অনলাইন ডেস্ক: দেশে একটি রেলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করেছিল রেলপথ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সেই সুপারিশ চূড়ান্ত করতে এখন রেলওয়ে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে এমন দেশ সফরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন ওই কমিটির সদস্যরা। কমিটির পক্ষ থেকে ওই সফরের জন্য চীন ও যুক্তরাজ্যের নাম উল্লেখ করে মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। গত ২২ জুলাই জাতীয় সংসদ ভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার আশ্বাসও দিয়েছেন রেলপথমন্ত্রী মুজিবুল হক।
বিপুল পরিমাণ অর্থ খরচ করে সংসদ সদস্যদের এ ধরনের বিদেশ সফর বাস্তবে কতটা কাজে আসে তা নিয়ে নানা মহলের প্রশ্ন থাকলেও বিভিন্ন সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে নানা সময়ে এমন সুপারিশ করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়ে সফল হয়েছে। আবার কখনো কখনো অর্থাভাবে আটকে গেছে বিদেশ সফর। তা নিয়ে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে তীব্র ক্ষোভও প্রকাশ করা হয় বলে জানা গেছে।
সংসদীয় কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে ওই দুটি দেশ সফর করার সুপারিশ করে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। কিন্তু মন্ত্রণালয় সে সফর আয়োজনে ব্যর্থ হওয়ায় সম্প্রতি এক বৈঠকে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। বৈঠকে উপস্থিত প্রাথমিক ও গণশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু হেনা মোস্তফা কামাল বলেন, ‘প্রয়োজনীয় ব্যয় বরাদ্দ ও কতিপয় সীমাবদ্ধতার কারণে সফর আয়োজন সম্ভব হয়নি এবং ভবিষ্যতে হবে কি না তা বলতে পারছি না।’ এতেই চটে যান সংসদীয় কমিটির সদস্যরা। কমিটির সদস্য সামশুল হক চৌধুরী বৈঠকে বলেন, ‘অন্যান্য স্থায়ী কমিটি যথারীতি বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করছে। তাহলে আমরা পারব না কেন?’ তিনি যথাশিগগির সম্ভব অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের পূর্বনির্ধারিত সফর আয়োজনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কমিটির সভাপতি মো. মোতাহার হোসেন সফর অনুষ্ঠানে বিলম্ব হওয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ের তরফ থেকে নিয়মিত ও অব্যাহতভাবে বিভিন্ন পর্যায়ে বিদেশ ভ্রমণ কার্যক্রম সম্পন্ন হচ্ছে। অথচ স্থায়ী কমিটির পূর্বনির্ধারিত এ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সফর অনুষ্ঠানে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়া দুঃখজনক।’ কমিটির আরেক সদস্য আ খ ম জাহাঙ্গীর হোসাইন যেভাবেই হোক ওই সফর আয়োজনের জন্য মন্ত্রণালয়ের কাছে দাবি জানান।
সভার কার্যবিবরণী থেকে আরো জানা যায়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ আর কমিটির সদস্যদের বিদেশে না নেওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমিটির সদস্যরা। তাঁরা বলেন, অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে কিছুদিন আগেও তিন সচিব অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করেছেন। রাজধানীর পূর্বাচলে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলার জন্য স্টেডিয়াম নির্মাণের অভিজ্ঞতা অর্জনে ভেন্যু দেখতে গেলেও তাঁদের সঙ্গে দুই খেলার সংশ্লিষ্ট কাউকে রাখা হয়নি। ওই সফরে সরকারের অর্থ ব্যয় করে শুধু ভ্রমণবিলাসই হয়েছে। অথচ কমিটির পক্ষ থেকে বিদেশ সফরের কথা বলা হলেই আইন দেখানো হয়। অর্থসংকট দেখানো হয়।