অনলাইন ডেস্ক: থানায় মামলা না করে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দুর্নীতি মামলার এজাহার দায়ের এবং বিশেষ জজ আদালতে সরাসরি চার্জশিট দাখিলের বিধান সংবলিত প্রস্তাবসহ দুদকের সংশোধিত বিধিমালা অবশেষে চূড়ান্ত হচ্ছে।
এদিকে চূড়ান্ত বিধিমালা কেমন হবে তা জানতে চেয়ে দুদকের কাছে কপি চেয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। সংশোধিত বিধিমালার একটি কপি আজ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হচ্ছে বলে দুদক সূত্রে জানা গেছে।
দুদকের সংশোধিত বিধিমালা চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে ১৮ অক্টোবর আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠকে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় দুদকের পক্ষে দুদক সচিব ড. শামসুল আরেফিন ও মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মো. মঈদুল ইসলাম অংশ নেন। আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় দুদকের বিধিমালা চূড়ান্তভাবে সরকারের অনুমোদন প্রাপ্তির বিষয়ে আলোচনা করা হয়।
দুদক মহাপরিচালক (লিগ্যাল অ্যান্ড প্রসিকিউশন) মো. মঈদুল ইসলাম জানান, বিধি বিষয়ে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দুদকের কাছে বিধির নমুনা দিতে বলা হয়েছে। আশা করি, শিগগির বিধিমালাটি চূড়ান্ত হবে। এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর গেজেট হবে। গেজেট হলেই দুদক কার্যালয়ে দুদকের তফসিলভুক্ত আইনে যে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করা যাবে। তিনি আরও বলেন, ২০০৭ সালের দুদক বিধিমালার বেশকিছু ধারা সংশোধনের জন্য লিগ্যাল শাখা থেকে কমিশনে লিখিত প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। এটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়। গত বছরের ১৪ মে দুদক থেকে সংশোধিত বিধিমালাটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ দুদকের বিধিমালাটি অনুমোদন করলে আইন মন্ত্রণালয় হয়ে সেটি রাষ্ট্রপতির কাছে যাবে। রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর সেটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। ওই কর্মকর্তা আরও জানান, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে দুদকের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল অন্যসব দেশে দুর্নীতির মামলা দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানে দায়ের করা হয় কিনা।
তিনটি দেশে খোঁজ নিয়ে এ ধরনের মামলা করার তথ্য পেয়েছে দুদক। দেশগুলো হল- সিঙ্গাপুর, হংকং ও মিয়ানমার। এসব দেশে দুর্নীতি দমন সংস্থায় দুর্নীতির মামলা রেকর্ড করা হয়। ১৮ জুলাই বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে লিখিতভাবে জানায় দুদক।
ফৌজদারি কার্যবিধি, দুদক আইন ও বিধি অনুসরণ করে দুদকের কর্মকর্তারা থানায় হাজির হয়ে দুর্নীতির মামলা করে থাকেন। কিন্তু দুদক মনে করছে, তারা স্বশাসিত স্বাধীন সংস্থা। এ সংস্থার পক্ষ থেকে দুর্নীতির মামলা দায়েরের জন্য থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই। দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে শুরু করে যে কোনো জেলা কার্যালয়ে এ মামলা করা যাবে। দুদকে এজাহার দায়েরের যৌক্তিকতা তুলে ধরে বিধিমালার সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়, ২০০৪ সালের আইন অনুযায়ী দুদক স্বাধীন।
এ সংস্থার নিজস্ব অনুসন্ধান ও তদন্তকারী কর্মকর্তা আছে। মামলা পরিচালনার জন্য আছে নিজস্ব প্রসিকিউশন ইউনিট। দুদকের তফসিলভুক্ত যে কোনো অপরাধের তদন্ত কার্যক্রম শুরুর জন্য থানায় এজাহার দায়ের বা থানার প্রতি মুখাপেক্ষী থাকা কমিশনের স্বাধীন ও স্বশাসিত সত্তার পরিপন্থী। এ ছাড়া থানায় এজাহার দায়েরের অবাধ সুযোগ থাকায় অযথা হয়রানির আশঙ্কাও থাকে।
এতে আরও বলা হয়, ‘দুদক বনাম মহীউদ্দীন খান আলমগীর’ মামলায় দুদকে এজাহার দায়েরের কথা আপিল বিভাগের রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে। অন্যদিকে, ২০০৭ সালের বিধিমালার ২(ছ) ধারায়ও দুদক কার্যালয়ে দুর্নীতি মামলার এজাহার দায়েরের সুযোগ ছিল।
কিন্তু বিধিতে সংশোধনী না আনায় কাজটা এতদিন করা সম্ভব হয়নি। এদিকে বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী, আসামিদের বিরুদ্ধে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দুদক চার্জশিট দিয়ে আসছে। কিন্তু এতে নানা ধরনের আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। চার্জশিট দাখিলের পর কখনও তা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে পড়ে থাকে। সেখান থেকে বিচারিক আদালতে যেতেও অনেক সময় পার হয়। দুর্নীতি মামলার বিচার ৬০ কার্যদিবসের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে চায় দুদক। এর জন্য উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশনাও জারি করা হয়েছে।
