দেশের খবর: কোটা সংস্কার আন্দোলনে গ্রেপ্তারদের মুক্তির দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষকদের মিছিল হামলা চালিয়ে পণ্ড করে দেওয়া হয়েছে।
গত কয়েকটি ঘটনার মত এবারও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ওই হামলার চালিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা।
রোববার দুপুরের পর শহীদ মিনারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক মানববন্ধন শেষে একটি মিছিল বঙ্গবন্ধু টাওয়ারের সামনে এলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সামনে এসে ঘিরে দাঁড়ায় এবং আন্দোলনকারীদের মারধর শুরু করে।
মিছিলের সামনের দিকে থাকা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানজীম উদ্দিন খানসহ শিক্ষকদের গায়ে হাত দিয়ে ধাক্কা দেয় তারা।
পরে শিক্ষকরা একপাশে গিয়ে দাঁড়ালে শিক্ষার্থীরা তাদের ঘিরে দাঁড়িয়ে মানবপ্রাচীর তৈরি করে। এসময় ছাত্রীরা হামলা থেকে বাঁচতে বঙ্গবন্ধু টাওয়ারসহ আশেপাশের শিক্ষকদের আবাসিক এলাকায় আশ্রয় নেয়।
সাংবাদিকরা শিক্ষকদের সাথে কথা বলতে গেলে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আরেকদফা তাদের দিকে তেড়ে আসে। তবে সাংবাদিকরা ছাত্রলীগ নেতাদের সাথে কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করে। এরপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরাও অনেকেই স্থান ত্যাগ করেন।
এসময় কর্মসূচিতে উপস্থিত গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ফাহমিদুল হক বিশ্ববিদ্যালয় প্রক্টর গোলাম রাব্বানীকে ফোন করে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা চাইলেও প্রক্টর তার অনুরোধে সাড়া না দিয়ে উলটো ‘পরিস্থিতির জন্য শিক্ষকদেরই দায়ী করেন’ বলে তিনি জানান।
বেলা পৌনে একটার দিকে প্রক্টরিয়াল টিমের একটি গাড়ি শহীদ মিনারে আসে। এরপর ১টায় সহকারী প্রক্টর কামরুল আহসান ও সোহেল রানা আসেন। তারা সবাইকে জায়গা ছাড়তে বলেন; কিছুক্ষণ পর শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে চলে যান।
পরে প্রক্টর অধ্যাপক গোলাম রাব্বানী বলেন, “আমরা সেখানে প্রক্টরিয়াল টিমকে পাঠিয়েছিলাম। দুই পক্ষের সাথেই তারা কথা বলেছে। তবে তারা কেউই তেমন সহায়তা করেনি।
“এই ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থী যারাই জড়িত ছিল, আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বিধিমোতাবেক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।”
এর আগে রোববার সকাল ১১টায় শহীদ মিনার এলাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিকককে সঙ্গে নিয়ে কোটা আন্দোলনের কয়েকশ কর্মী শহীদ মিনারে মানববন্ধন শুরু করে। এই সময় সেখানে কয়েক গজ দূরে মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে ছাত্রলীগকর্মীরা বক্তব্য শুরু করে।
সর্বপ্রথম এনেক্স ভবনের সামনের ফুটপাতে প্রায় ২০০ ছাত্রলীগকর্মী ‘গুজবে কান দেবেন না’, ‘ক্যাম্পাস অস্থিতিশীলতা রুখে দাঁড়ান’,ইত্যাদি প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায়। একই সময়ে শহীদ মিনারের উত্তর পাশে ‘মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সচেতন শিক্ষার্থীবৃন্দ’ ব্যানার নিয়ে দাঁড়ায় অন্তত ১৫ জন।
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার শিক্ষক অধ্যাপক ফাহমিদুল হক। একই সময়ে বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে মাইক হাতে বক্তব্য দেয়া শুরু করেন ছাত্রলীগের পদপ্রত্যাশী নেতা আমিনুল ইসলাম বুলবুল।
শিক্ষকদের দিকে আঙ্গুল তাক করে আমিনুল বলেন, “এখানে এরা জামাত-শিবিরের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করছে। এই শিক্ষকরা জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়নকারী শিক্ষক। মুক্তিযুদ্ধের সময় এরা যুবক ছিল, কিন্তু এরা যুদ্ধে যায় নাই। তাদের চুল-দাঁড়ি পেকে গিয়েছে। এই যে ৬০-৭০ বয়সী শিক্ষকরা- এরা মুক্তিযুদ্ধের সময় কই ছিল?”
