দেশের খবর: ভোটের মাঠে সম্ভাব্য সংঘাত-সহিংসতার শঙ্কায় আছেন নির্বাচনি কর্মকর্তারা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির সংসদ নির্বাচন এবং এরপর স্থানীয় সরকার পরিষদের নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক গোলযোগের প্রেক্ষাপটে একাদশ সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে তালিকাভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে উদ্বেগ কাজ করছে। এরই মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে দলীয় পরিচয়সহ ঠিকুজির সন্ধান করায় নতুন করে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন সরকারি ও সরকারি সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। এমন প্রেক্ষাপটে নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে অনীহা কাজ করছে তাদের অনেকের মধ্যে। নানা অজুহাত দেখিয়ে তারা নির্বাচন থেকে বিরত থাকতে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি অফিসসহ রিটার্নিং অফিসে আবেদন করছেন। অবশ্য এবারের নির্বাচনে দেশের প্রায় সব দলের অংশগ্রহণের ঘোষণায় কিছুটা হলেও স্বস্তিবোধ করছেন তারা।
নির্বাচন কমিশনের ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ সংসদ নির্বাচনের ভোট নেওয়া হবে। দেশের ৩০০টি আসনে ৪০ হাজার ১৯৯টি কেন্দ্রে দুই লাখের বেশি ভোটকক্ষ থাকবে। একজন প্রিজাইডিং অফিসার, দুই বা ততোধিক সহকারী প্রিজাইডিং অফিসার এবং প্রতিটি ভোটকক্ষে অন্তত দুইজন পোলিং অফিসার মিলিয়ে কেন্দ্রপ্রতি ভোটার সংখ্যার বিবেচনায় ১০ থেকে ২০ জন নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। এছাড়া ৫ থেকে ১০ শতাংশ কর্মকর্তা থাকবেন রিজার্ভ হিসেবে। সব মিলিয়ে সাত লাখের বেশি নির্বাচনি কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করবেন আগামী জাতীয় নির্বাচনে।
একাদশ সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে এরই মধ্যে নির্বাচনি কর্মকর্তার তালিকা তৈরির জন্য ইসি থেকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের প্রিজাইডিং কর্মকর্তা এবং দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তাদের সহকারী প্রিজাইডিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পোলিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হবে।
নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কোনও প্রার্থীর অধীনে কোনও সময় চাকরি করেছেন, এমন ব্যক্তিদের ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া যেসব কর্মকর্তার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন আছে তাদেরও নিয়োগ দেওয়া যাবে না।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিএনপি ও তাদের মিত্রদের বর্জনের মধ্য দিয়ে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশব্যাপী ব্যাপক সহিংসতা হয়। ওই নির্বাচনের ভোটের দিনই ১৯ জন নিহত হন। ২০১৩ সালের ২৫ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল থেকে ভোটগ্রহণ পর্যন্ত নিহত হন ১২৩ জন।
নির্বাচন কমিশনের তথ্যমতে, নির্বাচনের সময় সহিংস ঘটনায় তিনজন নির্বাচন কর্মকর্তা নিহত এবং ৩৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী আহত হন। আহতদের তালিকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও আছেন।
নির্বাচনি কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত এমন দেড় শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পুড়িয়ে দেওয়াসহ ব্যাপক ভাঙচুর হয়। বর্তমান সরকারের দাবি, গত সংসদি নির্বাচনে পাঁচ শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেকগুলো পর্যবেক্ষক সংস্থা তাদের পর্যবেক্ষন বন্ধ রাখে। