আওয়ামী লীগ সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর দেশে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছিল ২০০৯ সালের ৬ জুন। সেই বিদ্যুতের পরিমাণ ছিল তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াট। এরপর প্রতিবছরই দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালের ১৯ মার্চে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হলো ১০ হাজার ৮৪ মেগাওয়াট। অর্থাৎ ৯ বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পার্থক্য ছয় হাজার ৮১৬ মেগাওয়াট।
এ দুই সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের তুলনামূলক চিত্রই বলে দিচ্ছে বিদ্যুৎখাতের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। একইসঙ্গে দেশজুড়ে কমে গেছে লোডশেডিং দুর্বিষহ যন্ত্রণা। যদিও মাঝে মধ্যে বিতরণ ত্রুটিতে ভুগছেন গ্রাহক। তবে বিদ্যুতের জন্য হাহাকার আর নেই। রাজধানীর সব এলাকায় যেখানে প্রতি ঘণ্টায় লোডশেডিং হতো, সেই অবস্থা অনেক এখন অনেক সহনীয় পর্যায়ে এসেছে। শিল্পের মারাত্মক সংকটও আর নেই। গত কয়েক বছর ধরে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রবৃদ্ধি আশাব্যঞ্জক বলেই মত সংশ্লিষ্টদের।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিদ্যুৎ খাতে উন্নয়নের আরও জায়গা রয়েছে। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় লোড ম্যানেজমেন্ট করতে হয়। তবে এ বছরের যে প্রক্ষেপণ তাতে বলা হচ্ছে, বিগত বছরের মতো বিদ্যুৎ আর ভোগাবে না। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের সঙ্গে স্বল্প উৎপাদন ব্যয় যোগ করে টেকসই উন্নয়নের ওপর জোর দেন তারা।
আসছে গ্রীষ্মের সম্ভাব্য পরিস্থিতি নিয়ে পিডিবির সদস্য (উৎপাদন) সাঈদ আহমেদ বলেন, ‘চাহিদার ওপর নির্ভর করে আমরা উৎপাদন বৃদ্ধি করছি। এপ্রিলে ৮০০ মেগাওয়াটের তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। এছাড়া একই সময়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আসলে আরও ৪০০ থেকে ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। এপ্রিল ও মে মাসজুড়ে কমপক্ষে এক হাজার ২০০ মেগাওয়াট উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।’ এতে করে গ্রীষ্মে সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
পিডিবির ওয়েব সাইট বলছে,গত ১৫ মার্চে দেশে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯ হাজার ৭১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া গত বছরের ১৮ নভেম্বর বিদ্যুৎ উৎপাদন ওই বছরের সর্বোচ্চ ছিল—৯ হাজার ১১ মেগাওয়াট। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৬ সালের ৩০ জুন সাত হাজার ৪৮৫ মেগাওয়াট সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে।
সরকারের তরফ থেকে বলা হচ্ছে, দেশের প্রতিটি ঘরে পর্যায়ক্রমে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কাজ শেষ করা হবে ২০২১ সাল নাগাদ। এ জন্য বিদ্যুতের উৎপাদন যা-ই হোক না কেন প্রতিমাসেই নতুন তিন থেকে সাড়ে তিন লাখ সংযোগ দেওয়া হচ্ছে। এভাবে প্রতিমাসে নতুন গ্রাহক যুক্ত হওয়ায় সংকট সৃষ্টি হলেও তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব বলে মনে করা হচ্ছে।
বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেন,‘সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সরকার কাজ করছে। কেউ বিদ্যুৎ পাবেন আর কেউ পাবেন না— এটা হতে পারে না। এজন্য উপজেলাভিত্তিক শতভাগ বিদ্যুতায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে সরকার।’
তিনি বলেন, ‘দ্রুত চাহিদা বাড়ছে। শহরে বিদ্যুৎ চাহিদার গড় প্রবৃদ্ধি ২০ ভাগের কাছাকাছি। সরকার চাহিদা মাথায় রেখে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নিচ্ছে।’
পরিসংখ্যান বলছে, বিগত নয় বছরে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নের জন্য সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নতুন ৮৮টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। আর এ সময়ে অবসরে গেছে মাত্র তিনটি কেন্দ্র। ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৭টি আর এখন বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা ১১২টি।
পাওয়ার সেল গত মঙ্গলবার (৩ এপ্রিল) যে হিসাব দিয়েছে, তাতে দেখা যায়, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ছিল চার হাজার ৯২৪ মেগাওয়াট। এখন ক্যাপটিভসহ যা ১৬ হাজার ৪৬ মেগাওয়াটে দাঁড়িয়েছে। ওই সময় বিদ্যুতের সুবিধা পেতো ৪৭ ভাগ জনগণ। এখন তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৩ ভাগে।
পিডিবি সূত্র বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই নতুন কেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। ২০০৯ সালে মোট ১২টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে, যেগুলোর মোট ক্ষমতা ৩৫৬ মেগাওয়াট। ২০১০ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে মোট ৯টি কেন্দ্র স্থাপন করা হয়, যেগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা ৭৭৫ মেগাওয়াট। একইভাবে ২০১১ সালে এক হাজার ৭৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২২টি, ২০১২ সালে ৯৫১ মেগাওয়াটের ১১টি, ২০১৩ সালে ৬৬৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি,২০১৪ সালে ৬৩৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার সাতটি, ২০১৫ সালে এক হাজার ৩৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সাতটি, ২০১৬ সালে এক হাজার ১৩২ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটি এবং গত বছর এক হাজার ১৮৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার সাতটি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ২০১৩ সালে ভারত থেকে ৫০০ মেগাওয়াট, ২০১৬ সালে ১০০ মেগাওয়াট এবং গত বছর আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করা হয়েছে।
উৎপাদন বাড়ার পাশাপাশি গত ৯ বছরে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইনও বেড়েছে। ২০০৯ সালে মোট বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন ছিল আট হাজার কিলোমিটার। এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ হাজার ৬৮০ কিলোমিটারে।