অধ্যাপক ফাহমিদ সাংবাদিকদের বলেন, “যখন দেখেছি নিপীড়িতরা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েরই ছাত্র তখন আমরা আমাদের নায্যতা, বিবেক ও বোধের জায়গা থেকে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াই। এই প্রশাসন না অতীতেও যখনই নিপীড়ন হয়েছে আমরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়িয়েছি।
“আজকের কর্মসূচি যখন চলছিল তখন ক্ষমতাসীন সরকারের ছাত্রসংগঠনও এখানে আসে। তারা কর্মসূচি পালন করতেই পারে। তবে তারা নিপীড়কের ভঙ্গিতে আচরণ করেছে। এরপর শিক্ষার্থীরা অবস্থান নিয়ে বসে পড়লে তারা আরো কাছে চলে আসে, যেখানে একটা ভয়ংকর পরিবেশ তৈরি হয়। যখন সবাই চলে যাচ্ছিল তখন ওরা সামনে ঘিরে দাঁড়িয়ে মারধর শুরু করে। তারা শিক্ষকদের নামে কটূক্তি করে। ”
তিনি বলেন, “আমার জন্ম একাত্তরে আর তানজিমের জন্ম বাহাত্তরে। তারা বলছে, আপনারা একাত্তর সালে কি করেছিলেন? এরকম হাস্যকর কথা বলছে তারা।”
মানববন্ধনে উপস্থিত অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুশাদ ফরীদির জন্ম ১৯৭২ সালে, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার অধ্যাপক ড. আব্দুর রাজ্জাক খানের জন্ম ১৯৬৫ সালে।
অধ্যাপক ড. রাজ্জাক বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি আমার মনে আছে। আমি খুব ছোট ছিলাম। আমার পরিবার আর আত্নীয়-স্বজনের মধ্যে একশো জনের বেশি শুধু সম্মুখযুদ্ধেই প্রাণ হারাণ। আর ওরা আমাকে রাজাকার বলছে।”
এরপর অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক রুশাদ ফরিদী মাইক হাতে নিয়ে বিপরীত পাশ থেকে আসা বক্তব্যের নিন্দা জানাতে থাকেন। এসময় ছাত্রলীগের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধা সন্তান সংসদ কমান্ডের সাধারণ সম্পাদক আল মামুন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তানভীর হাসান সৈকত বক্তব্য দিতে থাকেন।
এর আগে বদরুন্নেসা মহিলা মহিলা কলেজের একটি বাস এসে শহীদ মিনারের পাশে থামলে বাস অন্তত ৫০ জন ছাত্রী নেমে ছাত্রলীগের মানববন্ধনে যোগ দেয়। গার্হস্থ অর্থনীতি কলেজের কিছু ছাত্রীও এতে যোগ দেয়।
খাদিজা ইসলাম নামে বদরুন্নেসা কলেজের এক নেত্রী বলেন, “আমরা ক্যাম্পাস অস্থিতিশীলতার বিরুদ্ধে এখানে এসেছি। স্বাধীনতাবিরোধীরা এখানে দাঁড়াইছে। আজকে একটা পবিত্র জায়গাকে এই স্বাধীনতাবিরোধীরা অপবিত্র করতেছে।”
মানববন্ধনে বক্তব্য দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের যুগ্ম-আহ্বায়ক গ্রেপ্তারকৃত রাশেদ খানের মা।
সন্তানকে ফেরত দেওয়ার আকুতি জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার মনিকে ফিরিয়ে দেয়া হোক। আমার বাবা সরকারের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন করেনি। আমার মনি কেবল একটা চাকরি চেয়েছে।”
তানজীম উদ্দিন খান সমস্বরে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার ঘোষণা দেন। জাতীয় সঙ্গীতের পর ছাত্রলীগের এক নেতা আন্দোলনকারীদের মাইকের তার ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর শিক্ষকসহ আন্দোলনকারীরা শহীদ মিনারের পাদদেশে বসে পড়েন।
তারপর ছাত্রলীগের নেতৃত্বে শিক্ষার্থীদের অংশটিও আরো এগিয়ে এসে মুখোমুখি বসে পড়ে; পাল্টাপাল্টি স্লোগান চলতে থাকে।
উপস্থিত চারজন শিক্ষক বিপরীত ছাত্রলীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলতে যান। তারা তাদের দালাল, জামাত-শিবির বলতে থাকেন। একাধিক জনকে শিক্ষক তানজীম উদ্দিনের দিকে টাকা ছুড়ে মারতেও দেখা যায়।
পরে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাজু ভাষ্কর্যের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে আসে। ছাত্রলীগের অংশটিও সমান্তরালে তাদের সাথে আগায়। এক পর্যায়ে তারা হামলা চালায়।
ছাত্রলীগের সদ্য সাবেক কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম জাকির হোসাইন মধুর ক্যান্টিনে সাংবাদিকদের বলেন, “ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আগে শিক্ষার্থী পরে লীগ। সেখানে যদি কেউ গিয়ে থাকে তবে ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেতে পারে। ছাত্রলীগের হয়ে কেউ যায়নি। হামলাকে ছাত্রলীগ কখনো সমর্থন করে না। তারা নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করেছে।
যদি ছাত্রলীগের কেউ গিয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ব্যাবস্থা নেবেন কিনা এমন প্রশ্নে জাকির বলেন, “আমরা খোঁজ নেব। তবে আমি নিশ্চিত করেই বলছি, ছাত্রলীগের কেউ ছিলো না।