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে গত পাঁচ বছরে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও ব্যাপক সহিংসতা হয়। এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হতাহতের ঘটনা অতীতের সব কেকর্ড ছাড়িয়ে যায়। এসব নির্বাচনে ভোটার, সাধারণ মানুষ ছাড়াও নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তারাও আহত হন। বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে ভোটকেন্দ্র থেকে নিরাপত্তাজনিত কারণে নির্বাচনি কর্মকর্তারা বের হতে না পারলে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে তাদের উদ্ধার করে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে পালিয়ে প্রাণ বাঁচানোর ঘটনাও ঘটেছে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে ছিলেন নির্বাচনি দায়িত্বে থাকা নারী কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহীসহ বেশ কিছু অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে, নির্বাচনি তালিকা তৈরির সময় অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের নাম তালিকাভুক্ত না করতে উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও উপজেলা নির্বাচন অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এক্ষেত্রে কেউ কেউ অসুস্থতাসহ নানা কারণ দেখানোর চেষ্টা করছেন। কিছু কিছু ক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে বা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে তদবির করানোর ঘটনাও ঘটছে। নির্বাচনি দায়িত্বের তালিকা থেকে নাম কাটানোর তদবিরে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন বলে একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
দায়িত্ব পালনে অনীহা আছে এমন কয়েকজনের কারণ তারা জানালেও নিজেদের নাম-ঠিকানা প্রকাশ করতে চাননি। নির্বাচনি দায়িত্ব পালন না করার কারণ হিসেবে লিখিত বা মৌখিক আবেদনে পারিবারিক সমস্যার কথা জানালেও মূলত সংহিসতার আশঙ্কার কারণেই তারা দায়িত্ব থেকে দূরে থাকতে চাইছেন বলে স্বীকার করেন। অবশ্য দু’-একজনের আবেদনের পেছনে যৌক্তিক কারণও রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচন এবং পরবর্তী নির্বাচনের সময়ের ঘটনা তুলে ধরে তারা বলেছেন, আগে নির্বাচনকে তারা উৎসব হিসেবে মনে করতেন। প্রতি পাঁচ বছরে ২/৩ বার নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে তাদের মধ্যে নতুন অনুভূতি কাজ করতো। কিন্তু এখন এটা আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চট্টগ্রামের মহানগরীরকে কর্মরত সরকারের একটি দফতরের কর্মচারী আহসান হাবীব জানান, নির্বাচনি দায়িত্ব পালন থেকে বিরত থাকতে তিনি স্থানীয় নির্বাচন অফিসে যোগোযোগ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘তারা বিষয়টি দেখবেন বলেছেন। তবে আশ্বস্ত হতে পারিনি।’ কেন দায়িত্ব পালন করতে চান না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার শারীরিক কিছুটা অসুস্থতা রয়েছে, টানা অনেকক্ষণ কাজ করতে পারি না। এরপর নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে কী হয় না হয়, সেটা তো বলা যায় না!’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দিনাজপুর জেলার একটি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান বলেন, ‘দশম সংসদ নির্বাচনের সময় সংসদ নির্বাচনে তিনি যে কেন্দ্রের দায়িত্বে ছিলেন তাতে দুর্বৃত্তরা আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। অন্যান্য নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিয়ে কোনোমতে নিজেদের রক্ষা করতে পারলেও নির্বাচনি সামগ্রী তারা রক্ষা করতে পারেননি। সেই ঘটনার পর নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করতে মন সাড়া দেয় না। কিন্তু কী-ই বা করার আছে? সরকারি দায়িত্ব পালন তো করতেই হবে।’
ঢাকার কেরানীগঞ্জের একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজন সহকারী শিক্ষক বলেন, ‘আগে-পরে অনেকবারই নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করেছি। কিন্তু এবার যেটা শুরু হয়েছে তাতে আতঙ্ক কাজ করছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বাড়িতে এসে আমাদের খোঁজ নিচ্ছে। সব ঠিকানা জানার পাশাপাশি রাজনৈতিক পরিচয় জানতে চাচ্ছেন। এটা সত্যি বিব্রতকর। দায়িত্ব দেওয়ার আগে যেভাবে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে, পরে কী হবে— সেটা নিয়েই টেনশনে আছি!’
