দেশের খবর: দেশজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার অভিযান হঠাৎ করেই জোরদার করা হয়েছে। আর এই ধরপাকড়ের প্রধান টার্গেট আবারও বিএনপি নেতাকর্মীরা। দেশের বিভিন্নস্থানে পুলিশ ও র্যাব দলটির নেতাকর্মীদের বাসায় বাসায় হানা দিচ্ছে, চালাচ্ছে তল্লাশি। এত আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে সংসদের বাইরে থাক দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মাঝে।
কোনো কোনো জায়গায় বিএনপির নেতা-কর্মীদের বাড়ি-ঘরে পুলিশের তল্লাশি অভিযানকে চলমান মাদক বিরোধী অভিযান বলে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। গত তিন দিনে বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৩০০ নেতা-কর্মীকে আটক করেছে পুলিশ। সচল করা হয়েছে পুরনো ভাঙচুর-আগুন দেওয়ার মামলাগুলি। কোথাও নতুন করে মামলা দেওয়া হচ্ছে।
বিএনপির নেতাদের দাবি, দলের প্রায় চার লাখ নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে অন্তত ২৫ হাজার মামলার খগড় ঝুলছে। এসব মামলায় কয়েক হাজার নেতা-কর্মী এখনো জেলের ঘানি টানছেন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধ-আন্দোলনের দুই বছরে সহিংসতার অভিযোগে সারাদেশে বিএনপির নেতাকর্মীর নামে ১৫ হাজারের বেশি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকাতেই মামলা দায়ের হয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার। এসব মামলা হয়েছে দন্ডবিধি, বিস্ফোরক দ্রব্য ও বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিভিন্ন ধারায়। এসব মামলায় জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলে ফের নতুন করে মামলা দায়ের হচ্ছে। এতে দলের তৃণমূল নেতাদের মধ্যে আবারও গ্রেফতার আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। অনেক নেতাই আবারও বাসাবাড়িতে থাকা বন্ধ করে দিয়েছেন।
বিএনপি নেতাকর্মীরা অভিযোগ করে বলেন, সরকার তার নিজের অবস্থানকে ধরে রাখতে এবং আরেকটি ভোটারবিহিন একদলীয় নির্বাচন নিবিঘ্নে সম্পন্নের উদ্দেশে বিএনপির ওপর নতুন করে গ্রেফতারের খড়গ চালাচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নতুন করে আরও কিছু নেতাকে গ্রেফতার করা হতে পারে। উদ্দেশ্য, বিএনপিকে সুসংগঠিত হতে না দেওয়া। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর আটটি জোনেই প্রায় ৬ শতাধিক মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।
যে কারণে শুরু ধরপাকড়
পবিত্র ঈদুল আযহার পর থেকেই বিএনপি নেতাকর্মীদের ধরপাকড় শুরু হলেও গত কয়েকদিনে তা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। দলটির দাবি ১ সেপ্টেম্বর দলের ৪০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় বড় জনসভা করার পর থেকে তা আরও বেড়েছে। এতে দলটির নেতাকর্মীরা আতঙ্কে রয়েছেন। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পর থেকে সরকার প্রশাসনের উপর চাপ বাড়িয়েছে।সরকারের ধারণা দলটি সংগঠিত হয়ে যেকোনো সময় সরকার পতনের আন্দোলনে নামতে পারে। আর এ কারণেই বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের আটক করা হচ্ছে।
প্রশাসনের দাবি মাদকবিরোধী অভিযান
এ প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তার কাছে কারণ জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। তবে তিনি বলেন বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো অভিয়ান চালানো হচ্ছে না।কিন্তু দেশব্যাপী মাদকবিরোধী অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।এ অভিযানে গত ৩১ আগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১ হাজার ৫৫৪ জনকে আটক করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে আরও ১৮৬ জন আটক হয়েছেন।
কয়েকদিনেই গ্রেফতার ৭০৯ নেতাকর্মী
পুলিশের এই দাবিতে অস্বীকার করেছে বিএনপি। দলটির দাপ্তরিক পরিসংখ্যান মতে ঈদুল আজহার পরদিন থেকে এ পর্যন্ত দলটির ৭০৯ জন নেতাকর্মী গ্রেফতার করা হয়েছে। এর মধ্যে শনিবারেই (১ সেপ্টেম্বর) রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকা থেকে ১১৮ জন, সুনামগঞ্জে ৩২, কুষ্টিয়ায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী মিলিয়ে ৫৮, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে ১৪ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
কী বলছে বিএনপি?
এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, রাজধানীতে আমরা সফল জনসভা করেছি। সারাদেশের নেতাকর্মীরাও এখন বেশ সক্রিয়, সংগঠিত। যা নিয়ে ভয় পাচ্ছে সরকার। সেই ভয়েই হঠাৎ করেই দলটির উপরে এভাবে চড়াও হয়েছে প্রশাসন। সরকার নীলনকশা করে বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখতে চায়। তবে সরকারের এই কর্মকাণ্ড সফল হতে দেবে না জনগণ।
গ্রেফতারের তালিকায় ছাত্রদলও!
গ্রেফতার অভিযান থেকে বাদ যাচ্ছেন না দলটির ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল। ছাত্রদলের দাপ্তরিক তথ্য বলছে, গত এক সপ্তাহে সংগঠনের অন্তত ২০০ নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে ৩০ আগস্ট ছাত্রদলের নারায়ণগঞ্জ জেলার সাধারণ সম্পাদক খায়রুল ইসলামকে গ্রেপ্তারের পরদিন সোনারগাঁ থানার ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১ সেপ্টেম্বর ঝিনাইদহ পৌর ছাত্রদলের সভাপতি আবিদ আহমেদ, নড়াইল জেলা ছাত্রদলের যুগ্ম সম্পাদক এস এম গিয়াস উদ্দিন, সাংগঠনিক সম্পাদক রুবায়েতসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন জেলায় গড়ে প্রতিদিন ৪০ থেকে ৫০ জন ছাত্রদল নেতাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক আবদুস সাত্তার পাটোয়ারী।
হঠাৎ করেই বাড়ছে নাশকতার মামলা!
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরে বিভিন্ন জেলায় বিএনপির নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার মামলা বাড়িয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে বিএনপির ৩৫ জন, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৩৫ জন এবং বগুড়ার শাজাহানপুরে ৩০ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলা করেছি পুলিশ।
মামলার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে বিএনপি
বিএনপি ও আদালতের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর থেকে ২০১৪ সালের ২১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে চার হাজার ৫৫১টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত অন্তত দুই লাখ ২৩ হাজার জনকে আসামি করা হয়। খালেদা জিয়ার রায়ের দিনও সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হয়েছিল। বিগত ওয়ান-ইলেভেন থেকে বর্তমান আওয়ামী লীগের দুই আমলে সবমিলে সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার মামলা দেয়া হয়েছে বলে দাবি করেছে বিএনপি। এসব মামলায় নামে ও বেনামে প্রায় বারো লাখের মতো আসামি রয়েছে।
তিন ডজন মামলার আসামী খালেদা জিয়া
দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে তিন ডজন মামলা রয়েছে। এসব মামলার মধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় বর্তমানে তিনি কারাভোগ করছেন। জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলা ছাড়াও অন্য মামলাগুলো হল- রাজধানীর দারুসসালাম থানার আটটি নাশকতার মামলা, যাত্রাবাড়ী থানার যাত্রী হত্যা মামলা, মানহানি মামলা দুটি, গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, নাইকো দুর্নীতি মামলা ও বড়পুকুড়িয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা।
মামলায় সেঞ্চুরি তারেক রহমানের
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা এবং জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা অন্যতম।
সিনিয়র নেতাদের বিরুদ্ধে যতো মামলা
দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে ৮৫টি মামলা, সাবেক মন্ত্রী ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের বিরুদ্ধে বর্তমানে ১১টি মামলা, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিরুদ্ধে ৪০টি মামলা রয়েছে। এছাড়া স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলামের নামে ২২, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার নামে ১৯ ও সালাহউদ্দিন আহমেদের নামে ৪৭টি মামলা, ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে ৭টি, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর নামে ৩৭, এজেডএম জাহিদ হোসেন ১৫, বরকতউল্লা বুলুর বিরুদ্ধে ৮৮টি, আবদুল আউয়াল মিন্টুর নামে ১২, শামসুজ্জামান দুদু ২২, শওকত মাহমুদ ৪৫, আবদুল্লাহ আল নোমান ১৩, সেলিমা রহমান ১১, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ১৮, মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমেদের নামে ৬টি মামলা রয়েছে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমান ১২৬, জয়নুল আবদিন ফারুক ৩১, মিজানুর রহমান মিনু ১৩, দলের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নামে ৫০টি, যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলালের নামে ১৩০টি, হাবিব-উন-নবী খান সোহেল ১১০টি, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুদুর বিরুদ্ধে ৫০টি, ফজলুল হক মিলন ১২ ও নাদিম মোস্তফার নামে ২৭টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার বেশিরভাগেরই চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এছাড়া যুবদল সভাপতি সাইফুল আলম নিরবের নামে ২১৫ ও সাধারণ সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর বিরুদ্ধে ২১২টি মামলা রয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি সফিউল বারী বাবুর নামে ৩১টি মামলা রয়েছে।
কী করবে বিএনপি?
হঠাৎ করেই ধরপাকড় শুরু হওয়ায় আবারও কি বিছিন্ন হয়ে যাবে বিএনপি। নাকি নতুন কোনো কর্মসূচি দেবে দলটি। দলটির পক্ষে জানানো হয়েছে তারা দুই ধাপে কর্মসূচি দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। এই কর্মসুচির প্রথম ধাপে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কারামুক্তি এবং দ্বিতীয় ধাপে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের আন্দোলন করবে দলটি। দ্বিতীয় ধাপের কর্মসূচির আগে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৃহত্তর ঐক্যের বিষয়টিও জড়িয়ে আছে। এর মধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে কর্মসূচি দেওয়ার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে দলটির স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র একাধিক নেতা।
মুক্তি মিলবে কি খালেদার?
বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম জিয়া কারাগারে রয়েছেন প্রায় সাত মাস। চলতি বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়ে তাকে কারাগারে পাঠান আদালত। পরে ওই মামলায় জামিন হলেও পরে আরও ছয়টি মামলার গ্রেফতারি পরোয়ানা থাকায় তার মুক্তি মেলেনি। তিনি ৩৬ মামলার মধ্যে ৩৪টিতে জামিন পেয়েছেন তিনি। তবে আটকে আছেন আরও দুই মামলায়। যে কারণে তার জামিন মিলছে না। তবে খুব শিগগির ওই দুই মামলায়ও জামিন পেয়ে মুক্ত হবেন খালেদা জিয়া এমনটাই আশা করেন তার আইনজীবী।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন বলেন, সরকার যদি ‘হস্তক্ষেপ’ না করে তাহলে শিগগির বেগম জিয়া কারাগার থেকে মুক্তি পাবেন।
খালেদার মুক্তির ব্যাপারে আশাবাদী হতেই পারেন বিএনপি। কারণ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, খালেদা জিয়ার মামলার ব্যাপারে সরকার বিন্দুমাত্র হস্তক্ষেপ করবে না। তিনি আদালত থেকে জামিন পেলেই মুক্তি পাবেন। ওই দু’টি মামলার একটির শুনানির তারিখ ১২ সেপ্টেম্বর ও অপরটির ৫ সেপ্টেম্বর।