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র মতে, সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি (পিপিপি) আইন সম্পর্কে অভিজ্ঞতা নিতে গত অর্থবছরে সরকারি খরচে ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্য সফর করে আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। সংসদ লাইব্রেরির আধুনিকায়ন ও ডিজিটাইজেশনের বিষয়ে ভারত সফর করে জাতীয় সংসদ লাইব্রেরি কমিটি। আরেক বিষয়ে সমৃদ্ধ হতে ভিয়েতনাম ও চীন সফর করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রম দেখতে কঙ্গো ও আইভরি কোস্ট সফর করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটি। এভাবে প্রতি মাসেই কোনো না কোনো কমিটির সদস্যরা বিদেশ সফর করেন অভিজ্ঞতা অর্জন ও মতবিনিময়সহ নানা ইস্যুতে। সংসদীয় কমিটি ও সংসদ সদস্যদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। যে কারণে এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে বিদেশ সফরের আগ্রহ বেশির ভাগ সংসদ সদস্যের।
সূত্র মতে, সংসদীয় কমিটিকে কাজে লাগিয়ে বিদেশ ভ্রমণের হিড়িক পড়ে নবম সংসদে। আর এতে আপত্তি জানান তৎকালীন স্পিকার (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) মো. আবদুল হামিদ এবং অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। স্পিকার সংসদ সদস্যদের বিদেশ সফরের অনুমতি প্রদানে কড়াকড়ি আরোপ করেন। আর অর্থমন্ত্রী অনীহা প্রকাশ করেন ওই খাতে অর্থ ছাড় করতে। কিন্তু সংসদ সদস্যরা মন্ত্রণালয়কে ম্যানেজ করে বা বেসরকারি খাতের অর্থায়নে বিদেশ সফর অব্যাহত রাখলেও জটিলতা নিরসনের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে সংসদ সদস্যদের বিদেশ সফরের অর্থ ছাড়ের অনুমোদন মিললেও অনেক সময় নথি আটকে যায়। আবার বিদেশ সফর করে ফিরলেও বছরের পর বছর বিল আটকে থাকে। এই জটিলতা দ্রুত নিষ্পত্তি করার তাগিদ দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। এ ক্ষেত্রে সংসদ সচিবালয় থেকে সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফরের অর্থায়ন করতে হলে আলাদা বরাদ্দেরও প্রস্তাব দেন তিনি। কিন্তু চলতি অর্থবছরের বাজেটে সেটা করা হয়নি। সংসদ সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, এবার বাজেটে জাতীয় সংসদের জন্য ৩৩২ কোটি ৫৩ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হলেও সেখানে এসংক্রান্ত কোনো খাত নেই।
এ বিষয়ে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন (আইপিইউ), কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন (সিপিএ) এবং অন্যান্য সংসদীয় সংস্থার সম্মেলন, সেমিনার ও বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য কোনো সংসদীয় দল বা প্রতিনিধি কোনো দেশে গেলে সেই ব্যয় সংসদ সচিবালয় বহন করে। আর সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফরের ব্যয় মন্ত্রণালয় থেকে বহন করা হয়। সরকার চাইলে এটা সংসদ সচিবালয় থেকে করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে জাতীয় সংসদের বাজেটে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। আর এ জন্য একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। আগামী দিনে সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে বলে আশা প্রকাশ করেন স্পিকার।
সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফরের ব্যয় নিয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে একটি চিঠি পাঠিয়েছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে। ওই চিঠিতে অর্থমন্ত্রী উল্লেখ করেন, বিদেশ সফরের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রে আর্থিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রসহ একাধিক দেশের উদাহরণ তুলে ধরে চিঠিতে আরো উল্লেখ করা হয়, সেসব দেশে সরকারি খরচে সংসদ সদস্যদের বিদেশ সফর নিরুৎসাহ করা হয়। বিষয়টি সংসদ সচিবালয়ের মাধ্যমে সমন্বয় করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই চিঠিটি পাওয়ার পর