দেশের খবর: বিদায়ী শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠতা অর্জন করে অন্তত দুই শতাধিক কর্মকর্তা ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন দফতর-প্রতিষ্ঠানে ‘লোভনীয়’ পদে চাকরি করছেন। তাদের মধ্যে ডজনখানেক কর্মকর্তা গোটা শিক্ষা খাত নিয়ন্ত্রণ করছেন। এবার শিক্ষামন্ত্রী নতুন হওয়ায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী এসব কর্মকর্তার মধ্যে বদলি আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
জানা যায়, বছরের পর বছর একই পদে থাকায় কেউ কেউ গড়ে তুলেছেন দুর্নীতির সিন্ডিকেট। বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অদক্ষতা, অযোগ্যতা আর দুর্নীতির কারণে সরকার বারবার বিব্রত হয়েছে। এ নিয়ে গোয়েন্দা সংস্থা থেকে বারবার প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও কয়েক দফা সুপারিশ করে।
এ ছাড়া নানা সময়ে খবরের শিরোনাম হলেও চিহ্নিতরা রহস্যজনক কারণে পার পেয়ে গেছেন।
শিক্ষার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলোতে খোঁজ নিয়ে আরও জানা যায়, রোববার মন্ত্রিসভার নতুন সদস্যদের নামের তালিকা প্রকাশের পর থেকে সুবিধাভোগী ওইসব কর্মকর্তা পদ রক্ষায় দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। নতুন শিক্ষামন্ত্রী ও উপমন্ত্রীর কাছের লোক খুঁজছেন তারা। কেউ এলাকার আবার কেউ দলীয় পরিচয়ে পদ রক্ষায় নেমেছেন। উপযাজক হয়ে শুভেচ্ছা জানানোর নামে অনেকেই ধরনা ধরছেন নতুন মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে, অফিস-বাসায়।
বছরের পর একই পদে থাকা এবং অনিয়ম-দুর্নীতিগ্রস্তদের সম্পর্কে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আই কে সেলিমউল্লা খোন্দকার বলেন, নতুন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ সুশাসন নিশ্চিত করা। ঘুষখোর ও দুর্নীতিবাজরা সুশাসনের পথে অন্তরায়।
তাই সুশাসনের স্বার্থে খারাপ লোকদের অবশ্যই সরিয়ে দেয়া উচিত। এ ক্ষেত্রে কে বা কারা ক্রমাগত দুর্নীতিতে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে গেছেন তাদের তথ্য অবশ্যই সরকারের কাছে আছে। গোয়েন্দা সংস্থার তালিকা ধরে ওইসব ব্যক্তির ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া হলে আমাদের কোনো বক্তব্য থাকবে না।
তবে বছরের পর বছর একই পদে থেকেও যদি কেউ দুর্নীতিগ্রস্ত না হয়; সে ক্ষেত্রে তার ব্যাপারে ইতিবাচক চিন্তা করলে সরকারের কোনো সমস্যা হবে বলে মনে হয় না।
শিক্ষা বিভাগের প্রশাসনিক কাজের কেন্দ্রবিন্দু শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। মন্ত্রণালয়ে ৩ থেকে ১০ বছর কর্মরত আছেন অন্তত এক ডজন কর্মকর্তা। ওইসব কর্মকর্তার ব্যাপারে নানা অভিযোগ আছে। সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর ওপর ভর করে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক প্রকার খুঁটি গেড়ে বসে আছেন।
আরেক গুরুত্বপূর্ণ দফতর মাউশির মহাপরিচালক পদে নিয়মিত পরিবর্তন আসে। কিন্তু কয়েকজন মুখচেনা কর্মকর্তা ঘুরে-ফিরেই পরিচালক ও উপ-পরিচালকসহ অন্য পদগুলোতে আছেন। একজন পরিচালকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পের বিবিধ খাতসহ অন্যান্য অর্থ নানাভাবে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ আছে।
এ ছাড়া প্রকল্পের কেনাকাটায় প্রভাব বিস্তার, কেনাকাটার অর্থ পরিশোধে বিধিবিধান লঙ্ঘনসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ আছে। ওই পরিচালক এর আগে মাউশির উপ-পরিচালক ছিলেন। নানা অভিযোগের কারণে তাকে ইডেন কলেজে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু অদৃশ্য হাতের ইশারায় কিছুদিন পরই তিনি ফিরে আসেন। ওই কর্মকর্তার রাজনৈতিক আদর্শ নিয়েও প্রশ্ন আছে।
প্রকল্পের কেনাকাটায় অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়ানোর অভিযোগ আছে আরেক পরিচালকের বিরুদ্ধেও। বিভিন্ন টেন্ডারে সর্বনিম্ন দরদাতাকে ঠুনকো অভিযোগে বাদ দিয়ে বেশি দরে কাজ দেয়ার অসংখ্য অভিযোগ তার বিরুদ্ধে।
উচ্চশিক্ষা মানোন্নয়ন প্রকল্পে চাকরি করে আসা ওই পরিচালকের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অনিয়ম চালিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আছে। সংস্থাটির একজন উপ-পরিচালক ছিলেন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদফতরে (ডিআইএ)।
২০০৯-২০১৪ সালের সংসদের শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির এক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে বদলি করা হয়। ওই প্রতিবেদনে ১৭ জনকে বদলির সুপারিশ ছিল। কিন্তু কয়েকজনকে বদলির পর রহস্যজনক কারণে প্রক্রিয়া থেমে যায়।
