দেশের খবর: তফসিল ঘোষণার পর নড়েচড়ে বসেছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোট। ৭ দফা পূরণ ছাড়াই নির্বাচনে অংশ নেবে কিনা, সেই প্রশ্নে উভয় জোটের নেতাদের মধ্যে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তফসিল ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার রাতেই ২০ দলীয় জোটের বৈঠক হয়েছে। বিএনপির সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বৈঠকও হয়েছে। উভয় বৈঠক থেকে নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে বিভক্ত মত উঠে আসে।
এখন পর্যন্ত নেয়া মতামতে ২০ দলের ১০টি শরিক দল নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে ইতিবাচক মতামত দিয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির অধিকাংশ সদস্যও একই মত ব্যক্ত করেছেন। নির্বাচনে যাওয়ার বিপক্ষের অংশটি মনে করছে, আন্দোলনের বিকল্প নেই। আর পক্ষের অংশটি মনে করছে, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনের কৌশলও বাস্তবায়ন করা যাবে। এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণার আগে আজ বিকাল ৫টায় বিএনপির স্থায়ী কমিটি ও সন্ধ্যায় ২০ দলীয় জোট গুলশানে পুনরায় বৈঠকে বসছে।
একই ইস্যুতে রাতে ড. কামাল হোসেনের বেইলি রোডের বাসায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরও বৈঠক আছে। বিএনপি, ২০ দল ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মতামত নিয়ে আগামীকাল রোববার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কারাগারে দেখা করতে পারেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গেও আরেক দফা কথা বলবেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্তরা। সব আলোচনা শেষে দু-এক দিনের মধ্যেই আসবে নির্বাচনে অংশ নেয়া না নেয়া সংক্রান্ত ঘোষণা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট, বিএনপি এবং ২০ দলীয় জোট সূত্র জানিয়েছে, ঘোষিত তফসিলে নির্বাচনে অংশ নেয়া এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে কী কী প্রতিবন্ধকতা আছে, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বিএনপির থিংক ট্যাংক বা বিশেষজ্ঞ মহলে। উভয় জোটের পক্ষ থেকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে সরকার, নির্বাচন কমিশন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রম। তফসিল ঘোষণার পরও বিভিন্ন জেলায় বেশ কয়েকজন নেতাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
রাজশাহীতে জনসভায় যোগ দিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাস চলাচলে বিঘ্ন ঘটানো হয়েছে। ওই সমাবেশকে কেন্দ্র করে মহড়া দিয়েছেন সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা। এছাড়া গত কয়েক দিনে ২২ শতাধিক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নেতাকর্মীরা বাসায় ঘুমানো দূরের কথা, এলাকায়ও থাকতে পারছেন না। এমন পরিস্থিতিতে নির্বাচনে গেলে প্রচার-প্রচারণা করাও সম্ভব হবে না। ফলে নির্বাচনে যাওয়াটা ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এমন পরিস্থিতিতে কী করণীয়, সেসব বিশ্লেষণ শেষেই আসবে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে উভয় জোটের ঘোষণা।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জে. (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, বৃহস্পতিবার বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। তবে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। বৈঠকে ভালো-মন্দ বিশ্লেষণ হয়েছে। কী করা উচিত, কী করা উচিত না- এসব নিয়ে সবাই মতামত দিয়েছেন।
তিনি বলেন, বৈঠকে কেউ কেউ বলেছেন, সরকার তো তার জায়গা থেকে একটুকুও সরছে না। কিন্তু নির্বাচন করতে গেলে এখন আমরা অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন পাব না। নেতাকর্মী গ্রেফতার এখনও অব্যাহত রেখেছে। নির্বাচনে গিয়ে সরকারকে বৈধতা দেয়া হবে। আবার কেউ বলেছেন, নির্বাচন না করলে দলের আরও ক্ষতি হতে পারে। তবে এ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। শুধু আলোচনা হয়েছে। দু-এক দিনের মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে।
বিএনপির একটি সূত্র জানিয়েছে, নির্বাচনে অংশ নিতে হলে জোটগতভাবে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রয়োজন আছে। কেননা, জোটগতভাবে প্রার্থী দিতে হলে তিন দিনের মধ্যে তা জানাতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে। তাই আজকের উভয় জোটের বৈঠকে এ বিষয়টিও আলোচনায় আসবে।
উল্লেখ্য, শুক্রবার নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, জোটগতভাবে নির্বাচন করতে চাইলে তিন দিনের মধ্যে কমিশনকে জানাতে হবে। আজই দলগুলোকে এ বিষয়ে চিঠি দেয়া হবে।
তিনি বলেন, কোনো অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সদস্য যদি নিবন্ধিত কোনো দলের হয়ে বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে চান, তাহলে সেটি সম্ভব। এ অবস্থায় জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ও ২০ দলীয় জোটের আজকের বৈঠকটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়েছেন উভয় জোটের নেতারা।
