শিক্ষা সংবাদ: ছাত্র হিসেবে আবরার আহমেদ চৌধুরী যেমন মেধাবী ছিলেন, ব্যক্তি জীবনে ছিলেন চঞ্চলও। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস (বিইউপি)-এ পড়তেন তিনি। ক্যাম্পাসে বিতর্ক প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে খেলাধুলা- দ্বিতীয় হতেন না কোনো কিছুতেই। সামাজিক নানা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয় ছিলেন, ছিলেন নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও। সেই আবরারকেই কেড়ে নিল বাসের চাকা। থেমে গেল সব স্বপ্ন। প্রাণোচ্ছল তাকে হারিয়ে নিস্তব্ধতা পুরো বিইউপিতে। শোকাহত সহপাঠী, শিক্ষকেরাও। শোকে পাথর বাবা-মা। ছেলের স্মৃতি হাতড়ান, কেঁদে ওঠেন সঙ্গে সঙ্গে। মেধাবী আবরারের এভাবে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না কেউই।
বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ছাত্র ছিলেন আবরার। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৮টায় ক্লাস ছিল তার। ক্লাসে যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নর্দ্দায় যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যাম্পাসের বাস ধরতে চেয়েছিলেন তিনি। জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে গিয়েও চাপা পড়েন বাসে, চাপায় প্রাণ হারান তিনি। শিক্ষক-সহপাঠীরা বলছিলেন, আবরার ক্লাসের নানা পরীক্ষা আর ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় হতেন না কখনও।
গতকাল বিকেলেই বনানী কবরস্থানে দাফন হয়েছে আবরারের। সেখানে শিক্ষক, সহপাঠী ও স্বজনের সঙ্গে ছেলেকে শেষ বিদায় জানাতে উপস্থিত ছিলেন বাবা অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আরিফ আহমেদ চৌধুরী ও মা ফরিদা ফাতেমী।
ছেলেকে শেষ বিদায় দিতে এসে মা ফরিদা ফাতেমী বিলাপ করে বলছিলেন, ‘ছেলেকে কখনও একা ছাড়তে চাইতাম না। ও বলত, আম্মু তুমি যদি আমাকে একা চলাফেরা করতে না দাও, তবে আমি ইনডিপেনডেন্ট হবো কীভাবে? সবাই আমার বাবাটাকে অনেক পছন্দ করত। পরিবারের মাথার মুকুট ছিলি তুই।’ হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন এই মা। তিনি বলেন, ‘আমাদের একা ফেলে চলে গেলি কীভাবে? আমি কীভাবে তোকে ছাড়া থাকব!’
বড় ছেলের অকালে চলে যাওয়া মেনে নিতে পারছেন না বাবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা আরিফ আহমেদ চৌধুরীও। মুষড়ে পড়েছেন তিনি। এই বাবা বলছিলেন, ‘জীবনে অনেক কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছি। ছেলেকে কবরে শুইয়ে দেওয়ার মতো কঠোরতা আর কষ্ট কোনো কিছুর সঙ্গে মিলবে না। জীবনের সব সফলতা যেন একটি ঘটনায় ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল।’
সহপাঠীরা কিছুতেই ভাবতে পারছেন না- সারাক্ষণের প্রাণোচ্ছল আবরার আর নেই। তার একজন সহপাঠী বিইউপির ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষার্থী মাহির বলেন, ‘আবরার জুনিয়র হলেও ঘনিষ্ঠ ছিলাম আমরা। ক্যাম্পাসের বাস ধরার জন্য জেব্রা ক্রসিং দিয়ে রাস্তা পার হতে যাচ্ছিল সে। পেছনেই ছিলাম আমি। তাকিয়ে দেখি রাস্তায় রক্ত, ছটফট করছে আবরার। এই দৃশ্যটা মেনে নিতে পারছি না, জীবনেও ভুলব না। এটা আমাকে তাড়া করবে সারাজীবন।’
আবরারের একজন শিক্ষক বিইউপির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শায়লা সুলতানা। তিনি বলছিলেন, ‘সোমবার দুপুরেও আবরারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। অথচ পরের দিনই সে নেই! এটা মেনে নেওয়া কষ্টকর। এক কথায় মনে রাখার মতো ছাত্র ছিল সে। যেমন পড়াশোনায়, তেমনি আচার-আচরণেও। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা ও বিতর্ক প্রতিযোগিতাতেও সরব উপস্থিতি ছিল তার।’
বিইউপির শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, খুব শান্ত ও অমায়িক স্বভাবের ছিলেন আবরার। কারও সঙ্গে কখনও মনোমালিন্য হতো না তার। ভালো বন্ধুত্ব ছিল সহপাঠীদের সবার সঙ্গেই।
স্বজনরা জানান, আবরার ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘এ’ এবং ‘ও’ লেভেল পাস করে গত বছর বিইউপিতে ভর্তি হন। যদিও তার চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল। এবার আবার মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল তার। তার ছোট ভাই আবিদ আহমেদ চৌধুরী ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকে ভাড়া বাসায় থাকতেন তারা।

