খেলার খবর: চলতি বিশ্বকাপে নিজেদের ষষ্ঠ ম্যাচে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৪৮ রানের ব্যবধানে হেরে গেছে বাংলাদেশ। অজিদের দেয়া ৩৮২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৮ উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ৩৩৩ রান তুলতে সক্ষম হয় টাইগাররা। যা কি-না ওয়ানডে ইতিহাসে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ এবং বিশ্বকাপের ইতিহাসে দ্বিতীয় ইনিংসে তৃতীয় সর্বোচ্চ রানের ইনিংস।
বৃহস্পতিবার (২০ জুন) নটিংহ্যামের টেন্টব্রিজে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেন অজি অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চ। ম্যাচটি শুরু হয়েছে বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৩টায়।
টস জিতে ব্যাটিংয়ে নেমে উদ্বোধনী জুটিতে ডেভিড ওয়ার্নারের সঙ্গে ১২১ রানের জুটি গড়েন অ্যারন ফিঞ্চ। ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠা তাদের এই জুটি ভাঙেন সৌম্য সরকার। মাশরাফি, মোস্তাফিজ, সাকিব, রুবেলরা ইনিংসের প্রথম ২০ ওভার বল করেও দলকে ব্রেক থ্রু এনে দিতে ব্যর্থ হন।
টুকটাক বোলিং করা জাতীয় দলের ওপেনার সৌম্য সরকার ২১তম ওভারে বোলিংয়ে এসেই অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চকে ক্যাচ তুলতে বাধ্য করেন। রুবেলের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফেরার আগে ৫১ বলে ৫টি চার ও দুই ছক্কায় ৫৩ রান করেন ফিঞ্চ।
এরপর দ্বিতীয় উইকেটে উসমান খাজাকে সঙ্গে নিয়ে ১৯২ রানের জুটি গড়েন ডেভিড ওয়ার্নার। এই জুটিতেই শতরানের মাইলফলক স্পর্শ করেন অস্ট্রেলিয়ান এ ওপেনার। বিশ্বকাপে তৃতীয় সেঞ্চুরি করার পর একেরপর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়ে দেড়শ পূর্ণ করেন ওয়ার্নার। তার ব্যাটে ভর করে রানের পাহাড় গড়ার পুঁজি পায় অস্ট্রেলিয়া।
উইকেটে অনবদ্য ব্যাটিং করে যাওয়া ওয়ার্নারকে শেষ পর্যন্ত সাজঘরে ফেরান সৌম্য সরকার। সৌম্যর বলে বাউন্ডারি হাঁকাতে গিয়ে রুবেলের হাতে ক্যাচ তুলে দিয়ে ফেরেন ওয়ার্নার। তার আগে ১৪৭ বলে ১৬৬ রান করেন অস্ট্রেলিয়ান এ তারকা ব্যাটসম্যান। ৪৪.২ ওভারে দলীয় ৩১৩ রানে আউট হন ওয়ার্নার।
এরপর উইকেটে এসে ছোটখাটো এক ঝড় তুলেন গ্লেন ম্যাক্সওয়েল। ৪৭তম ওভারে এসে আবারও চমক দেখান সৌম্য। ১০ বলে ২ চার আর ৩ ছক্কায় ৩২ রান করা ম্যাক্সওয়েল শর্ট ফাইন লেগে বল ঠেলে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। রুবেল হোসেন সরাসরি থ্রোতে স্ট্যাম্প ভেঙে দেন।