স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বিষয়টি নিয়ে সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পরামর্শ করেন। এরপর স্পিকারের নির্দেশে সংসদ সচিবালয় ওই চিঠির জবাব দেয়। সেখানে সংসদীয় কমিটির সদস্যদের বিদেশ সফরের জন্য আলাদাভাবে অর্থ বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়, যার ওপর ভিত্তি করে সংশ্লিষ্ট কমিটিগুলো বিদেশ সফরের পরিকল্পনা তৈরি করবে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরা হয়। কিন্তু এরপর দুটি জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করা হলেও এসংক্রান্ত কোনো বরাদ্দ রাখা হয়নি।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘পার্লামেন্ট ওয়াচ’ শীর্ষক এক গবেষণায় সংসদীয় কমিটির অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, মন্ত্রণালয়ের কাজের তদারকি ও নজরদারি করাই সংসদীয় কমিটির প্রধান কাজ। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুপারিশ প্রণয়নের পাশাপাশি ভুল-ত্রুটিও শুধরে দিয়ে থাকে কমিটি। অনিয়ম-দুর্নীতি হলে তদন্ত করে সুপারিশ প্রণয়নসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। সেই কমিটি মন্ত্রণালয়ের টাকায় অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর করলে কমিটির ব্যবস্থাপনা দুর্বল হয়ে পড়ে। মন্ত্রণালয় থেকে সুবিধা নেওয়ার পর কমিটির সদস্যদের নৈতিক জোর কমে যায় বলেও উল্লেখ করা হয়েছে গবেষণা প্রতিবেদনে।
মন্ত্রণালয়ের অর্থে বিদেশ ভ্রমণকে স্বার্থের সংঘাত বলে মনে করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দেশে-বিদেশে দায়িত্ব পালন করবেন, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সংসদ থেকে অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা থাকতে হবে। বিষয়টি বাজেট পাসের সময় বিবেচনা করা যেতে পারে। আর সংসদীয় কমিটির বিদেশ সফরের কর্মসূচি ওই কমিটির সংশ্লিষ্ট ইস্যুতে হবে।
জানা গেছে, সব শেষ অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও তুরস্কের ওয়াক্ফ কার্যক্রম পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেয় ধর্ম মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এ জন্য ওয়াক্ফ তহবিল থেকে দুই কোটি টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়। কিন্তু ওই তহবিলের অর্থ ব্যয়ের নির্ধারিত খাতের মধ্যে বিদেশ ভ্রমণ না থাকায় টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন ওয়াক্ফ প্রশাসক। ফলে ধর্ম মন্ত্রণালয় সফর আয়োজনে ব্যর্থ হয়। এ নিয়ে গত ২৮ মে সংসদীয় কমিটির বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়।
সংসদীয় কমিটির সভার কার্যপত্র থেকে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ ১৮ জনের সফরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে এক কোটি ৯২ লাখ ৭৭ হাজার ৫৫২ টাকা বরাদ্দ চাওয়া হয়েছিল। ওই প্রতিনিধিদল বিদেশ সফর করলেও কত ব্যয় হয়েছিল সেই তথ্য কমিটিতে নেই।
প্রবীণ সংসদ সদস্য ও সাবেক ডেপুটি স্পিকার কর্নেল (অব.) শওকত আলী বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন প্রগ্রামে জাতীয় সংসদের প্রতিনিধিরা অংশ নিয়ে থাকেন। এর বাইরেও সংসদ সদস্যরা বিভিন্ন ইস্যুতে অভিজ্ঞতা অর্জন ও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার জন্য বিদেশে যান। তবে কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থের বিষয়টি প্রাধান্য দেওয়া উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।
সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মো. রহমত আলী বলেন, ‘আমিও সংসদীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। সেই সময়ে সংসদীয় দলের সদস্য হিসেবে বিদেশ গেলেও কোনো অপ্রয়োজনীয় বিদেশ সফর করিনি।’