বাংলা নববর্ষের প্রথম প্রহরে ‘মঙ্গল শোভযাত্রা’ এখন বাঙালি সংস্কৃতির অনিবার্য অনুষঙ্গে পরিণত হয়েছে। মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠা ও অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদী এ শোভাযাত্রায় শিক্ষক-ছাত্রসহ সব শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। ২০১৬ সালে ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পেয়েছে চারুকলার মঙ্গল শোভাযাত্রা। তবে বর্ষবরণের শোভাযাত্রার জন্মক্ষণ সম্পর্কে অনেকেরই অজানা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে পড়াশোনা শেষ করে নিজ শহর যশোরে ফিরেছেন মাহবুব জামাল শামীম, হীরন্ময় চন্দ্রসহ কয়েকজন। এরই মধ্যে মাহবুব জামাল শামীম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে আঁকিয়েদের নিয়ে ‘চারুপীঠ’ নামের একটি সংগঠন চালু করেন। সেই ১৯৮৫ সালে (১৩৯২ বাংলা ) যশোরের চারুপীঠ নামের প্রতিষ্ঠানটি ‘বর্ষবরণের শোভাযাত্রা’ বের করে।
পরের বছর ১৯৮৬ সালে (১৩৯৩ বাংলা) যশোরের সব সাংস্কৃতিক সংগঠন একসঙ্গে নতুন বছরকে বরণ করতে ‘যশোর বর্ষবরণ পর্ষদ’ গঠন করে। সেবছর বর্ষবরণ শোভাযাত্রাকে চারুপীঠের আয়োজন না বলে সবার সম্মিলিত আয়োজন বলা হলো। ফলে সারাদেশের প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠান এ উৎসবকে নিজের উৎসব বলে গ্রহণ করে নেয়। পরে এ শোভাযাত্রা আরও বড় পরিসরে শুরু হতে থাকে।
এরই মধ্যে ১৯৮৮ সালে যশোরের মাহবুব জামাল শামীম, হীরন্ময় চন্দ্র উচ্চতর শিক্ষাগ্রহণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেবছর ঢাবির চারুকলার শিক্ষার্থীরা ও ডিপার্টমেন্টের ছোট-বড় ভাইয়েরা তাদের নিয়ে পরিকল্পনা করেন বর্ষবরণ শোভাযাত্রার। সে মোতাবেক সেবারই প্রথম ১৯৮৯ (১৩৯৬ বাংলা) সালে চারুকলার শিক্ষার্থীরা বর্ষবরণের শোভাযাত্রা বের করেন্। পরের বছর তা কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও বরিশালে এবং এরপর সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও ১৯৯০ সালে সঙ্গীতজ্ঞ ওয়াহিদুল হক ও ভাষাসৈনিক ইমদাদ হোসেনের পরামর্শে বর্ষবরণের এই শোভাযাত্রাকে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামকরণ করা হয়।
১৯৯৪ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ শহরে ও শান্তিনিকেতনে বাংলা বর্ষবরণে শোভাযাত্রা বের করা হয়। তবে বর্তমানে সব জেলা-উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে।
যশোরে বর্ষবরণের শোভাযাত্রার অন্যতম উদ্যোক্তা মাহবুব জামাল শামিম বলেন, ‘১৯৮৫ বাংলা ১৩৯২ পহেলা বৈশাখ, আলো-না-ফোটা ভোর, যশোর পুরনো কলেজ প্রাঙ্গণে চারুপীঠের পলাশ মস্কন্দের আঙিনায় তিনশ’ শিশু ও একশ’ তরুণ মিলিত হয়েছে। অপরূপ রঙিন মুকুট পরেছে রাজকুমার, রাজকুমারি, পরি, ফুল, প্রজাপতি, ময়ুর, টিয়া কত না রূপ ধরেছে। বাঘ, দৈত্য, ভূতের মুখোশেরা যেন মুচকি হেসে হাঁউ মাঁউ কাঁউ বলে ভয় দেখাচ্ছে। নানা ভঙ্গিমার বিচিত্র রঙের বিস্ময় জাগানো মুখোশেরা তামাসা করছে সবার সঙ্গে। রঙিন পোশাকে রাঙিয়ে গিয়েছে সমস্ত অঙ্গন।
