বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান ওমরাহ পালন করায় এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুমুল আলোচনা চলছে। কেউ কেউ একজন কমিউনিস্টের ওমরাহ পালনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ সমাজতন্ত্রের সঙ্গে ধর্মের বিরোধ নেই উল্লেখ করে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কী আছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
সিপিবির সঙ্গে রাজনৈতিক বিরোধ আছে এমন বামপন্থীরা আবার ওয়ার্কার্স পার্টি সভাপতি ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন এবং জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর হজব্রত পালনের সময় যে কথা উঠেছিল ওই প্রসঙ্গ টেনে এনে তখন কেন সমালোচনা হয়েছিল সে প্রশ্ন তুলেছেন।
চলতি সপ্তাহে মক্কায় ওমরাহ পালন করে এখন মদীনায় আছেন একসময়ের জনপ্রিয় শ্রমিকনেতা এবং সিপিবির সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান।
তার ওমরাহ পালনের খবরে কানাডাপ্রবাসী সাংবাদিক শওগাত আলী সাগর ফেসবুকে পরিহাসের সুরে লিখেছেন: সিপিবি নাকি ‘ইসলামি সমাজতন্ত্র’নামে নতুন ধরনের সমাজতন্ত্রের কর্মসূচী ঘোষনা করতে যাচ্ছে?
সরাসরি না হলেও তার জবাব পাওয়া গেছে সাবেক ছাত্রনেতা মুখলেছউদ্দিন শাহীনের ফেসবুক পোস্টে। নিজে সিপিবিপন্থী বাম ধারার না হলেও এক্ষেত্রে তিনি কোন সমস্যা দেখছেন না।
শাহীন তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন: সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে যে সাম্যের কথা বলা আছে তার সাথে ধর্মের বিরোধ না করেও সেই সাম্য ব্যবস্থাকে সমর্থন করা যায়। উৎপাদনের উপায়ের ব্যাক্তি মালিকানা উচ্ছেদ করে সামজিক তথা রাষ্ট্রীয় মালিকানা আরোপ করাই হচ্ছে সমাজতন্ত্রের মুল ধারণা। এর সাথে ধর্মীয় বিরোধ তৈরি করা একটি অপরিপক্ক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি। এই অপরিপক্ক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমাজে বদ্ধমুল ধারণা যে কমিউনিস্টরা নাস্তিক।
কিন্তু, সেটা যে ঠিক নয় তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি বলছেন: পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, মন্দিরে পূজা দিয়ে, গির্জায় উপাসনা করেও উৎপাদনের উপায়ের রাষ্ট্রীয় মালিকানাকে সমর্থন করা যায়। এর সাথে ধর্ম পালন করা না করার কোন সম্পর্ক নেই।
‘সিপিবির সাবেক সভাপতি মঞ্জুরুল আহসান খান ওমরাহ হজ্জ করাতে মনে হচ্ছে কমিউনিস্টদের জাত গেল। তাহলে কমিউনিস্টদেরও জাত ধর্ম আছে, সেই ধর্ম হচ্ছে ধর্ম পালন না করা, ’এরকম উল্লেখ করে তিনি জানাচ্ছেন: বিশ্বের একমাত্র মুসলিম কমিউনিস্ট দেশ ছিল ইউরোপের আলবেনিয়া । সেই দেশের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার হোজ্জা এক সময় বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রভাব বিস্তারকারী নেতা ছিলেন এবং তার দেয়া তত্ত্ব জনগণতন্ত্র স্তালিনের নেতৃত্বে কমিউনিস্টদের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকে গ্রহণ করা হয়েছিল এবং সেই মোতাবেক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পূর্ব ইউরোপে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছিল।
শাহীন মনে করেন: আলবেনিয়ার মতো সংখাগরিষ্ঠ একটি মুসলিম দেশে কমিউনিস্টরা ক্ষমতায় যাওয়াতে ধর্মের সাথে কোন বিরোধ হয় নাই। উৎপাদনের উপায়ের রাষ্ট্রীয় মালিকানার মাধ্যমে সাম্যের পথে এগিয়ে যাওয়ার যে অর্থনৈতিক রূপরেখা তা নামাজ-কালাম পড়েও বাস্তবায়ন বা সমর্থন করা যায়।
‘এই সামান্য বুদ্ধিটা কমিউনিস্টদের নাই বলে সাবেক সিপিবি সভাপতি ওমরাহ হজ্জে মোনাজাত করে দোয়া করেছেন যেন “আল্লাহ কমিউনিস্টদের বুদ্ধি বাড়িয়ে দেন” ।
কমিউনিস্টদের এরকম ‘বুদ্ধি-শুদ্ধি’র কারণেই মঞ্জুরুল আহসান খান দোয়া করেছেন বলে শাহীন যে কথা বলছেন সেখানেই অবশ্য ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মনজুরে-খোদা-টরিক এর আপত্তি।
নিজের পোস্টে তিনি বলেছেন: কয়েকজন বন্ধু আমাকে একটা লিংক পাঠিয়েছেন এবং লিখেছেন, আপনার নেতা, কমরেড মঞ্জুরুল আহসান খান, হ্জ্ব পালন করছেন! সাথে মঞ্জু ভাইয়ের ছবি ও একটি জাতীয় দৈনিকের লিংক। তারা হয়তো আমাকে বিষয়টি নিয়ে খোঁচা দেয়া, নয়তো অবগত করার জন্য ইনবক্স করেছেন। আমি বিব্রত!