বৃহস্পতিবার গুলশান কার্যালয়ে ২০ দলীয় জোটের বৈঠকে নির্বাচন নিয়ে শরিক দলগুলোর মধ্যে ১১টি দলের মতামত নেয়া হয়। সূত্র জানায়, এর মধ্যে ১০টি শরিক দল নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে মত দেয়। যদিও তারা আন্দোলনের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেয়া উচিত বলে মনে করছে। সেখানে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ বাকি ৯ দল তাদের মতামত জানানোর আগেই জোটের বৈঠক মুলতবি করা হয়। আজ সন্ধ্যা ৭টায় বৈঠকটি গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হবে।
জোটের অন্যতম শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) মহাসচিব ড. রেদোয়ান আহমেদ বলেন, আমাদের সাত দফা দাবি ছিল। এর কোনোটিই প্রধানমন্ত্রী মানেননি। সরকারের যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের সদিচ্ছা থাকত, তাহলে তারা দাবিগুলো মেনে নিত। কিন্তু এখন পর্যন্ত একদফা দাবিও মানা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, সংলাপের পর আনুষ্ঠানিকভাবে বক্তব্য দেয়ার কথা ছিল প্রধানমন্ত্রীর। তা-ও তিনি দেননি।
তিনি যদি তার বক্তব্যে ৭ দফা দাবির মৌলিক কিছু বিষয় মেনে নেন, তাহলে নির্বাচনে যাওয়ার পথ সুগম হতো। ড. রেদোয়ান বলেন, তারা ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করবে, সেটা অপর পক্ষের জন্য সমান সুযোগ নয়। ২০ দলীয় জোট নির্বাচনে অংশ নেয়ার বিপক্ষে নয়। কিন্তু নির্বাচনের তফসিল যদি পরিবর্তন করা হয়, খালেদা জিয়ার মুক্তি দেয়া হয়, ধরপাকড় বন্ধ ও ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়, তাহলে নির্বাচনের পথ সৃষ্টি হতে পারে।
জোটের শরিক ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, নির্বাচনে যাওয়া উচিত। নির্বাচন একটি আন্দোলনের অংশ। তাই অবশ্যই আমরা যাব। এ সরকার মিথ্যা মামলায় খালেদা জিয়াকে আটকে রেখেছে। তাকে জামিন দিচ্ছে না। আমরা আন্দোলন ও নির্বাচনের মাধ্যমে খালেদা জিয়াকে মুক্ত করব।
নির্বাচনে না গেলে আমাদের কর্মী ধরে রাখা যাবে না। সরকার আরেকটি ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের মতো ভোট করবে। সরকার চাচ্ছে না ২০ দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে আসুক। এজন্য যা যা করা দরকার, তা তারা করছে। যদি নির্বাচনে না যাই, তাহলে সরকারের ফাঁদে পা দেয়া হবে।
আরেক শরিক দল বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, সরকার একটি পাতানো নির্বাচন করতে চায়। এজন্য একটি আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন দিয়ে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। দেশের গণতন্ত্রকামী কোনো রাজনৈতিক দল এ তফসিলকে স্বাগত জানায়নি। সুতরাং এ তফসিলে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন হবে না। নতুন করে তফসিল দিতে হবে। তিনি বলেন, আমরা অবশ্যই নির্বাচনে যেতে চাই। তার আগে দাবিগুলো মানতে হবে।
সূত্র জানায়, জোটের বৈঠকের পর বৃহস্পতিবার রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও অধিকাংশ সদস্য আন্দোলনের কৌশল হিসেবে নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে মত দেন।
তারা বলেন, আন্দোলন ও নির্বাচন একই সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে। নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আন্দোলনের কৌশলও বাস্তবায়ন করা যাবে। তবে কয়েকজন নীতি-নির্ধারক আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। তারা বলেন, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে রাজপথের আন্দোলনে যাওয়া উচিত। বর্তমান অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া ঠিক হ?বে না জানি?য়ে তারা বলেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কয়েক মাস ধরে নির্বাচনী প্রচার চালালেও বিএনপির প্রার্থীরা এলাকায় যেতে পারছেন না। তারা নিজেদের কার্যালয়েও যেতে পারেন না। দলের তৃণমূল পর্যন্ত মামলার পাহাড়।
এ অবস্থায় তারা নির্বাচনের কার্যক্রম চালাতে পারবেন না। আবার খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে গেলে তৃণমূল নেতাকর্মীদের বাধার সম্মুখীনও হতে পারি। এ অবস্থায় শুধু নির্বাচনকে বৈধতা দেয়ার জন্য অংশগ্রহণ কোনোক্রমেই ঠিক হবে না। তবে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। নীতি-নির্ধারকদের মতামত নিয়ে একটি সারসংক্ষেপ করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, স্থায়ী কমিটির করা সারসংক্ষেপ লন্ডনে থাকা দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে এরই মধ্যে পাঠানো হয়েছে। এ নিয়ে তিনি দলের বেশ কয়েকজন নীতি-নির্ধারকের সঙ্গে কথা বলেছেন। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নীতি-নির্ধারকদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলের মতামতকে প্রাধান্য দিতে বলেছেন। তাদের মতামত পেলে তিনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবেন বলে বিএনপি সূত্রে জানা গেছে। সূত্র: যুগান্তর