঞ্চল মরুভূমিতে পরিণত হতে পারে বলে পরিবেশবিদদের আশঙ্কা।
সূত্র: ইত্তেফাক।