দেশের খবর: এনামুল হক এনু। তিনি পুরান ঢাকার গেণ্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি। তার ভাই রুপন ভূঁইয়া। তিনি একই কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক। এই দুই ভাইয়ের আরেক পরিচয় রয়েছে। তারা কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদ ওরফে ক্যাসিনো সাঈদের ব্যবসায়িক পার্টনার। ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের ক্যাসিনোর অংশীদার। থানা পর্যায়ের আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার টাকা রাখার জায়গা নেই। তাদের টাকায় ঠাসা একে একে পাঁচটি ভল্ট খুঁজে পেয়েছে র্যাব। আরও একটি ভল্টে মিলেছে স্বর্ণালঙ্কার। অত্যাধুনিক অস্ত্র আর গোলাবারুদও উদ্ধার হয়েছে তাদের বাসা থেকে। শুধু তা-ই নয়, র্যাব ঢাকাতেই এনামুলের ১৫টি বাড়ির সন্ধান পেয়েছে। এনামুলের আরও অন্তত ৩০টি বাড়ি রয়েছে বলে তাদের কাছে সংবাদ রয়েছে।
অভিযান পরিচালনাকারী র্যাব কর্মকর্তারা টাকা, অস্ত্র আর স্বর্ণালঙ্কার উদ্ধারের পর হতবাক। হতবাক স্থানীয়রাও। তাদের কেউ কেউ বলছেন, তারা দুই ভাই তো দেখি ‘সোনার খনির’ মালিক! স্থানীয়রা বলেছেন, আগে এই দুই ভাই ক্যাসিনোর খেলোয়াড় ছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা নিজেরাই মালিক বনে যান ক্যাসিনোর। যেন আলাদিনের চেরাগ চলে আসে হাতে। মাত্র তিন বছরেই হু হু করে বাড়তে থাকে তাদের বিত্তবৈভব। ঢাকায় একে একে বাড়ি কিনতে থাকেন তারা। আজ সিঙ্গাপুর তো কাল ব্যাংকক। রাতারাতি ভাগ্যের পরিবর্তনের বিষয়টি এলাকার মানুষের চোখ এড়ায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সূত্রাপুরের বানিয়ানগরে তাদের বাড়িতে র্যাব অভিযান চালিয়ে তিনটি ভল্টে খুঁজে পায় ১ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ৭২০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার। ছয়তলা ওই বাড়িতে অভিযান শেষে নারিন্দার লালমোহন সাহা স্ট্রিটে এনামুলের কর্মচারী আবুল কালাম কালু এবং শরৎগুপ্ত রোডে তার বন্ধু হারুনুর রশীদের বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। এ সময় আরও দুটি ভল্ট থেকে মোট ৪ কোটি টাকা জব্দ করা হয়। এসব টাকা ক্যাসিনোর বলে র্যাবের ধারণা। তবে র্যাব জানিয়েছে, অভিযুক্ত দুই ভাই, বন্ধু বা কর্মচারীদের গ্রেফতার করা যায়নি। র্যাবের কাছে খবর রয়েছে, ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর আগ মুহূর্তে কাউন্সিলর সাঈদের সঙ্গে সিঙ্গাপুর পাড়ি জমিয়েছেন তারা। আরেক ভাই রুপন দেশেই রয়েছেন। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। র্যাব কর্মকর্তারা বলেন, টাকা রাখার যায়গা না পেয়ে এ দুই ভাই সোনা কিনে রাখেন।
জানা গেছে, সোমবার মধ্যরাত থেকে র্যাব এনামুলের বানিয়ানগরের বাসা ঘিরে রাখে। গতকালের পৃথক তিন অভিযানে নগদ ৫ কোটি ৫ লাখ টাকা এবং ছয়টি আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। গতকাল দুপুরে বানিয়ানগরে অভিযান শেষে র্যাব-৩-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফি উল্লাহ বুলবুল সাংবাদিকদের জানান, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব এনামুলের পাঁচটি ভল্টে ক্যাসিনোর টাকা থাকার সন্ধান পায়। এনামুল ইংলিশ রোডের স্টিলের ফার্নিচার বিক্রির দোকান থেকে ভল্টগুলো ভাড়া নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এর মধ্যে সূত্রাপুরের কাঠেরপুল লেনে ৩১ নম্বর বানিয়ানগরে এনামুলের ছয়তলা বাসার দ্বিতীয় ও পঞ্চম তলায় তিনটি ভল্ট পান তারা।