বদলি ব্যক্তিদের একজনকে মাউশির গুরুত্বপূর্ণ উপ-পরিচালক পদে বসানো হয়। দুর্নীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত থাকার দায়ে মাউশির কয়েকজন সহকারী পরিচালককে বদলি করা হয় গত ফেব্রুয়ারিতে। কিন্তু তারা নতুন কর্মস্থলে যোগ না দিয়ে দু’মাস পর অদৃশ্য কারণে মাউশিতেই বহাল হন।
ওই কর্মকর্তাদের মধ্যে একজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগসহ প্রতি সপ্তাহে একটি চিঠি মন্ত্রণালয়ে এবং সংবাদপত্রের অফিসে পাঠাচ্ছেন ভুক্তভোগীরা। আরেকজনের বিরুদ্ধেও বদলি বাণিজ্য এবং সিনিয়র কর্মকর্তা ও সেবাপ্রার্থীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ আছে। মাউশির ৯টি আঞ্চলিক অফিস আছে।
ওইসব প্রতিষ্ঠানে যেসব পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালক আছেন তাদের অনেকের বিরুদ্ধে এমপিওভুক্তি, বিভিন্ন তদন্তসহ নানা কাজে আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়ার অভিযোগ আছে।
ঢাকার আঞ্চলিক অফিসে সেসিপের থেকে নিয়োগ করা পরিচালক, উপ-পরিচালক ও সহকারী পরিচালকদের মধ্যে কয়েকজন দুর্নীতিতে জড়ানোর অভিযোগ ঘোরতর। তাদের মধ্যে একজন এর আগে মাউশির বেসরকারি কলেজ শাখায় কর্মরত ছিলেন। অনিয়মের কারণে তাকে সেখান থেকে বের করে দেয়া হয়েছিল।
এ ছাড়া শিক্ষা ভবনে আছে বিভিন্ন প্রকল্পের অফিস। আছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর এবং ডিআইএ। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কেউ কেউ ২০ বছরও আছেন একই জায়গায়।
ঢাকায় আছে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থাপনা একাডেমি, মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতর, শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ, কারিগরি অধিদফতর ও তিনটি শিক্ষা বোর্ড। প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেই দুর্নীতিবাজদের একটি সিন্ডিকেট আছে। বছরের পর বছর একই পদে থাকার কারণে তারা ধরাকে সরাজ্ঞান করেন।
ঢাকা শিক্ষা বোর্ডে একজন কর্মকর্তা দশ বছর ধরে নিম্নপদের হয়েও উচ্চপদ দখল করে ছিলেন। তিনি শিক্ষা খাতে আলোচিত ‘বাড়ৈ’ সিন্ডিকেটের শীর্ষব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। ওই কর্মকর্তা এখন পদ টিকিয়ে রাখতে লবিং-তদবির শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে তিনি শিক্ষা উপমন্ত্রীকে নিজের এলাকার লোক পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তারেরও চেষ্টা করছেন। ওই বোর্ডের স্কুল পরিদর্শক গত ১০ বছরে একাধিকবার ঢাকারই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শাস্তিমূলক বদলি-ওএসডি হয়েছেন। কিন্তু এরপরও সাবেক প্রশাসন তাকে ঘুরে-ফিরে ঢাকায়ই পদায়ন করেছেন।
বিভিন্ন মহলের সমালোচনা ও গোয়েন্দা প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা বোর্ডে বেশকিছু পদে রদবদল হয়। কিন্তু ঢাকার বাইরে শাস্তিমূলক বদলি হওয়াদের অনেকেই ফিরে এসেছেন। আবার এই বোর্ডে বদলির পর শূন্য হওয়া পদে যাদেরকে নতুন পদায়ন করা হয়েছে, তারাও বছরের পর বছর ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুবিধাজনক পদে ছিলেন। নাম প্রকাশ না করে বোর্ডের একাধিক সূত্র জানায়, দশ বছরে বিদায়ীরা যা না করেছে, নতুন পদায়ন পাওয়া ব্যক্তিদের দু-একজন কয়েক মাসে তা করে ফেলেছে।
একই অভিযোগ এসেছে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক বোর্ডে নতুন করে গুরুত্বপূর্ণ পদ পাওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধেও। সেখানে কয়েকজন কর্মকর্তা ঘুরে ফিরে নানা পদ দখল করছেন। তাদের অদক্ষতায় পাঠ্যপুস্তকের ভুলত্রুটি হয়েছে। এ কারণে সরকারকে বারবার বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়েছে।
ঢাকার বিভিন্ন বড় কলেজ, বিভাগীয় শহরের বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড, মাউশির আঞ্চলিক অফিস এবং বড় কলেজেও মুখচেনা কিছু লোক বছরের পর বছর অবস্থান করছেন। শিক্ষা বিভাগের আলোচিত বাড়ৈ সিন্ডিকেটের হোতা হিসেবে সাবেক শিক্ষামন্ত্রীর সাবেক এপিএস মন্মথ রঞ্জন বাড়ৈর লোক হিসেবে পরিচিত ওই ব্যক্তিরা। ওই এপিএসের বিরুদ্ধেও নানা অভিযোগ উঠেছিল। সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে এপিএসের পদ থেকে তাকে সরানো হয়েছিল।
শিক্ষায় ‘সখী’ নামে ৭-৮ জনের একটি গ্রুপ আছে। ওই সখীরা শিক্ষার এক শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ ছিলেন। যে কারণে বছরের পর বছর একই কর্মস্থলে তারা অবস্থান করে গেছেন। আবার দুর্নীতি করেও পার পেয়েছেন তারা। তাদের মধ্যে একজন ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে সম্প্রতি বিতাড়িত হয়েছেন। ওই মহিলা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সাবেক প্রশাসন তদন্ত করায়নি।