গ্রিড সাবস্টেশনের ক্ষমতা ছিল ২০০৯ সালে ১৫ হাজার ৮৭০ এমভিএ। এখন যার পরিমাণ ৩০ হাজার ৯৯৩ এমভিএ। নতুন নতুন এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ করায় ব্যাপকভাবে বিতরণ লাইন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ৯ বছরে এক লাখ ৮০ হাজার কিলোমিটার নতুন বিতরণ লাইন নির্মাণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালে বিতরণ লাইন ছিল দুই লাখ ৬০ হাজার কিলোমিটার, এখন যা বেড়ে চার লাখ ৪০ হাজার কিলোমিটারে দাঁড়িয়েছে। মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ২২০ কিলোওয়াট ঘণ্টা থেকে বেড়ে ৪৩৩ কিলোওয়াট ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে। সাধারণ গ্রাহকের সংখ্যা এক কোটি আট লাখ থেকে বেড়ে দুই কোটি ৮৭ লাখে দাঁড়িয়েছে। কৃষিকাজে বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণও বেড়েছে। ২০০৯ সালে দুই লাখ ৩৪ হাজার সেচ পাম্প বিদ্যুতে চলতো, এখন যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ৬১ হাজারে।
বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন বলেন,‘বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ খাতের সত্যিই আমূল পরিবর্তন হয়েছে। সংকট মোকাবিলায় সরকারের নেওয়া স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছিল খুবই কার্যকর।’
তিনি বলেন, ‘আগে যেখানে ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ যেতো, সেখানে এখন বৈদ্যুতিক ত্রুটি ছাড়া বিদ্যুৎ যায় না বললেই চলে।’ ড. ইজাজ বলেন, সরকারের স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা যত দ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সে তুলনায় পিছিয়ে পড়েছে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যেসব বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র আছে সেগুলো দ্রুত না আনা গেলে বিদ্যুতের দাম বাড়তেই থাকবে। তাই দ্রুত বড় ও সাশ্রয়ী জ্বালানির কেন্দ্র উৎপাদনে আসা দরকার বলে মত দেন তিনি।
২০০৯ সাল থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত সেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে সেগুলোর মধ্যে সরকারি খাত থেকে এসেছে ৩২টি। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ৬০৬ মেগাওয়াট। বেসরকারি খাত থেকে এসেছে ৫৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র; এসব কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতা চার হাজার ২১৩ মেগাওয়াট।
সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ এসেছে সাশ্রয়ী জ্বালানি গ্যাস থেকে অর্থাৎ গ্যাসভিত্তিক বিদুৎকেন্দ্র থেকে। এর পরিমাণ পাঁচ হাজার ১৪৬ মেগাওয়াট। অন্যদিকে, প্রায় তিন হাজার ৬৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এসেছে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে, যা ব্যয়বহুল। পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতেও সরকারের উদ্যোগ আলোর মুখ দেখতে শুরু করেছে। বর্তমানে তিন মেগাওয়াটের একটি সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করা হয়েছে। খুব শিগগির আরও কিছু কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হবে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ জানায়।
এ প্রসঙ্গে সাবেক বিদ্যুৎ সচিব এবং জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন বিষয়ক সরকারের মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘সরকার দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ দিতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য যেসব পরিকল্পনা করা দরকার, তার সবই বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সময়মতো যাতে সবগুলো বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসে, সে বিষয়ে সবাইকে তাগিদ দেওয়া হচ্ছে।’
সরকার ২০২১ সাল পর্যন্ত নতুন বিদ্যুৎ উৎপাদনে আনার পরিকল্পনা করেছে। সে অনুযায়ী এ বছর জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে চার হাজার ৬৭৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। একইভাবে ২০১৯ সালে চার হাজার ৮৩৩, ২০২০ সালে চার হাজার ৭২ এবং ২০২১ সালে তিন হাজার ৪৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হওয়ার কথা। এ চার বছরে যুক্ত হওয়া বিদ্যুতের মধ্যে সরকারি খাত থেকে আসবে আট হাজার ২৯৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ এবং বেসরকারি খাত থেকে সাত হাজার ৪৯৫ মেগাওয়াট।
পিডিবির চেয়ারম্যান খালেদ মাহমুদ বলেন,‘বর্তমান সরকার ক্ষমতার আসার পর বিদ্যুতের যে মহাপরিকল্পনা করেছে তাতে ২০২১ সালের মধ্যে দেশের মানুষ শত ভাগ বিদ্যুৎ পাবেন।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুতের উৎপাদন যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে চাহিদাও। সে চাহিদা পূরণে সরকারও বদ্ধপরিকর। মহাপরিকল্পনার স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পালা। সেখানে আছে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র।’
খালেদ মাহমুদ বলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ বছর বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসবে। বর্তমানে মাতারাবাড়ি, রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। এগুলোর উৎপাদন ক্ষমতা এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট করে।’
সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কয়েকটি বড় কেন্দ্র নির্মাণ করছে। এখন পর্যন্ত নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া বড় কেন্দ্রের সবগুলোই কয়লাচালিত। এ কাজে সব থেকে এগিয়ে রয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ কেন্দ্রের ৪০ ভাগের মতো কাজ শেষ হয়েছে। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাইলিংয়ের কাজ চলছে এখন। এছাড়া মাতারবাড়ির কাজও দ্রুত এগিয়ে চলেছে।
পূর্ববর্তী পোস্ট