দেশের খবর: মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জাতিগত নিধনযজ্ঞ থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে এসে এদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা। সরকারি-বেসরকারিভাবে সব ধরণের সহযোগিতা পেলেও তারা সামাজিকভাবে সুখে নেই। তাদের মধ্যে বিরাজ করছে অস্থিরতা। কারণ আধিপত্য বিস্তার, পূর্বশত্রুতার জের ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে-বিপক্ষে অবলম্বনকে কেন্দ্র করে চলছে খুন, মারামারি ও ছুরিকাঘাতের মতো লোমহর্ষক ঘটনা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১০ মাসে উখিয়ার বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে প্রায় ডজন খানেক রোহিঙ্গা নেতা খুন হয়েছেন নিজেদের হাতে। সর্বশেষ গত সোমবার রাত ৮টার দিকে শীর্ষস্থানীয় রোহিঙ্গা নেতা (হেড মাঝি) আরিফ উল্লাহকে গলা কেটে হত্যা করার ঘটনাকে নিয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে চলছে অরাজক পরিস্থিতি। যার কারণে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা নিয়ে রাত যাপন করছেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও রোহিঙ্গা অধ্যুষিত এলাকা পালংখালী ইউনিয়নের চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী সাংবাদিকদের জানান, রোহিঙ্গারা হিংস্বার্থক মনোভাব নিয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্তের উপর ভিত্তি করে খুন-খারাবি করতে কোনরূপ বিলম্ব করে না।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গাদের সরকারিভাবে প্রশাসনের লোকজন দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এনজিও নিয়ন্ত্রিত ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করার সুযোগ পাওয়ার কারণে অপ্রীতিকর ঘটনা দিন দিন বাড়ছে।
ময়নারঘোনা ক্যাম্পের আবু তাহের মাঝি জানান, রোহিঙ্গারা অন্যের নেতৃত্ব সহ্য করতে পারে না। তাছাড়া অভ্যন্তরীণ কোন্দল নিয়ে প্রতিনিয়ত ক্যাম্পে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও এনজিওরা থামাতে পারছে না। যে কোন সময়ে লোমহর্ষক ঘটনা ঘটছে।
তিনি জানান, গত ১৮ জুন রাত ৮টার দিকে রোহিঙ্গাদের শীর্ষস্থানীয় নেতা (হেড মাঝি) আরিফ উল্লাহ নিজ বাসায় ফেরার পথে বালুখালী রাস্তার উপরে দুর্বৃত্তরা তাকে গলাকেটে হত্যা করে। এ সময় সে প্রাণে বাঁচার জন্য চিৎকার করলেও কেউ এগিয়ে আসেনি।
এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের জানান, আরিফ উল্লাহকে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে পুলিশ তদন্ত করছে। তবে পারিবারিকভাবে এখনো কেউ অভিযোগ না করায় হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের আটক করা সম্ভব হচ্ছে না।
চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের ডি-৪ ব্লকে বাসিন্দা মমতাজ আহমদ (৩৫) দোকান থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৫ থেকে ৬ জন দুর্বৃত্ত তাকে অপহরণ করে পার্শ্ববর্তী মধুরছড়া জঙ্গলে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে হাত-পা বেধে গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। পরদিন উখিয়া থানা পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে বাড়াবাড়ির এক পর্যায়ে স্বামীর হতে খুন হয় স্ত্রী রেনুয়ারা বেগম (৩২) পুলিশ ঘাতক স্বামী মোঃ হোছনকে গ্রেফতার করেছে।
২১ জানুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাখাইনে সাতগরিয়া পাড়ার হুকাট্টা (চেয়ারম্যান) মোহাম্মদ ইউছূপ (৪৬) থাইংখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের নিজ বাড়িতে বসে পরিবার-পরিজনদের সঙ্গে আলাপচারিতা কালে কে বা কারা গুলি করলে ঘটনাস্থলে তিনি মারা যান।
তার পরিবার জানান, সে মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার জন্য রোহিঙ্গাদের উৎসাহিত করার কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে। এ ব্যাপারে উখিয়া থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করেছে তার পরিবার।
২৩ জানুয়ারি ভোর রাতে বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে মসজিদের ইমাম ইউছূপ জালাল (৬০) আযান দেওয়ার জন্য মসজিদে আসার সময় ৫-৬ জন দুর্বৃত্ত পেছন থেকে এলোপাতাড়ি ছুরিকাঘাত করলে তিনি ঘটনাস্থলে মারা যান। এ ঘটনায় নিহতের পরিবার থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে।
২ মার্চ রাত ৮টার দিকে কুতুপালং ক্যাম্পের ই ব্লকের বাসিন্দা আবু তাহের (৩০) কুতুপালং বাজার থেকে নিজ বাড়িতে ফেরার সময় দুর্বৃত্তরা তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করে। এ সময় সে চিৎকার করলেও আশে-পাশের কোন রোহিঙ্গা এগিয়ে আসেনি বলে প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন। তারা বলছেন খুনের ঘটনায় গেলে সাক্ষী হতে হয়, যে কারণে রোহিঙ্গারা তাকে বাঁচাতে যায়নি।
১৬ মার্চ থাইংখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পের জঙ্গল থেকে পুলিশ অজ্ঞাতনামা এক রোহিঙ্গা মৌলভীর লাশ উদ্ধার করেন।
এছাড়া ১৭ মার্চ কুতুপালং ক্যাম্পে প্রতিপক্ষরা হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে নুর হাকিম (৩৫) নামে এক সাধারণ রোহিঙ্গাকে প্রকাশ্য হত্যা করে। তার দোষ, সে নাকি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বিভিন্ন খবরাখবর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সরবরাহ করতো। এ কারণে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
গত বছরের জুন মাসে কুতুপালং ক্যাম্পের বাসিন্দা নুরুল ইসলাম নামের এক রোহিঙ্গা সোর্সকে প্রতিপক্ষরা প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, নুরুল ইসলাম রোহিঙ্গাদের নানা অপকর্মের খবরাখবর স্থানীয় প্রশাসন ও সাংবাদিকদের সরবরাহ করতেন। যে কারণে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
একইভাবে গত বছরের জুন মাসে মিয়ানমারের বিদ্রোহী সংগঠন আল ইয়াকিনের সদস্যরা কুতুপালং ক্যাম্পে হানা দিয়ে ক্যাম্পের মাঝি মোঃ আইয়ুব (৩৩) ও তার পাশের বাড়ির মোঃ ছলিম (২৫) কে অপহরণ করে নিয়ে যায়। দুই দিন পর পুলিশ বালুখালী খাল থেকে অপহৃত মাঝিসহ দুই জনের লাশ উদ্ধার করে।
কুতুপালং ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা ডাঃ জাফর আলম প্রকাশ ডিপো জাফর বলেন, এখানে যে সমস্ত রোহিঙ্গা যুবকেরা রয়েছে তাদের অধিকাংশই আল ইয়াকিন, আরসাসহ বিভিন্ন সংগঠনের সাথে জড়িত। তাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার, ক্যাম্পের ত্রাণ ভাগাভাগি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল বা পূর্বশত্রুতার জের ধরে একে অপরকে হত্যা করার চেষ্টা চলছে। যে কারণে ক্যাম্পে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ মোঃ আবুল খায়ের বলেন, ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের নিয়ন্ত্রণের জন্য ৭টি পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হলেও লোকবল সংকটের কারণ বা পুলিশ ফাঁড়ি থেকে দূরত্বের কারণে অনেক সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে হিমশিম খেতে হয়। যদিও আগের তুলনায় খুন-খারাবি কমেছে বলে দাবি করেন তিনি।