ওই ওভারেরই পঞ্চম বলে উসমান খাজাকে মুশফিকুর রহীমের ক্যাচ বানান সৌম্য। ৭২ বলে ১০ বাউন্ডারিতে ৮৯ রানে সাজঘরের পথ ধরেন খাজা, সেঞ্চুরি না পাওয়ার আক্ষেপ নিয়ে। এরপর ১ রান করে মোস্তাফিজের বলে লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে ফিরেন স্মিথ।
শেষ পর্যন্ত মোস্তাফিজের করা শেষ ওভারে ১৩ রান নিয়ে ৩৮১ রানের পুজি সংগ্রহ করে অস্ট্রেলিয়া। যা বিশ্বকাপে নিজেদের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। ২০১৫ বিশ্বকাপে আফগানদের বিপক্ষে ৪১৭ রান বিশ্বকাপে তাদের সেরা স্কোর, যা আবার বিশ্বকাপ ইতিহাসেরও সর্বোচ্চ।
বল হাতে টাইগার বোলারদের মধ্যে সেরা বোলিং করেছেন সৌম্য সরকার। ৮ ওভারে ৫৮ রানে ৩ উইকেট নিয়েছেন এই পার্ট-টাইম বোলার। ১ উইকেট ঝুলিতে পুরলেও ৯ ওভারে ৬৯ রান খরচ করেছেন মোস্তাফিজুর রহমান। ৮ ওভারে ৫৬ রান খরচ করে উইকেটশুন্য মাশরাফি। মেহেদি হাসান মিরাজ ১০ ওভারে ৫৯ রান খরচ করেছেন।
যাকে দলে নিতে এতদিন ব্যাপক আলোচনা হচ্ছিল সেই রুবেল হোসেন ৯ ওভারে দিয়েছেন ৮৩ রান। রান খরচ করেছেন ওভার পিছু ৯.২২ করে। সাকিব ৬ ওভারে দিয়েছেন ৫০ রান। অর্থাৎ, বল হাতে সব বোলারই ব্যর্থ।
৩৮২ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ইনিংসের চতুর্থ ওভারেই বাংলাদেশ শিবিরে আসে বড় ধাক্কা। দুর্ভাগ্যজনক রানআউটের শিকার হন সৌম্য সরকার।
প্যাট কামিন্সের বলটি মিডঅনে ঠেলে দিয়ে দৌড় দিয়েছিলেন তামিম ইকবাল, মাঝে ভুল বোঝাবুঝিতে ফেরত আসেন স্ট্রাইকিং এন্ডে। কিন্তু ননস্ট্রাইক এন্ডে সৌম্য ফিরতে পারেননি, অ্যারন ফিঞ্চের সরাসরি থ্রোতে ভেঙে যায় স্ট্যাম্প। ৮ বলে ২ বাউন্ডারিতে সৌম্য সাজঘরের পথ ধরেন ব্যক্তিগত ১০ রানেই।
দ্বিতীয় উইকেটে ৭৯ রানের জুটি গড়েন সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। দুর্দান্ত ফর্মে থাকা সাকিব ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন বিশ্বকাপে টানা পঞ্চম ফিফটির। কিন্তু দলীয় ১০২ রানের মাথায় তিনি আউট হন ব্যক্তিগত ৪১ রানে।
এর আগে অবশ্য প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে ৪০০’র বেশি রান করার কৃতিত্ব দেখান বিশ্বসেরা এ অলরাউন্ডার। পাঁচ ইনিংসে ১০৬.২৫ গড়ে এখনও পর্যন্ত তার সংগ্রহ ৪২৫ রান।
সাকিবের বিদায়ের পর তামিম তুলে নেন চলতি বিশ্বকাপে নিজের প্রথম ফিফটি। মুশফিকের সঙ্গে তার জুটিতে দলীয় সংগ্রহটাও এগুচ্ছিলো বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই। কিন্তু সুখ যেনো বেশিক্ষণ সয়নি তামিমের।
মিচেল স্টার্কের করা ২৫তম ওভারের প্রথম বলটি ছিলো অফস্টাম্পের বেশ বাইরে। থার্ডম্যান দিয়ে গলাতে গিয়ে উল্টো স্ট্যাম্পে টেনে নেন তামিম। থেমে যায় তার ৭৪ বলে খেলা ৬২ রানের ইনিংসটি।
