রাজনীতির খবর: ২০১১ সাল থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দলটিকে মৃত বলে মন্তব্য করেছেন জামায়াত থেকে সদ্য পদত্যাগ করা ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক। শুক্রবার সন্ধ্যায় বিবিসি বাংলার সঙ্গে এক বিশেষ সাক্ষাতকারে তিনি এই মন্তব্য করেন।
একাত্তরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনে সমালোচিত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের সেক্রেটারি জেনারেলের পদ থেকে তার পদত্যাগের খবর প্রকাশিত হয়েছে শুক্রবার। আবদুর রাজ্জাক নিজেই আজ শুক্রবার গণমাধ্যমে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, তিনি জামায়াতে ইসলামী থেকে পদত্যাগ করেছেন।
দল থেকে কেন এই পদত্যাগ এ বিষয়ে জামায়াতের এই নেতা শনিবার সন্ধ্যায় কথা বলেন বিবিসির বিশেষ ফেসবুক লাইভ অনুষ্ঠানে। বিবিসি বাংলার এই অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন মাসুদ হাসান খান।
বিবিসি বাংলার পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়, বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিতে জামায়াতের রাজনীতি অস্তিত্বের সংকটের মধ্যে আছে। দলের এই চরম অবস্থার মধ্যে আপনি দল থেকে কেন পদত্যাগ করলেন?
এই উত্তরে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর আমি জামায়াতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। এবং আমি দুটো অঙ্গনে বেশি কাজ করেছি। একটি হচ্ছে আইনের অঙ্গনে ও অপরটি হচ্ছে কূটনৈতিক অঙ্গনে। ১৯৯২ সনে গোলাম আজমের যে নাগরিকত্ব মামলা হলো সেই মামলায় আমি জুনিয়র আইনজীবী ছিলাম। তারপরে সাঈদী সাহেবের মামলা লড়েছি। ২০০৭ এবং ২০০৮ সালে ইমার্জেন্সির সময়ে আমি নিজামী সাহেব ও মুজাহিদ সাহেবের মামলা লড়েছিলাম প্রধান কৌসলী হয়ে।
২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত এই ৩ থেকে ৪ বছর আমি প্রধান কৌসলী হিসেবে শীর্ষ ১০ জন জামায়াতের ইসলামীর নেতার মামলা পরিচালনা করেছি। সুতরাং আমার যেটা কাজ ছিল জামায়াতকে লিগ্যালি রিফর্ম করা সেটা আমি সততার সাথে পালন করেছি। আমি কিছু ডিপ্লোমেটিক কাজও করেছি। আটলান্টিক মহাসাগরের দুই পাড়েই ইউনাইটেড স্টেইটসে , ইউনাইটেড নেশন্সে , ফ্রান্স জার্মানিতে আমি অনেক ডিপ্লোমেটিক কাজ করেছি। এছাড়াও আমি বলেছি আমার পদত্যাগপত্রে ৩০ বছর আগে আমি যখন জয়েন করি তখন জয়েন করার পরে আমার একটা উদ্দেশ্য ছিলো যে আমি জামায়াতকে রিফর্ম করব। সেই রিফর্ম করতে আমি ব্যর্থ হয়েছি।
আরেকটা আমার উদ্দেশ্য ছিল যে আজকে জামায়াত কেন জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ? আজকে জামায়াতকে কেনো একটি গ্লানি বহন করতে হচ্ছে ? ৭১ সালে যে শিশু জন্ম নিয়েছে সে তো ৭১ এর যুদ্ধ দেখেওনি । সে তো সেই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কোনোভাবেই জড়িত নয়। কিন্তু আজকেও তাকে এর দায়ভার বহন করতে হচ্ছে। এমনকি ৮১তেও যে জন্ম নিয়েছে তাকেও এর দায়ভার নিতে হচ্ছে। এরা কিন্তু বাংলাদেশের সমাজে অংশগ্রহণকারী অংশ হতে পারত।
১৯৭১ এ যে স্টামপ্লিং ওয়ার্ক, আপনারা দেখেছেন আমার পদত্যাগ পত্রে আমি আইটেমাইজড করে বলেছি ২০০১ থেকে শুরু করে ২০১৯ পর্যন্ত আম কি করেছি । জামায়াতকে রিফর্ম করার জন্য , জামায়াতকে যেন ৭১ এর বোঝা বহন করতে না হয় সে জন্য আমি আপ্রাণ চেষ্টা করেছি এবং আমি যখন দেখলাম আমার আর কিছু করার নাই , কিছু দেওয়ার নাই তখন আমি আমার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
বিবিসি: আপনি আপনার পদত্যাগ পত্রে লিখেছেন যে ৭১ এর যুদ্ধের ভূমিকার জন্য জামায়াতকে ক্ষমা চাওয়া উচিত । এই কথাটা আপনি বুঝেছেন কিন্তু অন্যরা কেন বুঝছেন না?
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: এই বিষয়টি আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। উদাহরণ দেখিয়েছি যে স্বাধীনতার বিরোধিতা করে কোনো দেশে কোনো দল নেতৃত্ব দিতে পারে না। আমি চেষ্টা করেছি, কিন্তু সেখানে অপনিয়ন ডিভাইডেড ছিল। সবাই যে বিরোধিতা করেছে তাই না। কিছু লোক পক্ষে ছিল আর কিছু লোক বিপক্ষে ছিল । জামায়াতের একটা সংস্কৃতি আছে আর সেটা হলো জামায়াত পার্টি ভেতরে গণতন্ত্রের চর্চা করে । ৫০ জনের মিটিং এ ২৬ জন যদি বলে আমরা এটার পক্ষে নয় তাহলে বাকিদের বাধ্য হয়েই সেই ২৬ জনের মতামত মেনে নিতে হবে। সুতরাং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের কারণেই জামায়াত এখানে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। কিন্তু একটা কথা আমি বলব …
বিবিসি: তার মানে সংখ্যাগরিষ্ঠ জামায়াত নেতাকর্মীরা আপনার সঙ্গে নেই ?
