দেশের খবর: মোটরযান অধাদেশ অনুসারে গাড়ি চালাতে গেলে লাইসেন্স থাকতেই হবে, চালক সে যেই হোন না কেন। ট্রাফিক পুলিশ নিয়মিত তদারকি চালিয়ে নিশ্চিত করবে, লাইসেন্সহীন কোনো চালক গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে নেই। কিন্তু রাজধানীতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ-বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন ও ঢাকা মহানগর পুলিশের লাইসেন্স ধরার অভিযান নেতিয়ে পড়েছে। অবস্থা এমন—যে পুলিশ লাইসেন্স ধরবে, সেই পুলিশের গাড়িরও লাইসেন্স থাকে না। শৃঙ্খলাহীনতার এই চিত্রটি বুধবার কোমলমতি শিক্ষার্থীরাও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে।
নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাস্তায় নামা শিক্ষার্থীরা মানুষের প্রাণ বাঁচাতে গতকাল লাইসেন্সহীন চালকদের গাড়ি আটকে দেয়। তারা যেন নেমেছে পুলিশের ভূমিকায়। বুধবার দুপুর সাড়ে ১২টায় ধানমণ্ডিতে হারুন আই হাসপাতালের সামনে পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের একটি পিকআপ চালকের কাছে শিক্ষার্থীরা ‘লাইসেন্স’ পায়নি। গাড়িচালক পুলিশ কনস্টেবল অরবিন্দ সমাদ্দার অবশ্য জবাব দেন—‘কাজের সময় আমরা লাইসেন্স নিয়ে বের হই না। কাগজ অফিসে থাকে।’ অন্য পুলিশ কর্মকর্তারা শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে পিকআপটি ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
গতকাল ধানমণ্ডি, যাত্রাবাড়ী, মতিঝিল, ফার্মগেট, বিমানবন্দর সড়কের খিলক্ষেত, মিরপুর, শ্যামলী, কল্যাণপুরসহ বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীরা অভিযান চালায়। মিরপুর-২ নম্বর থেকে সকাল ১১টায় মোটরসাইকেলে রওনা দিয়ে বিকেল ৪টায় কুড়িল পর্যন্ত আসতে পারেন জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানান, পথে কমপক্ষে ২০টি স্থানে শিক্ষার্থীরা তাঁর লাইসেন্স চায়।
বিআরটিএর কাছ থেকে পাওয়া তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দেশে ১৬ লাখ ৩৬ হাজার যানবাহন চালানো হচ্ছে বৈধ চালক ছাড়া। একটি গাড়িতে একজন চালক থাকবে—এ হিসাব করে এ তথ্যটি বের করা হয়েছে।
বিআরটিএ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, গত জুন পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত গাড়ি দাঁড়িয়েছে ৩৫ লাখ ৩৬ হাজার ৩৭০টি। অথচ বিআরটিএ থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে প্রায় ১৯ লাখ। সে হিসাবে সাড়ে ১৬ লাখের কাছাকাছি গাড়ি চলছে বৈধ চালক ছাড়া। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চালকের সহকারী গাড়ি চালায়।
এ ছাড়া রাজধানীর আগারগাঁও, মহাখালী, মিরপুর-১০, ফার্মগেট, জিগাতলাসহ বিভিন্ন স্থানে কিশোর চালকরা লেগুনা চালায়। আইন অনুসারে ১৮ বছর না হলে লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা যায় না। অথচ ১৮ বছরের নিচের শিশু-কিশোররা যাত্রী পরিবহন করছে। তাদের একজন জসিম উদ্দিন গতকাল মহাখালী মোড়ে আলাপকালে বলে, লাইসেন্স লাগে না, পুলিশ ধরলে ৩০০ টাকা দিলেই হয়।
২০০৯ সালে প্রকাশিত ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবির প্রতিবেদনে বলা হয়, ৯৭ শতাংশ চালক ওস্তাদের সঙ্গে সহকারী হিসেবে কাজ করে গাড়ি চালানো শিখেছে। তাদের ১৩ শতাংশ নিরক্ষর, ৪৭ শতাংশের প্রাথমিক শিক্ষা ও ৪০ শতাংশের বেশি শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে। পরীক্ষা না দিয়েই ৬১ শতাংশ চালক লাইসেন্স নেয়। ওই গবেষণার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন রেজাউল হক। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি।
নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের চেয়ারম্যান চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘নিরাপদ সড়ক আমাদের বহুদিনের দাবি। এবার সাধারন শিক্ষার্থীরা জেগেছে।’
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘আমরা সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য দিলেই তা লুকিয়ে রাখতে চায় সরকার। আসলে লুকিয়ে রেখে লাভ হয় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এরই মধ্যে নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন।’
বিআরটিএর সচিব শওকত আলী বুধবার দুপুরে জানান, এ পর্যন্ত প্রায় ১৯ লাখ লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে নিবন্ধিত প্রায় ৩৫ লাখ গাড়ির বিপরীতে। অনেক লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। নবায়ন করা হলে চালক বৈধ হবে।
রাজধানীতে প্রায় আট হাজার বাস চলাচল করে। এসব গাড়ির চালকের বৈধ লাইসেন্স নেই প্রায় ৪০ শতাংশের। এসব বাসের ৮৮ শতাংশেরই মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে বহু বছর আগে। এসব বাসের বেশির ভাগ চালাচ্ছে ভুয়া চালকরা, কখনোবা অল্পবয়সী কিশোর। বাসগুলোর অর্ধেকের নেই উপযুক্ততার সনদ—কোনোটির সামনের আয়না নেই, ব্রেক নেই, ইঞ্জিন চলতে চলতে বন্ধ হয়ে যায়। এসব বাসের চালকদের প্রশিক্ষণও নেই। মালিকের সঙ্গে দৈনিক চুক্তিতে বেশির ভাগ বাস চালানোয় মুনাফার জন্য যাত্রীর দিকেই চোখ থাকে চালকদের।
র্যাব ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত রবিবার শিক্ষার্থী হত্যায় জড়িত জাবালে নূর পরিবহনের তিন বাসচালক মাসুম বিল্লাহ, জুবায়ের ও সোহাগের লাইসেন্স যথাযথ ছিল না। দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ক্ষেত্র তৈরি করে এ তিন চালক। মিরপুর ও বরগুনা জেলায় অভিযান চালিয়ে জাবালে নূরের তিনটি বাসের তিন চালক এবং তাদের দুই সহযোগী এনায়েত ও রিপনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
জাবালে নূরের তিন বাসের রেষারেষিতে গত রবিবার দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানি ঘটে। তিন চালক মাসুম বিল্লাহ, জুবায়ের ও সোহাগকে বিআরটিএ অপেশাদার চালকের লাইসেন্স দিয়েছিল। কিন্তু তারা পেশাদার চালক হিসেবে ভারী যান চালিয়ে আসছিল। তাদের লাইসেন্সগুলো যাচাই করতে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাস তিনটি হলো—ঢাকা মেট্রো ব-১১-৯২৯৭, ঢাকা মেট্রো ব-১১-৭৬৫৭ ও ঢাকা মেট্রো ব-১১-৭৫৮০।
বাসচালকদের রেষারেষিতে চলতি বছর যেন হত্যার মৌসুম শুরু হয় রাজধানীতে। গত এপ্রিলে প্রতিযোগিতা করে চলা দুই বাসের চাপায় হাত হারান সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী রাজীব হোসেন, পরে তাঁর প্রাণটিও যায়। বাসচাপায় মেরুদণ্ড ভেঙে চিরতরে পঙ্গু হন গৃহিণী আয়েশা খাতুন। ফার্মগেটে বাসের জন্য দাঁড়িয়ে থাকা রুনি আক্তারের ওপরও বাস তুলে দেওয়া হয়েছিল। গত রবিবার রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের দুই শিক্ষার্থীর প্রাণহানির ঘটনা দেশের সব মানুষকে নাড়া দিয়েছে। সেই থেকে রাজধানী অচল হয়ে আছে শিক্ষার্থীদের অবরোধে।