আগের ম্যাচের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে উইকেটে আসেন লিটন কুমার দাস। কিন্তু প্রথম বলেই তাকে মরণঘাতী এক বাউন্সার দেন স্টার্ক। যা আঘাত হানে সোজা হেলমেটে। বেশ কিছুক্ষণ বন্ধ থাকে খেলা। প্রাথমিক সেবা নিয়ে খেলা শুরু করেন লিটন।
তখন আর মনেই হয়নি প্রথম বলেই মাথায় আঘাত পেয়েছেন তিনি। দারুণ ৩টি চারের মারে ১৬ বলে করে ফেলেন ২০ রান। কিন্তু আউট হয়ে যান লেগ বিফোরের ফাঁদে পড়ে। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিভিউ নেন লিটন।
রিপ্লেতে দেখা যায় আম্পায়ার আউটের সিদ্ধান্ত না দিলে বেঁচে যেতে পারতেন তিনি। কিন্তু ‘আম্পায়ার্স কল’ আউট থাকায় ত্রিশতম ওভারের দ্বিতীয় বলে দলীয় ১৭৫ রানের মাথায় সাজঘরেই ফিরে যেতে হয় লিটনকে।
এরপরই জুটি বাঁধেন মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহ। দু’জনই রান করছেন বলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। জুটিতেও পূরণ হয়েছে শতরান। তবে এখনও পাড়ি দিতে হবে অনেক লম্বা পথ। কারণ জয়ের জন্য লক্ষ্যটা যে আকাশছোঁয়া। যা তাড়ায় টাইগার ভক্তদের জয়ের আশা বাঁচিয়ে রাখে মুশফিক ও মাহমুদউল্লাহর জুটি।
ওভারপ্রতি প্রায় ১৫ রানের চাহিদায়, প্রতি ওভারেই একটি-দুইটি করে বাউন্ডারি হাঁকাচ্ছিলেন দুজনে। অস্ট্রেলিয়ার বোলারদের যথাযথ জবাব দিয়ে দুজন মিলে গড়ে ফেলেন শতরানের জুটি, যেখানে ফিফটি হয়ে যায় দুই ব্যাটসম্যানেরই।
লক্ষ্যটা বিশাল হওয়ায় আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ের পরেও শেষের পাঁচ ওভারে বাকি থাকে ৮২ রান। সে ওভার করতে এসেই মূলত বাংলাদেশকে ম্যাচ থেকে ছিটকে দেন নাথান কোল্টার নিল।
তার করা ৪৬ ওভারের তৃতীয় বলে ছক্কা হাঁকাতে গিয়ে ডিপ স্কয়ার লেগে ধরা পড়েন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ। আউট হওয়ার আগে ৫ চার ও ৩ ছক্কার মারে ৫০ বলে ৬৯ রান করেন তিনি।
তখন দলের প্রয়োজন ৪ ওভার ৩ বলে ৮০ রান। এমন মুহূর্তে সাব্বির রহমান ব্যাট করতে নেমে শূন্য রানে ফিরে যান! তখন শুধু অজিদের জয় উদযাপনের বাকি থাকলো অপেক্ষায়। মিরাজ আউট হন ৬ রানে। অন্যপ্রান্তে একা লড়াই করে ৯৫ বলে বিশ্বকাপে নিজের প্রথম সেঞুরি তুলে নেন মুশফিক। শেষ পর্যন্ত ৯ চার ও এক ছয়ে ১০২ রানে অপরাজিত থাকেন মুশফিক। মাশরাফি করেন অপরাজিত ৬ রান। লড়াই করেও হেরেছে বাংলাদেশ। তবে বোলারদের ব্যর্থতার দায় এই ম্যাচে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
অস্ট্রেলিয় বোলারদের মধ্যে মিচেল স্টার্ক, মার্কাস স্টয়নিস ও নাথান কোল্টার নাইল ২টি করে এবং অ্যাডাম জাম্পা একটি করে উইকেট শিকার করেন।