খেলার খবর: ফুটবলে আর্জেন্টিনাকে নিয়ে দর্শকদের মধ্যে গগনচুম্বী উন্মাদনা থাকে। আর সেই উন্মাদনার শুরুটা ম্যারাডোনার হাত ধরে। যে মশাল যুগ যুগ ধরে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন বাতিস্তুতা, উর্তেগা, তেভেজ, মেসি, মাসচেরানো ও আগুয়েরারা। কিন্তু সেই ১৯৮৬ সালের পর থেকে আর্জেন্টিনার কাছে এখনো অধরা বিশ্বকাপ জয়। আর এবারের বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনার পারফরম্যান্সে হতাশ ভক্তকূল। কারণ গত বিশ্বকাপের রানার্স আপ আর্জেন্টিনার এবার করুণ দশা। প্রথম ম্যাচে ড্র, দ্বিতীয় ম্যাচে বড় ব্যবধানের হার দলটিকে বেশ বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। শঙ্কা দেখা দিয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ারও।
আর ক্রোয়েশিয়ার কাছে বড় ব্যবধানে হারের পর আর্জেন্টিনা দলের ভেতরে বিদ্রোহের সুর পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি খেলোয়াড়দের নিজেদের মধ্যে কলহ, কোচ হোর্হে সাম্পাওলিকে সরিয়ে দিয়ে হোর্হে বুরুচাগাকে কোচ করার জন্য ইচ্ছাকৃত খারাপ খেলার অভিযোগও উঠেছে। আলোচনায় রয়েছে ব্যক্তিত্বের সংঘাতের খবর। রয়েছে কোচের বিচক্ষণতার অভাবও।
আর এইসব বিষয় উঠে আসার মূল কারণ হলো বিশ্বের সেরা সেরা খেলোয়াড় নিয়ে কেন এই অবস্থা হবে আর্জেন্টিনার। যে দলে রয়েছেন বর্তমান বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় লিওনেল মেসি, কিন্তু বিশ্বকাপের দুটি ম্যাচে তার পারফরম্যান্সের ছিটেফোঁটাও দেখা যায়নি। অথচ বার্সেলোনার জার্সিটা গায়ে থাকলেই লিওনেল মেসি হয়ে ওঠেন অদম্য। সার্জিও আগুয়েরো, হিগুয়েইনরা নিজ নিজ ক্লাবের হয়ে ঘরোয়া লিগ জিতে আসা ফুটবলার। তাহলে কেন এই বেহাল?
একটা বিষয় সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছে বিদায়ী ক্লাব মৌসুমে ইন্টার মিলানের হয়ে ২৯ গোল করা সর্বোচ্চ গোলদাতা মাউরো ইকার্দিকে বিশ্বকাপের দলে না রাখা। প্রশ্ন উঠছে সেই একই লিগে ২২ গোল করা পাউলো দিবালা ও ১৬ গোল করা হিগুয়েইন তাহলে কিভাবে ডাক পেলেন বিশ্বকাপ দলে।
গোয়েন্দা তথ্য বলছে, এক্ষেত্রে কোচ নয়, খেলোয়াড়রাই নাকি চাননি ইকার্দি বিশ্বকাপ দলে খেলুক, যার পেছনে আছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোন্দল। ইকার্দির স্ত্রী হচ্ছেন আর্জেন্টিনার মিডিয়া ব্যক্তিত্ব ও ফুটবল এজেন্ট ওয়ান্ডা নারা। তাঁর সঙ্গেই একটা সময় সংসার ছিল আরেক আর্জেন্টাইন ফুটবলার ম্যাক্সি লোপেজের। কখনো জাতীয় দলে না খেললেও লোপেজ খেলেছেন বার্সেলোনায় ও রিভার প্লেটে। ফলে মেসি এবং মাসচেরানোর সঙ্গে সুসম্পর্ক আছে লোপেজের। লোপেজের ঘর ভাঙার কারণে ইকার্দিকে নিয়ে তীব্র সমালোচনা হয় আর্জেন্টাইন গণমাধ্যমে। তাঁকে বিশ্বাসঘাতক বলেন ম্যারাডোনা, উল্টো ইকার্দিও দু’কথা শুনিয়ে দেন ‘আর্জেন্টাইন ফুটবল ঈশ্বর’কে। এসব কারণেই তাঁকে দলে চাইছিলেন না মেসি ও মাসচেরানোসহ অনেকেই।
