দেশের খবর: উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক তোড়জোড় শুরু হলেও বিএনপির কোনো তৎপরতা চোখে পড়ছে না। প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে অনুষ্ঠেয় স্থানীয় সরকার পর্যায়ের এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ভীষণ উজ্জীবিত। দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা দৌড়ঝাঁপ চালিয়ে যাচ্ছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে এমপি পদে মনোনয়নবঞ্চিতরা এবার উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী হিসেবে অগ্রাধিকার পাবেন বলে মনে করেন আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা।
অন্যদিকে জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবির পর উপজেলা নির্বাচন নিয়েও হতাশা ভর করেছে বিএনপিতে। সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে নেই কোনো চাঞ্চল্য। এমনকি বিএনপি সমর্থিত বেশিরভাগ উপজেলার চেয়ারম্যানরাও আসন্ন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না।
চলতি বছরের মার্চে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপজেলা নির্বাচনের জন্য উপযোগী হবে। সেই অনুযায়ী মার্চ কিংবা এপ্রিলের পর ওইসব উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান এবং মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদে নির্বাচনের সম্ভাবনা রয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের কর্মকর্তারা এখন নির্বাচনের প্রাসঙ্গিক প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সংশ্নিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে উপজেলা পরিষদের প্রথম সভার তারিখ জানতে চেয়ে জেলা প্রশাসকদের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। কোন উপজেলা পরিষদের মেয়াদ কবে শেষ হচ্ছে সেই তথ্য সংবলিত একটি তালিকা আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে তৈরি হবে। এরপর পর্যায়ক্রমে উপজেলা নির্বাচন করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দেওয়া হবে। স্থানীয় সরকার বিভাগের তালিকা অনুযায়ী কমিশন নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করবে।
স্থানীয় সরকার আইনে (উপজেলা পরিষদ) বলা রয়েছে, উপজেলা পরিষদ গঠনের পর প্রথম সভা থেকে ৫ বছর মেয়াদ সম্পন্ন হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে হবে। ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত কয়েক ধাপে দেশের বিভিন্ন উপজেলায় সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই হিসাব অনুসারে যেসব উপজেলা পরিষদের মেয়াদ আগে পূর্ণ হবে, প্রথম পর্যায়ে সেসব উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে এবার প্রথমবারের মতো দলীয় প্রতীকে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন হবে। এর আগে সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়র এবং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান পদে রাজনৈতিক দলের পরিচয় ও প্রতীকে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। দলীয় প্রতীকের প্রার্থী হওয়ার লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ব্যাপক তোড়জোড় চালিয়ে যাচ্ছেন। যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে এ নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়নি। এ নিয়ে এখনও আলোচনাও হয়নি বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ূয়া বলেন, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে সাংগঠনিক প্রস্তুতি এখনও শুরু হয়নি। তবে সম্ভাব্য প্রার্থীরা উপজেলা পর্যায়ে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
অন্যদিকে বিএনপি উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনও কোনো সিদ্ধান্তই নিতে পারেনি। গত শুক্রবার বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হলেও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে বেশিরভাগ নেতা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে নেতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। ২৫৭টি আসনে বিজয়ী হয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করেছে দলটি। জাতীয় নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনেও নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হতে আগ্রহীদের তালিকা দীর্ঘ। তাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার জন্য সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নিজেদের অবস্থান সংহত করার লক্ষ্যে ব্যাপক আগ্রহে নবনির্বাচিত মন্ত্রী এবং এমপিদের সঙ্গে সখ্য বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গেও যোগাযোগ রক্ষা করছেন নিয়মিত। পাশাপাশি জেলা-উপজেলা ও তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কাছে টানার লক্ষ্যেও নিরলস পরিশ্রম করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের কৌশলী প্রচার শুরু হয়েছে এরই মধ্যে।