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: দেখুন আমি জামায়াত নেতাদের আগেই বলেছি যে দেখুন সংখ্যাগরিষ্ঠতা মোট যাই হোক না কেন আপনারা লিডারশিপ দিচ্ছেন , আমরা লিডারশিপ দিচ্ছি ( যদিও আমি এখন লিডারশিপে জড়িত নয়) । আমি নেলসন ম্যান্ডেলার উদাহরণ দিয়েছিলাম যে, শ্বেতাঙ্গদের সঙ্গে উনি শেষ পর্যন্ত আপসে গেলেন কিন্তু তার দলের লোক বলছিল যে, আমরা যুদ্ধ করব। সুতরাং এটা আমি বোঝানোর চেষ্টা করেছি। সবাই যে বোঝেন না তা না। কিন্তু এটা তারা করতে অপারগ যে কারণে আমি তাদের ব্যর্থ বলি।
বিসিসি: আপনি কি চাইছেন ৭১ এর ভূমিকার জন্য জামায়াতকেই বিলুপ্তি করা হোক? কারণ তার একটা ৭১ এর স্টিগমা তো আছেই।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: ৭১ এর স্টিগমা তো আছেই। দ্বিতীয়ত হচ্ছে ২০১১ সাল থেকে এই দলের কার্যক্রম বস্তুত বন্ধ। বাংলাদেশের ৬৫ টা ডিস্ট্রিক্টে যতগুলা অফিস আছে প্রায় সবকটা অফিসই বন্ধ। ঢাকা শহরের ২-৩ টা অফিস সবই বন্ধ, জামায়াতের নিবন্ধন নাই, জামায়াতের ইলেকশন সিম্বল নাই । সুতরাং এতে করে জামায়াত কোনো মিছিল করতে পারে না, মিটিং করতে পারে না। প্রেস কনফারেন্স সরকার যেহেতু করতে দিচ্ছে না তাই জামায়াতের নতুন পরিকল্পনা করা উচিত।
বিবিসি: অর্থাৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে এখন মৃত বলবেন আপনি ?
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: জামায়াতকে কোনোভাবেই সরকার একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে ফাংশন করতে দিচ্ছে না যদিও আইনত জামায়াত এখনও বেইআইনি না। কিন্তু কার্যত সরকার এটাকে বে আইনি করেই রেখেছে।
বিবিসি: তাহলে কি এটা বলা যে আপনিও চাপের মুখে এই ধরনের কথাবার্তা বলছেন ,পদত্যাগ করছেন , নতুন দল গড়বেন, জামায়াত বিলুপ্তি করতে হবে। আপনার উপরে কি তাহলে কোনো চাপ আছে?
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: একেবারেই না। চাপে হলে কি আমি ২০০১ সালে এই প্রশ্নটা উত্থাপন করতাম ? আজকে আমি যেটা মনে করি জামায়াতের জন্য একিলিস হিল হচ্ছে ১৯৭১। জামায়াতে ইসলামী তার ইতিহাসের মধ্যে ২০০১ সালে সবচাইতে ভালো অবস্থায় ছিল। জামায়াতের আমির ও সেক্রেটারি দুইজনেই মন্ত্রিসভাতে ছিল। একজন নির্বাচিত এমপি ছিল আর আরেকজন ছিলো ফ্রম আদার কোটা । সুতরাং ওই সময়ে আমি উত্থাপন করেছিলাম যে জামায়াতের দেশের কাছে মাফ চাওয়া উচিত। সুতরাং আমি কোনো চাপের মধ্যে কোনো কাজ করিনি ।
বিবিসি: ধরুন আপনি এখনও জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মধ্যে আছেন এবং আপনি দলের শীর্ষনেতা এবং দলের সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত আপনার পক্ষে । তখন জাতির কাছে যখন ক্ষমা চাইতে আপনি আসলে কী বলতেন? বা জামায়াতের কী বলা উচিত?
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমি এটা পরিষ্কার বলতাম যে কারণ যাই হোক না কেন আমরা ১৯৭১ বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছি। এটা আমাদের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাচ্ছি। কোন দ্বিধা ছাড়াই আমি এটা বলতাম।
বিবিসি: মানে আপনি যখন বলবেন ১৯৭১ সাল আমি ভুল করেছি , আমরা ভুল করেছি , মাফ করে দিন তার মধ্য দিয়ে জামায়াতের একটা বিশাল অংশের রাজনীতিকে আমি নেগলেক্ট করে দিচ্ছেন মানে হাউ হেলদি ইজ ইট ? মানে জামায়াতের ভেতরে যারা আছে যারা আপনার পক্ষে না যারা আপনার মতের সঙ্গে সমর্থন করছে না তারা তো এটা এভাবে দেখতেই পারে যে রাজনীতির একটা বিশাল অংশকে আপনি উড়িয়ে দিচ্ছেন।
ব্যারিস্টার রাজ্জাক: আমরা একটা পরিবর্তনের দুনিয়াতে বাস করি। ১৯৪০ সালের জামায়াত, ১৯৪৭ সালের জামায়াত , ১৯৭১ এর জামায়াত, এবং একবিংশ শতাব্দীর জামায়াত এক হতে পারে না। আপনাকে স্ট্র্যাটেজী পরিবর্তন করতে হবে। আমরা তুরস্কে দেখছি সে কৌশল পরিবর্তন হয়েছে, তিউনিসিয়াতেও দেখেছি। সুতরাং …