দেশের খবর: নির্বাচন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হলেও নির্বাচন ঘিরে অস্থিতিশীলতা দেখতে চায় না বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রগুলো। শুধু অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নয়, এ দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র দেখতে চায় তারা। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বিদেশি রাষ্ট্রদূত, সফরকারী উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধি বা বিদেশে নীতিনির্ধারকরা বাংলাদেশ নিয়ে এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন।
ঢাকায় বিভিন্ন দূতাবাসের কূটনীতিক বা প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে আভাস পাওয়া গেছে, প্রকাশের ধরন ভিন্ন হলেও বাংলাদেশ নিয়ে সবার প্রত্যাশা প্রায় অভিন্ন। তাঁরা সবাই চান, এ দেশের অগ্রযাত্রা আরো টেকসই হোক। বিশেষ করে, নির্বাচন ঘিরে কোনো অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা তাঁরা দেখতে চান না। কারণ এর প্রভাব দীর্ঘ মেয়াদে দেশের জনগণ, জীবনযাত্রা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ওপর পড়ে। দেশে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হলে বিদেশি বিনিয়োগকারী-ব্যবসায়ীদের কাছে নেতিবাচক বার্তা যায়। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও বাধাগ্রস্ত হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পশ্চিমা কূটনীতিক বলেন, পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে অন্য দেশগুলোর প্রকাশভঙ্গির কিছুটা পার্থক্য রয়েছে। পশ্চিমা দেশগুলো গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন ও মানবাধিকারকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেয় এবং রাখঢাক না রেখেই নিজেদের প্রত্যাশার কথা বলে, যেটি হয়তো অন্য অঞ্চলের দেশগুলো বলে না। কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে তাদের প্রত্যাশা পুরোপুরি আলাদা।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস গত জুন মাসে বাংলাদেশ সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে আগামী নির্বাচনের প্রস্তুতি বিষয়েও জানতে চেয়েছেন। বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন প্রত্যাশা নিয়ে সরব যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় দেশটির বিদায়ী রাষ্ট্রদূত গত সপ্তাহেও এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। তিনি এমন একটি নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন, যেখানে জনগণের প্রত্যাশার বহিঃপ্রকাশ ঘটে।
তবে বিদেশিরা কোনো ফর্মুলা বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেবে না—এমন কথাও বলেছেন কূটনীতিকরা। যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, নির্বাচনের প্রক্রিয়া কী হবে তা এ দেশের সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোই ঠিক করতে পারে।
সম্প্রতি ঢাকা সফরকারী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ এবং ডিএফআইডি প্রতিমন্ত্রী অ্যালিস্টার বার্ট সরকার ও বিরোধী দল উভয় পক্ষের কাছেই বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা জানিয়েছেন।
সাংবাদিকদের তিনি বলেছেন, ‘নির্বাচন বিষয়ে যুক্তরাজ্য আগের অবস্থানেই আছে। ২০২২ সালে আমাকে প্রশ্ন করা হলেও আমি একই কথা বলব। যুক্তরাজ্যের অবস্থান স্পষ্ট। যখন সবাই নির্বাচনে অংশ নেয় তখন এর গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি বাড়ে। যখন সবাই নির্বাচনে অংশ নেয় তখন সরকারের বৈধতা বাড়ে। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে এর বৈধতা যাচাই করা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।’ বাংলাদেশে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত রেঞ্চে টিয়েরিংক সম্প্রতি কালের কণ্ঠকে বলেছেন, ইইউ বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দেখতে চায়।
ঢাকায় চীনা দূতাবাসের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকরাও সাম্প্রতিক সময়ে বলেছেন, তাঁরা তাঁদের দেশ চীনের মতো বাংলাদেশেও নির্বিঘ্ন নির্বাচন ও স্থিতিশীলতা দেখতে চান।
নিকটতম প্রতিবেশী ভারত বাংলাদেশের নির্বাচনকে এ দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে অভিহিত করে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও তারাও এ দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী হবে বলে প্রত্যাশা করে। বিশেষ করে বাংলাদেশে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ভারতের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকার কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, বিদেশিরা, বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলো আগামী নির্বাচন নিয়ে আলোচনার সময় অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখার প্রত্যাশা করছে। সরকারের প্রতিনিধিরাও বলছেন, তাঁরা আশা করছেন যে অবাধ, সুষ্ঠু, বিশ্বাসযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হবে। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে দায়-দায়িত্ব উভয় পক্ষের। বিএনপিকে নির্বাচনে অংশ নিতে বলার জন্য তাঁরাও পরামর্শ দিচ্ছেন।
জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত ১৪ মে জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ইউনিভার্সেল পিরিয়ডিক রিভিউ (ইউপিআর) ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার সময় সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশকে এ বছর গণতান্ত্রিক, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দেওয়ার আহ্বান জানায়। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও মতপ্রকাশের সুযোগ সংকুচিত হওয়ার অভিযোগ তুলে উদ্বেগ এবং প্রকৃত নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বান জানায়। অস্ট্রেলিয়াও এ বছরের শেষ দিকে বাংলাদেশে অনুষ্ঠেয় নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক করার ওপর গুরুত্বারোপ করে। কানাডা আগামী নির্বাচনের আগে ও পরে রাজনৈতিক দলসহ সবার মতপ্রকাশ ও সমবেত হওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে বাংলাদেশকে সুপারিশ করেছে। অন্যদিকে জাপান বাংলাদেশকে সব দলের পূর্ণ অংশগ্রহণে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিশ্চিত করতে এবং গণতন্ত্র শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা জোরদার করার সুপারিশ করেছে।
আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হক এসবের জবাবে বলেছেন, বাংলাদেশ একটি বহু দলীয় গণতান্ত্রিক দেশ। এ দেশে রাজনৈতিক দলগুলো সমবেত হওয়ার ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ জানানোর স্বাধীনতা চর্চা করে। তিনি বলেন, এটি দুঃখজনক যে ২০১৪ সাল থেকে বিএনপি নির্বাচনী প্রক্রিয়া বর্জন বা ব্যাঘাত ঘটিয়েছে। অনেকেই এর নিন্দা জানিয়েছেন। সরকার যেকোনো মূল্যে জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। সংবিধান অনুযায়ী যথাসময়ে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জানা গেছে, সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে যে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে তা আমলে নিয়েছেন বিদেশিরাও। তাঁরা এর বাস্তবায়ন দেখার অপেক্ষায় আছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া ব্যুরোর প্রিন্সিপাল ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ও রাষ্ট্রদূত অ্যালিস জে ওয়েলস গত মাসে ওয়াশিংটনে ফরেন প্রেস সেন্টারে এক ব্রিফিংয়ে বলেছেন, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন, যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় ও বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে—এমন নির্বাচনের অঙ্গীকার পূরণ করতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারকে সব সময় উৎসাহিত করছে। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কেউ সহিংসতার পথ বেছে নিলে আমরা নিঃসন্দেহে তার নিন্দা জানাই। তবে আমাদের বার্তা হলো, বাংলাদেশে শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো সে দেশে আমেরিকান বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করবে এবং আমাদের অংশীদারি আরো জোরদারে সুযোগ করে দেবে।’