‘তিনি হ্জ্ব করবেন, নামাজ পড়বেন, ধর্মকর্ম করবেন সেটা তার ব্যক্তিগত বিষয়, সেটা নিয়ে আমার কোন কথা নেই। কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতা হিসেবে তিনি যে মন্তব্য করেছেন সেটা নিয়ে কয়েকটা কথা আছে,’ উল্লেখ করে তার কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, সেখানে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন তার পুরোটাই রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক।
‘হ্জ্বরত অবস্থায় মক্কা থেকে তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, বামপন্থীদের সবার মাথায় যেন বুদ্ধি আসে সে জন্য দোয়া করেছেন!’ এটা উল্লেখ করে কিছু প্রশ্ন তুলেছেন টরিক:
১. তিনি কি বিশ্বাস করেন যে, হজ্বে যে দোয়া করবেন, আল্লাহ তা কবুল করবেন! এবং সেই জন্যই তিনি সেখানে গেছেন! কারণ তিনি তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে অনেক চেষ্টা করেছেন, বামপন্থীদের মাথায় বুদ্ধি আনয়নের জন্য, তার কোন দাওয়াই কাজে না লাগায়- তিনি চুড়ান্ত গায়েবী দাওয়াইয়ের জন্য হজ্বে গেছেন!
২. তাহলে কি এবার নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ওনার দেশে ফেরার মধ্যে দিয়ে দেশের সকল বামদের মাথায় বুদ্ধি কিলবিল করবে!
৩. তিনি কি মনে করেন তিনিই (তার দলের কারো কারো) বাংলাদেশের একমাত্র বামনেতা যার মাথায় অনেক বুদ্ধি, আর সবাই কাণ্ডজ্ঞানহীন বা কম বুদ্ধির মানুষ..?
৪. দোয়া দিয়েই যদি কাজ হয়, তাহলে এত লড়াই, সংগ্রাম, বিপ্লব, বিদ্রোহ, জেল-জুলুম, সংগঠনের দরকার কি..?
৫. তিনি যদি মনে করেন, না আসলে ঠিক তা না, হজ্ব করতে কিছু দোয়া করতে হয় তাই করেছি! তাহলে প্রশ্ন তিনি তা গোপন রাখতে পারতেন! সেটা না করে কেন সাংবাদিকদের ঘটা করে তা বলতে গেলেন?
৬. কমিউনিস্ট পার্টি কি এখন ধর্ম-কর্ম-সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে..?
৭. কেউ যদি বলেন, এটা তাঁর ব্যক্তিগত সফর, তাহলে প্রশ্ন: তিনি সাক্ষাতকারে তেমন ব্যক্তিগত কথা বলেননি (পত্রিকায় যেটুকু দেখেছি), পুরোটাই রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক বক্তব্য রেখেছেন!
৮. নাকি হজ্ব পালন একটি রাজনৈতিক কৌশল..? যেহেতু আমাদের দেশে একটি প্রচারণা আছে কমিউনিস্ট মানেই নাস্তিক, সেই অপবাদ ঘোঁচাতে ও প্রমাণ করতে যে, কমিউনিস্টরাও ধর্মকর্ম করে! কিন্তু এই কৌশল কি কাজে দেবে..?
৯. হজ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে কমিউনিস্ট-বামপন্থীরা অনেক আলোচনা-সমালোচনা করত.. এখন নিজেরাই তার অন্তর্গত প্রায়.. কোন জবাব আছে কি..?
১০. কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে কি মঞ্জু ভাইয়ের এই বক্তব্যের কোন ব্যাখ্যা দেয়া হবে..?