আওয়ামী লীগের কয়েকজন নীতিনির্ধারক নেতা বলেছেন, কেন্দ্রীয়ভাবে প্রস্তুতি শুরু না হলেও দলের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং আট সাংগঠনিক সম্পাদক উপজেলা নির্বাচনের কার্যক্রম গুছিয়ে আনবেন। পরে প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতামত নেওয়া হবে। সেই মতামতের ভিত্তিতে ১৮ সদস্যের স্থানীয় সরকার/পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদ মনোনয়ন বোর্ডের বৈঠকে প্রার্থী চূড়ান্ত করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
কেন্দ্রীয় চার যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে মাহবুবউল আলম হানিফ চট্টগ্রাম ও সিলেট, শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ঢাকা ও ময়মনসিংহ, অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক রংপুর ও রাজশাহী, আবদুর রহমান বরিশাল ও খুলনা বিভাগের দায়িত্বে থাকতে পারেন। আট সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে আহমদ হোসেন সিলেট, মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ অ্যাডভোকেট ময়মনসিংহ, বি এম মোজাম্মেল হক রংপুর, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বরিশাল, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম চট্টগ্রাম, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন খুলনা, নৌ-পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী রাজশাহী এবং শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ঢাকা বিভাগের কার্যক্রম দেখভাল করতে পারেন।
উপজেলা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের বেলায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে বলে মনে করছেন নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সামসুল আলম ভূঁইয়া রাখিল। তিনি জানিয়েছেন, উপজেলা পর্যায় থেকে সম্ভাব্য তিনজন প্রার্থীর নাম জেলা নেতাদের কাছে পাঠানো হবে। জেলা নেতারা ওই তালিকা কেন্দ্রীয় দপ্তরে পাঠাবেন। সেই তালিকা থেকেই একজনের নাম চূড়ান্ত করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সামসুল আলম ভূঁইয়া রাখিল শিবপুর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে একজন সম্ভাব্য প্রার্থী। তার ভাষায়, উপজেলা নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগে ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও বিএনপির তৎপরতা একেবারেই নেই।
এদিকে দেশের ৪৯৬টি উপজেলায় চেয়ারম্যান, ভাইস-চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস-চেয়ারম্যান পদের জন্য আওয়ামী লীগে সম্ভাব্য প্রার্থীর ছড়াছড়ি থাকলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলের মনোনয়ন বঞ্চিতরাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী হবেন বলে দলের শীর্ষ নেতারা মনে করছেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪ হাজার ২৩ জন প্রার্থী দলের মনোনয়ন চাইলেও বঞ্চিত হয়েছেন ৩ হাজার ৭৬২ জন। বঞ্চিত এই প্রার্থীদের প্রায় সবাই উপজেলা নির্বাচনে দলের সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় থাকবেন বলে নানাভাবে আভাস পাওয়া গেছে। তাদের কেউ কেউ এরই মধ্যে উপজেলা নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থিতার কথা জানান দিয়ে পোস্টার ছেপেছেন। ফেস্টুন লাগিয়েছেন।
বেশ কয়েকজন উপজেলা চেয়ারম্যান একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চাইলেও তাদের কাউকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তবে ওই প্রার্থীরা উপজেলা নির্বাচনে দলের মনোনয়ন চাইলে বঞ্চিত হবেন না বলে নীতিনির্ধারক নেতারা নিশ্চিত করেছেন। অন্য সব উপজেলায় দলীয় মনোনয়নের বেলায় নানামুখী হিসাব-নিকাশ এবং প্রার্থীদের যোগ্যতার পাশাপাশি সাংগঠনিক দক্ষতার বিষয়টির চুলচেরা বিচার বিশ্নেষণ করা হবে। সেই ক্ষেত্রে পরপর দুই দফায় বিজয়ীদের আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন না দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। গত সংসদ নির্বাচনের মতো আগামী উপজেলা নির্বাচনে দলের একক প্রার্থী থাকবেন। বিদ্রোহী হলেই বহিস্কার করা হবে।