খুলনা সদর থানা এলাকায় কর্মরত একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে নির্বাচনে দায়িত্ব পালন আমাদের করতে হয়। কিন্তু পরিবারের কেউ চান না, আমি নির্বাচনি দায়িত্ব পালন করি। নির্বাচনি দায়িত্বে গেলে আমাদের আতঙ্কের মধ্যে থাকতে হয়। কখন কী হয়, এটা নিয়ে উদ্বেগে থাকতে হয়। আগে এই পরিস্থিতি না হলেও কয়েক বছর ধরে এই আশঙ্কা কাজ করছে।’
সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা নাজিম উদ্দিন জানান, উপজেলা নির্বাহী অফিস ও উপজেলা নির্বাচন অফিসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করেন তারা। তালিকা তৈরি করার সময় সরকারি-বেসরকারি কর্মকার্তাদের মধ্যে মিশ্র অবস্থান পাওয়া যায়। অনেক সময় দেখা যায় আগ্রহ প্রকাশ করে কেউ কেউ দায়িত্ব নেন। আবার অনেকে নাম কাটানোর জন্য তদবির করেন। আর নির্বাচনে সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দিলেই তারা ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে চান না। এবার দায়িত্ব পালনের আগ্রহ প্রকাশ করে কোনও তদবির চোখে পড়েনি। বরং অন্যবারের তুলনায় নাম কাটানোর তদবির কিছুটা বেশি দেখা গেছে।
রংপুর বিভাগের একজন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা জানান, অতীতে নির্বাচনি কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করতে খুব একটা বেগ পেতে হতো না। কিন্তু দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনের সময় থেকে অনেকের মধ্যে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহ তৈরি হয়েছে। সহিংসতার আশঙ্কায় অনেকে দায়িত্ব যাতে না দেওয়া হয় সে জন্য তদবির করতে আসেন। তাদের মধ্যে একটি ভয় কাজ করে। তবে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কারণে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কারো তদবির রাখা সম্ভব হয় না। এবারের সংসদ নির্বাচনে নির্বাচনি কর্মকর্তার প্যানেল তৈরির সময় অনেকের মধ্যে দায়িত্ব পালনে অনীহা দেখা দিয়েছে বলেও উল্লেখ করেন এই কর্মকর্তা।
চট্টগ্রাম জেলা সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান বলেন, ‘কর্মকর্তা চেয়ে পাঠানো চিঠির জবাবে কিছু কর্মকর্তা দায়িত্বে না থাকার কথা জানিয়েছেন। এখানে অসুস্থতা, আবার অনেকেই ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়েছেন। যারা নানা সমস্যা-অজুহাত দেখিয়েছেন তাদের যাবতীয় তথ্য যাচাই-বাছাই করবে নির্বাচন কমিশন।’ যৌক্তিক কারণ ছাড়া কোনও কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন না করে পার পাবেন না বলেও তিনি জানান।
ঢাকা জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা (উপসচিব) ফয়সল কাদের বলেন, ‘অনেকেই দায়িত্ব পালনে অনীহা জানিয়ে তাদের কাছে আবেদন করেছেন। অবশ্য বেশির ভাগ আবেদনের কারণ পারিবারিক। এর মধ্যে যাচাই করে যৌক্তির কারণ থাকলে সেগুলো বাদ দিয়ে রিজার্ভ থেকে সেখানে নিয়োগ দেওয়া হবে। তবে কারণ যৌক্তিক না কলে নির্বাচনি দায়িত্ব পালন না করার সুযোগ কারো নেই।’
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীর নির্বাচনে দায়িত্ব পালনে অনাগ্রহের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। যৌক্তিক কারণ থাকলে কেউ দায়িত্ব পালন না করতেই পারেন। তবে কোনও অজুহাত দেখিয়ে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে কোনও শৈথিল্য বা অবহেলা দেখানোর সুযোগ নেই। এরকম হলে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
নিরাপত্তা বিষয়ে এই কমিশনার বলেন, ‘ভোটার, ভোটের সামগ্রী ও নির্বাচনি কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সেই অনুযায়ী অবশ্যই আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নেবো। আর ২০১৪ সালের নির্বাচনের যে কথা বলছেন, আমার মনে হয় না এবার সেই ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। কারণ, ২০১৪ সালে একটি পক্ষ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু এবার আমরা দেখছি সকলেই নির্বাচনে আসছেন। আর নির্বাচন অংশগ্রহনমূলক হলে স্বাভাবিকভাবেই তা শান্তিপূর্ণ হয়।’