এই সময়সীমার মধ্যে বিচার নিষ্পত্তি করতে চার্জশিট ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে দাখিল না করে সরাসরি সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতে দাখিলের বিধান চেয়েছে দুদক। বিধান সংশোধনের প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘চার্জশিট সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালতে দাখিলের জন্য বিধান সুস্পষ্ট করা দরকার।
অন্যথায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতে পারে।’ এ সংক্রান্ত আইনটি তুলে ধরে সংশোধন প্রস্তাবে বলা হয়, ‘দ্য ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ১৯৫৮-এর ৪(২) ধারায়ও সংশ্লিষ্ট দায়রা জজকে সিনিয়র স্পেশাল জজ ঘোষণা করে অপরাধ আমলে নেয়ার একচ্ছত্র এখতিয়ার দেয়া আছে।’
এদিকে, বিধি অনুযায়ী কাউকে সম্পদের হিসাব দিতে নোটিশ জারির সাত কার্যদিবসের মধ্যে তাকে দুদকের নির্দিষ্ট ছকে হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হয়। এতে করে অনেকে একদিকে সঠিক হিসাব দিতে পারছেন না আবার সময় স্বল্পতার কারণে অনেকে তথ্যেও গরমিল করে বসেন।
আর এ কারণে অনেকের বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের মামলা হচ্ছে। এই সময়সীমা (৭ কার্যদিবসের পরিবর্তে) ২০ কার্যদিবস করতে চায় দুদক। সংশোধিত বিধিতে সেভাবেই প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়, ২০ কার্যদিবসেও যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি তার সম্পদ ও দায়দেনার হিসাব দিতে না পারেন, তবে এর জন্য আরও ১০ কার্যদিবস চেয়ে দুদকে আবেদন করার সুযোগ পাবেন।
বিচারাধীন কোনো দুর্নীতি মামলার আসামির মৃত্যু হলে তার রেখে যাওয়া সম্পদের কী হবে সে বিষয়ে দিকনির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। ওই ব্যক্তির সম্পদ অবৈধই থাকবে নাকি ওই সম্পদ মৃত আসামির উত্তরাধিকাররা পাবেন সে বিষয়েও বিধিতে মীমাংসা চাওয়া হয়েছে।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী, কোনো আসামির মৃত্যু হলে আর মামলা চলে না। দুদকের বিধি প্রস্তাবনায় বলা হয়, ‘বিচারের আগেই আসামির মৃত্যু হলে তার ক্রোক করা সম্পদের জন্য উত্তরাধিকাররা আদালতে আবেদন করতে পারবেন। কীভাবে ওই সম্পদ অর্জিত হয়েছে সেটা প্রমাণ করবে উত্তরাধিকাররা।
আদালত এ বিষয়ে শুনানি করবেন। শুনানিকালে উত্তরাধিকারদের পক্ষ থেকে দাখিল করা আবেদন ও কাগজপত্র পর্যালোচনা করে যদি দেখেন, ওই সম্পদ জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবে তা অবমুক্ত করতে পারবেন। অন্যথায় তা সরকারের কোষাগারে বাজেয়াপ্ত হবে।’ দুদক চায় দুর্নীতি মামলায় জড়িত মৃত ব্যক্তির সম্পদ তার উত্তরাধিকাররা যেন পায়।
অন্যদিকে, কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর দুদকের বিদ্যমান বিধি অনুযায়ী অনুসন্ধানের আদেশ পাওয়ার তারিখ থেকে ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে অনুসন্ধান কাজ শেষ করতে হয়। এত অল্প সময়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সহায় সম্পদ বা বড় ধরনের দুর্নীতির অনুসন্ধান করা বাস্তবে কঠিন।
এ অবস্থায় সংশোধিত বিধিতে দুর্নীতির অনুসন্ধানের সময়সীমা ১৫ কার্যদিবসের পরিবর্তে ৪৫ কার্যদিবস করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া দুদকের বিধিতে ‘জ্ঞাত আয়’ সম্পর্কিত সংজ্ঞা না থাকায় তা সংজ্ঞায়িত করার কথা বলা হয়েছে।
অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তার কার্যক্রম তদারক করা, তদারককারী কর্মকর্তা ও তার দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার বিষয় প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালতে কেউ দুর্নীতির মামলা করলে তা গ্রহণ ও তদন্তের নির্দেশ দিতে সিনিয়র বিশেষ জজ আদালতকে ক্ষমতা দেয়াসহ বেশকিছু বিষয়ে বিধিমালায় সংশোধনীর প্রস্তাব করা হয়েছে।
প্রচলিত আইন অনুযায়ী, দেশের যে কোনো নাগরিক বা যে কোনো সংস্থা থানায় দুর্নীতির মামলা করতে পারে। দুদকের আইনে ওই মামলা হলে পরে তা তদন্তের জন্য দুদকেই পাঠানো হয়। কিন্তু দুদক চাচ্ছে, পুলিশ দুদক আইনের মামলা পেলে তা মামলা হিসেবে নয়, সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করে অনুসন্ধানের জন্য দুদকের কাছে পাঠাবে।
কারণ অনুসন্ধান ছাড়া দুদকের তফসিলভুক্ত আইনে মামলা করা হলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি একদিকে আপক্ষ সমর্থনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে হয়রানির শিকার হন। এই বাস্তবতা সামনে রেখে দুদক বিধিতে সংশোধনীর প্রস্তাবে বলা হয়, ‘কোনো ব্যক্তির পক্ষ থেকে থানায় দায়ের করা অভিযোগ সরাসরি তদন্তের বিধান কিছুটা সাংঘর্ষিক।
কারণ দুদক কার্যালয়গুলোর পক্ষ থেকে দায়ের করা অভিযোগ অনুসন্ধান ছাড়া সরাসরি তদন্তের বিধান নেই। এ ছাড়া থানায় দায়ের করা মামলা সরাসরি তদন্তের জন্য নেয়া হলে অভিযোগ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির হয়রানির আশঙ্কা থাকে। ফলে পুলিশ এ ধরনের অভিযোগ পেলে তা সাধারণ ডায়েরি হিসেবে রেকর্ড করে পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনধিক দুই কার্যদিবসের মধ্যে দুদকে পাঠাতে হবে।