হঠাৎ বেজে উঠলো সানাই, বাড়ি পড়লো ঢাকঢোল, কাশি, ঝাঁঝরিতে। দুই মাসের তপস্যায় রাঙানো, সুরের তালে নৃত্যের ছন্দে সাধা সে মনেরা বেজে ওঠলো, সারিবদ্ধ হয়ে শিশুরা নেচে উঠলো রূপে অপরূপে নানা ভঙ্গিমায়। জ্বলে ওঠলো হীরন্ময় পোশাকের ঝকমারি। তখন এমন অনুভূতি হয়েছিল যেন স্বর্গ থেকে অঝোরে নামলো আনন্দ বৃষ্টিধারা।
ভোর ছয়টায় যশোরের নীরব শীতল প্রভাতে, শিশির ভেজাপথে আনন্দ কৌতুক উচ্ছ্বাসে বিস্ময়কর রং ছড়িয়ে বাদ্যের তালে তালে নৃত্যের উচ্ছ্বলতায় শোভাযাত্রা এগিয়ে চললো পথ থেকে পথে। আনন্দ বর্ষণধারা আর যেন শেষ হয় না। শহর প্রদক্ষিণ করে এসে চারুপীঠে থামার কথা, না থামলো না। চলতে থাকল ক্লান্তিহীন। পূর্ব থেকে ফিরে পশ্চিমে, উত্তর-দক্ষিণে দূর থেকে দূরে যেন ছড়িয়ে গেল দেশ থেকে দেশান্তরে এমনি অনুভূতি হয়েছিল সেদিন।
এমন সুন্দর আয়োজনে কেন সবাইকে আমন্ত্রণ করা হয়নি, এই আক্ষেপ নিয়ে আসলেন যশোর থেকে অ্যাডভোকেট কাজী আব্দুস শহীদ লাল। এরপর নানা সংগঠন থেকে অংশগ্রহণ না করতে পারার আক্ষেপ আসতে থাকে। তখন সিদ্ধান্ত হলো পরবর্তী বছর ১৯৮৬ (১৩৯৩ বাংলা) যশোরের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলিত উদ্যোগে বর্ষবরণকে সামাজিক উৎসবে রূপদান করা হবে।
আমাদের কর্মীরা দল দল হয়ে ত্রি-সীমানার লোক-ঐতিহ্যের সম্ভ্রান্ত অঞ্চলগুলোতে ভ্রমণ করতে থাকে। শালিকার শোলার শিল্প, দৌলতপুরের মাটির পুতুল শিল্প, নড়াইলের পুতুল ও মৃৎশিল্প। সারাবছর ধরেই পরিকল্পনা চললো, উৎসবের মেনিফেস্টো লেখা হলো, ১৩৯৪ এর বৈশাখের অনেক মাস আগেই বর্ষবরণ শোভাযাত্রার কাজ শুরু করলাম।
হাজার হাজার মুকুট আঁকা, শোলার পাখায় রঙিন নকশা আঁকা মুখোশ তৈরি ও রাঙানোসহ নানা ছোট-বড় উপকরণ তৈরির রেওয়াজ শুরু হলো। শত শত শিশু-কিশোর আঁকিয়েদের নকশায় দক্ষ করার সুযোগ সৃষ্টি হলো। সব সাংস্কৃতিক সংগঠন একসঙ্গে নতুন বছরকে বরণ করতে যশোর বর্ষবরণ পর্ষদ গঠন করা হলো। বর্ষবরণ শোভাযাত্রাকে চারুপীঠের আয়োজন না বলে সবার মিলিত আয়োজন বলা হলো। যাতে করে সমস্ত দেশের প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠান এ উৎসবকে নিজের উৎসব বলে গ্রহণ করে নেয়।
যশোরের ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান যশোর ইনস্টিটিউট। এ প্রতিষ্ঠানটি যশোরের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান-সংগঠনের মায়ের ভূমিকায় ছিল। চারুপীঠের অভিনব উৎসব কর্মসূচিগুলোকে সামাজিক রূপদানে সমস্ত প্রতিষ্ঠানকে মিলিয়ে দিচ্ছিল। উৎসবের সমস্ত কর্মযজ্ঞের কেন্দ্র ছিল এই প্রতিষ্ঠান।
যশোরের সব প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে কাজ করতে এক হয়ে গিয়েছিল। এমন মাতৃক্রোড় পেয়েছিল বলেই বর্ষবরণ শোভাযাত্রা দ্বিতীয়বারেই মহামিলনের সামাজিক উৎসব হয়ে উঠতে পেরেছিল। আর তার ফলে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে চারুপীঠ যেন বিরাট সামাজিক প্রতিষ্ঠানরূপে প্রতিভাত হলো।