এনামুল ও রুপন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার। ক্লাব থেকে ক্যাসিনোর লভ্যাংশের টাকা এনে তারা বাসায় রাখতেন। টাকার পরিমাণ বিপুল হওয়ায় তা রাখার জন্য অনেক বেশি জায়গা প্রয়োজন, তাই তারা স্বর্ণালঙ্কার কিনে ভল্টে রাখতেন। এনামুল হক এক সপ্তাহ আগে থাইল্যান্ড চলে গেছেন এবং তার ভাই রুপন ভূঁইয়া পলাতক। তবে র্যাব তাকে খুঁজছে। তারা টাকা অবৈধভাবে হস্তান্তর, রূপান্তর ও স্থানান্তর প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত। এ জন্য তারা মানি লন্ডারিং আইনে অপরাধ করেছেন। তাদের ভল্ট থেকে যেসব অস্ত্র পাওয়া গেছে, এসব দিয়ে তারা স্থানীয় বিভিন্ন মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করে আসছিলেন। এনামুলের স্ত্রীর সংখ্যা একাধিক। তাদের মধ্যে একজন এ ভবনের পঞ্চম তলায় থাকেন। আর রূপনের মালিকানাধীন দোতলায় থাকেন তাদের এক বোন।
সরেজমিন জানা গেছে, বানিয়ানগর মুরগিটোলা মোড়ে ছয়তলা এ বাড়ির প্রথম তিনটি ফ্লোরের মালিক রুপন। আর ওপরের তিনটির মালিক এনামুল। আওয়ামী লীগের এ নেতার বাসায় অভিযানে র্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আক্তারুজ্জামানের সামনে ভল্ট খোলা হয়। এ সময় নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার ছাড়াও দুটি পিস্তল, দুটি এয়ারগান ও একটি শটগান জব্দ করা হয়।
র্যাব জানায়, রাজধানীতে এনামুলের অন্তত ১৫টি বাসার সন্ধান পেয়েছে তারা। তবে ওয়ারী, সূত্রাপুর, গেণ্ডারিয়া, বংশাল, কোতোয়ালি এলাকায় এনামুল ও রুপনের আরও ৩০টি বাড়ি থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সপ্তাহখানেক আগে কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক সাঈদের সঙ্গে সিঙ্গাপুর হয়ে থাইল্যান্ড গেছেন এনামুল। তিনি সাঈদের ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি ও বাড়ি দখল সিন্ডিকেটের অন্যতম সদস্য। তিন-চার বছর আগে তারা হঠাৎ করে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়ি কেনা শুরু করেন। সূত্রাপুরের বাড়িটি দেড় বছর আগে হারুনুর রশীদ নামে একজনের কাছ থেকে তারা কিনেছেন। সূত্রাপুরের এ বাড়িতে অভিযান শেষে এনামুলের বাকি দুটি ভল্টের সন্ধানে আরও দুটি বাসায় অভিযান চালায় র্যাব। এনামুলের কর্মচারী আবুল কালাম ওরফে কালুর নারিন্দার ৮৩/১ লালমোহন দাস লেনের চতুর্থ তলার বাসা থেকে একটি ভল্ট জব্দ করা হয়। ওই ভল্ট খুলে পাওয়া যায় আরও দুই কোটি টাকা। ওই বাসার আলমারিতে রাখা একটি ব্যাগের ভিতর থেকে একটি পিস্তল ও ১৮ রাউন্ড গুলিও জব্দ করা হয়। এরপর এনামুলের বন্ধু হারুনুর রশিদের ২২/১ শরৎগুপ্ত রোডের তিনতলা বাড়ির দ্বিতীয় তলা থেকে জব্দ করা হয় আরেকটি ভল্ট। এখানে পাওয়া যায় আরও ২ কোটি টাকা। এনামুলের কর্মচারী কালামের স্ত্রী শিলা রহমান জানান, তার স্বামী আওয়ামী লীগ নেতা এনামুলের বিভিন্ন কনস্ট্রাকশন সাইট তদারক করেন। রবিবার এনামুলের বডিগার্ড পাভেল এসে একটি ব্যাগ এবং ভল্টটি রেখে যান। এনামুলের বন্ধু হারুনের স্ত্রী লিপি জানান, দুজন লোক এসে শনিবার দুপুরে তাদের বাসায় ওই ভল্ট রেখে যান। ভিতরে কী ছিল তা তারা জানতেন না।
স্থানীয়রা জানান, ওয়ারী, সূত্রাপুর, গেন্ডারিয়া, বংশাল, কোতোয়ালি থানা এলাকায় এনামুল ও রুপনের অসংখ্য বাড়ি থাকলেও তারা মূলত কোন বাড়িতে থাকতেন তা কেউ জানে না। তারা যেসব বাড়ির মালিকানা দাবি করেন, সেগুলো কেনার নাম করে অল্প কিছু টাকায় বাড়ির মালিকের কাছ থেকে বায়না করতেন। এরপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে বিনা টাকায় পুরো বাড়ি দখল করে নিতেন। যেসব বাড়ি কাগজপত্রে ঝামেলাপূর্ণ মনে করতেন, সেসব বাড়ি তারা টার্গেট করতেন।