আরেকটা বিষয় হলো আর্জেন্টিনার জাতীয় দলের পছন্দের সেরা গোলরক্ষক ছিলেন সার্জিও রোমেরো। কিন্তু চোটের কারণে ছিটকে গেছে বলে আর্জেন্টিনা ফুটবল ফেডারেশন জানালেও রোমেরোর স্ত্রী এলিনা গুয়ের্কিও বলছে ভিন্ন কথা। তার দাবি, বিশ্বকাপ খেলার জন্য তার স্বামী ফিট। আর্জেন্টিনার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন মিথ্যা বলছে। কারণ ‘অনেকেই তাকে চায় না’। ফলে এখানে বেরিয়ে আসছে অন্তঃকলহ। ফলে একজন বিচক্ষণ গোলরক্ষকের অভাবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে প্রথম গোলটি খেয়েছিল আর্জেন্টিনা।
সাম্পাওলি বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে সফলতার মুখ না দেখাতে পারলেও কোচ হিসেবে তার অতীত রেকর্ড উজ্জ্বল। চিলির কোচ হিসেবে ব্রাজিল বিশ্বকাপে স্পেনকে হারানোর কৃতিত্ব আছে সাম্পাওলির, চিলিকেই পরের বছর করেছেন কোপা আমেরিকার চ্যাম্পিয়ন। সেই আক্রমণাত্মক ফুটবল, সেই গতিশীল ফুটবল তিনি খেলাতে পারেননি এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে বেশি বয়সী দলকে।
আর মেসিরা কী করলেন? আর্জেন্টিনার ‘ওলে’ পত্রিকায় লেখা হয়েছে, ‘আর্জেন্টিনা দল মাঠে নেমে যেভাবে খেলেছে, তাতে মনে হয়েছে তাদের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি হচ্ছে হতাশা ও একাকিত্ব। এই দলটা মনের দিক দিয়ে দুর্বল, তাদের চোয়াল ঝুলে গেছে।’ সাম্পাওলি দলটাকে মেসির দল হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত না হয়েছে মেসির দল, না হয়েছে সাম্পাওলির ঘরানার।
এদিকে শোনা যাচ্ছে, ফুটবলাররা নাকি বৈঠক করে সাম্পাওলিকে বাদ দেওয়ার দাবি জানানোর ব্যাপারে একমত হয়েছেন। আর্জেন্টিনায় নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ, রেসিং ক্লাব, এস্তুদিয়ান্তেসের মতো ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন রিকার্দো লোমবার্দি। আর্জেন্টাইন ঘরোয়া ফুটবলে দীর্ঘদিন কোচিং করানো লোমবার্দি মনে করেন, লিওনেল মেসিও ইচ্ছা করে খারাপ খেলেছেন। কারণ ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে সে যেভাবে খেলেছে আমি তাকে এমন খারাপ খেলতে কখনো দেখেনি।
সেই লোমবার্দি টিওয়াইসি চ্যানেলে বলেছেন, ‘কোচ দোষী নয়, দোষ খেলোয়াড়দেরই।’ তিনি জানিয়েছেন, সাম্পাওলিকে তাড়িয়ে বুরুচাগাকে কোচ করতেই ইচ্ছা করে খারাপ খেলতে জোট বেঁধেছেন খেলোয়াড়রা।
ক্রোয়েশিয়ার কাছে আর্জেন্টিনার হারের পর বেরিয়ে আসছে একের পর এক বিম্ফোরক তথ্য। এর সবগুলো হয়তো শতভাগ সত্যি নাও হতে পারে, তবে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচে আর্জেন্টিনার খেলার ধরন, সাইডলাইনে সাম্পাওলির ব্যর্থ আস্ফাালন আর আর্জেন্টিনার গণমাধ্যমের খবর, সব মিলিয়ে আকাশি-নীলে ধোঁয়া দেখা যাচ্ছে স্পষ্টই। এখন দেখার বিষয় এই সব কাটিয়ে পরের ম্যাচে স্বরূপে ফিরতে পারেন কিনা মেসিরা।