সেই দিন যশোরের সব সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সম্মিলনে সাড়ে তিন হাজার মানুষের শোভাযাত্রা এগিয়ে চলেছে। প্রতিটা দলে শিশুরা অপরূপ সাজে নৃত্যগীতের সৌন্দর্য সৃষ্টি করে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের সঙ্গে সব বয়সের মানুষ আনন্দ বিস্ময়ে উচ্ছ্বসিত উদ্বেলিত হয়ে হেঁটে চলেছে। সব দলের নিজস্ব সাজসজ্জা উপকরণ থাকলেও তিন হাজার মানুষের সবার মাথায় বর্ণাঢ্য মুকুট ও প্রতিটি দলে ৩০টি করে অলঙ্কৃত শোলার পাখা শোভাযাত্রার আগা-গোড়া দলগুলোকে যেন একই সুরে মেলানো হয়েছিল।
৪০টি মুখোশসহ প্রজাপ্রতি, পাখি, পরি, ফুল নানা উপকরণ শোভা পাচ্ছিল। একটি বড় আকৃতির হাতি শূঁর দুলিয়ে কান নাড়িয়ে গলায় ঘন্টা বাজিয়ে হেঁটে হেঁটে চলেছে। তার চার পায়ের ভেতর চারজন তরুণ হাতিকে বহন ও পারফর্ম করছিল। আরো একটি বিশাল কুমির মাপেট লাল মুখ হাঁ করে সাদা দাঁতের সারি দেখিয়ে এঁকে-বেঁকে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে। ১৩ জন কিশোর কুমিরটাকে বহন ও পারফর্ম করেছিল। ৪০ জন ঐতিহ্যের ঢাক সানাইয়ের বাদ্যদল শোভাযাত্রার নানা অংশে ১০ জন করে বণ্টন করা হয়েছিল।
যশোরের শালিকার লোকজ ঐতিহ্যের শোলার বানর পাপেট পুতুল বৃহদাকৃতির করে ১০টি তৈরি করা হয়েছিল। উজ্জল রঙিন বানরেরা ১২ ফুট লাঠিতে লাফিয়ে উঠছিল-নামছিল সারাক্ষণ। নেতা তরিকুল ইসলাম (বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাবেক মন্ত্রী) ও খালেদুর রহমান টিটো (আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য) মুকুট পরে সবার সঙ্গে দ্রুত পায়ে হেঁটে চলছিলেন। তারা দু’জন উচ্ছ্বাসের সঙ্গে বলছিলেন, জাতীয়ভাবে এমন উৎসব তো হওয়া প্রয়োজন।
একজন ইতালীয় চিত্রকর ফাদার মাচ্চেল্য যশোর ক্যাথলিক গির্জার পুরোহিত, তিনি বিশাল আকৃতির একটি ক্যামেরা ঘাড়ে নিয়ে সমস্ত উৎসবকে ধারণ করেছিলেন। যেন কোনো আন্তর্জাতিক উৎসবের চেহারা ফুটে উঠেছিল। শোভাযাত্রা চারুপীঠ থেকে শুরু হয়ে শহর প্রদক্ষিণ করে যশোর ইনস্টিটিউটে বৈশাখী মেলার উদ্বোধনের মাধ্যমে শেষ হলো। সেখানে সাড়ে তিন হাজার মানুষকে কুলি-পাকান পিঠার প্যাকেট দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছিল। উৎসবের উন্মাদনায় মায়েরা ভীষণ আন্তরিকতায় সমস্ত রাত জেগে এত বিপুল সংখ্যক পিঠা তৈরি করেছিলেন।
পহেলা বৈশাখের এক ঘণ্টাই যেন সমস্ত বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এমনই এক অনির্বচনীয় অনুভূতি হয়েছিল। শোভাযাত্রা শেষ করেই পরবর্তী বছরের পরিকল্পনায় বিভোর হতাম। উৎসবকেই জীবনের সর্বস্ব দিয়ে ফেলেছিলাম। এক সামাজিক উৎসবের ধারাবাহিকতা শুরু হওয়ার এটাই গল্প।
সূত্র: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।